দুষ্টু লোকেরা গড়ে বেশী মেধাবী হয়। সেই মেধার সাথে সাথে তাদের থাকে অদ্ভুত সব সখ, খেয়াল। এসব কারণেই তাদের আচরণ হয় ভিন্ন। সাধারণের মতো নয়। এরা বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিস্কার সম্পর্কে সাধারণের চেয়ে বেশী ধারণা রাখে। ব্যবহার করে নানাভাবে।
সব দেশেই আইন হয় অপরাধ দমন করতে। অর্থাৎ অপরাধীরা আইনের ফাঁক ফোকর বেশী জানে। সেই সাথে টাকা দিয়ে ভালো আইনজীবীদের কিনে নেয়। আইনের ফাঁক দিয়ে করে অপরাধ। কারণ নতুন আইন করতে সময় লাগে। আমাদের মতো গরীব দেশে নতুন আইন প্রণয়নে সময় একটু বেশী লাগে কারণ সাংসদ্গন অত বেশী দক্ষ নন। তবে উন্নত দেশের সাংসদ্গন দক্ষ বেশী। তার পরেও আইন তৈরির যে প্রক্রিয়া আছে তাতে অপরাধীরা অনেকেই পার পেয়ে যায়, তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ সহায়তায়।
হালের বড় সমস্যা হল ক্লোনিং। ফেসবুকের একাউন্ট ক্লোনিং হচ্ছে, ক্লোনিং হচ্ছে মোবাইল টেলিফোন। ভুয়া রেজিস্ট্রেশন তো ক্লোনিংএর কাছে কিছুই না, নস্যি মাত্র। এসব ক্লোনিং ফোন দিয়ে নানা মানুষের কাছে ফোন করে তাঁদের একাউন্ট থেকে টাকা ড্রাগ করে নেওয়া হয়। কয়েকদিন আগেই র্যাবের এক বিজ্ঞপ্তিতে দেখা গেছে যে, বিশেষ বিশেষ সিরিয়ালের নাম্বার থেকে ফোন এলে তা ধরলে আপনার ফোনের টাকা ট্র্যান্সফার করে নেবে।‘ +375602605281, +37127913091 +37178565072 +56322553736 +37052529259+255901130460 …অথবা, এমন কিছু নম্বর যার শুরুতে এই code গুলি ছিল। +375 +371 +381 …এই টাইপের নম্বর থেকে একটা মিসড্ কল হলে অথবা কিছুক্ষন রিং বেজে বন্ধ হয়ে গেলে, আপনি যদি এই সকল নম্বরের মধ্যে কোনো একটায় কল ব্যাক করেন তবে আপনার ব্যালেন্স থেকে 15-30$ কেটে নেওয়া হবে, আর তিন সেকেন্ডের মধ্যে আপনার কনট্যাক্ট লিস্ট এর সম্পূর্ণ কপি তাদের কাছে পৌঁছে যাবে। …আপনার ফোনে যদি আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ডিটেলস্ অথবা ক্রেডিট কার্ড ও ডেবিট কার্ডের তথ্য সেভ করা থাকে তবে সেগুলোও তারা কপি করতে সক্ষম হবে।
জেনে নিন এই সকল ফোন কোন কোন জায়গা থেকে করা হয় ও কোন জঙ্গিগোষ্ঠি করে থাকে… +375 is from Belarus +93 is From Afghanistan +371 is code for Lativa +381 is from Serbia +563 is code of Valparaiso +370 is code of Vilnius +255 is code of Tanzania …এই সকল ফোন ISIS জঙ্গিরা করে থাকে’।
এবার আসি ফেসবুকের একাউন্ট ক্লোনিং নিয়ে কারণ এখানেও আছে টেলিফোন ক্লনিংএর বিকল্প পথের কথা। এটা সব চেয়ে মজার কৌশল দুষ্টু লোকদের। এটা কী করে করা হয়? তা নিয়ে একজন দুষ্টু লোকের ভাষ্য শুনে পিলে চমকে গেছে আমার। এরা ফেসবুকে নানা ফান পোস্ট দেয়, নানা অ্যাপস দিয়ে। যেমন: জেনে নিন আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? আপনার সম্ভাব্য প্রেমিকা কে কে। পূর্ব জন্মে আপনার নাম কী ছিল, কংবা আপনার বউ আপনাকে কতটুকু ভালোবাসে, ইত্যাদি।
শুরুটা ভালো থাকলেও দুষ্টু লোকেরা এটার সুযোগ নিচ্ছে এখন। তারাও টার্গেটেড দেশের মানুষের মন মানষিকতা, চিন্তা চেতনার উপযোগী ফেসবুকের নানা অ্যাপস তৈরী করে ফেসবুকে ছাড়ছে। তাদের ফেসবুক আইডিতে পাবেন, বাংলাদেশের ম্যাপ, বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের ছবি, কখনোবা বঙ্গবন্ধুর ছবিও। এদের হিসেবে জিয়া বা গোলাম আযমের ছবি সাধারণত থাকে না। এদের সব পোস্ট দেশপ্রেম নিয়ে কিন্তু মাঝে মাঝে ইসলামের কথা আর এডাল্ট পেজে লাইক দেওয়ার নমুনা থাকে। তার পরেও আমরা কোন কিছু চেক না করে এদের বন্ধু হয়ে যাই। তাই আগে পিছে চিন্তা না করেই বন্ধুর টাইমলাইন দেখে, এসব অ্যাপস এ একবার ক্লিক করে ফেলি, মজা করার জন্য। এতেই কাজ হয়ে যায়, ওই প্রোগ্রামে আপনার একাউন্ট স্ক্যান করার অনুমতি/ সম্মতি আপনার কাছে থেকে নিয়েই তারা; করে তাদের অপকর্মটি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য।
এসব ফান করতে গিয়ে আমরা নিজের অজান্তেই আমাদের ফোন নাম্বার, আর ফোনে থাকা যাবতীয় তথ্য তাদের দিয়ে দিচ্ছি। পরে সে সব তথ্য দিয়ে চলে তাদের প্রচার, ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা চুরি, ফোন নাম্বার ক্লোনিং, ইত্যাদি নানা অপকর্ম। আপনার হয় নানা ঝামেলা, সমস্যা। অনেক ভালো লোকের গায়ে পড়ে সন্ত্রাসীর, চোর-বাটপারের সীল।
এবার ক্লোনিং করা ফোনের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যাক। ক্লোনিং ফোনে কোন সিম থাকে না। এটা চোরাচালানী, মাফিয়া আর সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করে। যে ক্যারিয়ার সে না জেনে এটা ব্যবহার করে। তাকে বলা হয় কয় দিন পর পরে শুধু চার্জ দিতে হবে। বলা হয়, টাকা ভরা লাগবে না, এনাফ ব্যালান্স আছে। এক মাসেও শেষ হবে না। এই ফোনে সামনে পিছিনে থাকে শক্তিশালী ক্যামেরা, ফোন ক্যারিয়ার কোথায় যাচ্ছে, কী করছে তা সব মনিটর করা যায় ট্র্যাকারের চেয়ে উন্নতভাবে। দরকার হলেই বলে দেওয়া হয় দিক পরিবর্তনের বা একশনে যাবার। এগুলোকে বোমা ফাটানোর রিমোট হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এরা সবাই হয় স্লিপার সেলের মেম্বার, নিজের চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে না বললেই চলে।
AFP’র খবরে বলা হয়েছে যে, ২০১৫ সালের জুনে সাইফেদ্দিন রেজগুই নামে একজন টেরোরিস্ট তিউনিশিয়ার সুস বিচে ৩৯ জনকে হত্যা করে। এরপর পুলিশের গুলিতে সে নিহত হয়। ময়নাতদন্ত বা অটোপসির মাধ্যমে তার শরীরে ক্যাপ্টাগন ড্রাগের উপস্থিতি ধরা পরে। এটা একটা সিন্থেটিক ড্রাগ (ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা ড্রাগ) যা গালফ কান্ট্রিগুলোতে ব্যবহার করা হয়।
সৌদি আরব, লেবানন, সিরিয়া এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে এই ড্রাগটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। আর এই ড্রাগ উত্পাদনের প্রধান ফ্যাক্টরিটি যেই অঞ্চলে পাওয়া গেছে সেটা আজ ISIL এর দখলে।ক্যাপ্টাগন জেহাদিদের পারফরমেন্স এর উন্নতি ঘটায়, তাদেরকে কোন রকম অবসাদ ও ভয় থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আর কোন রকম এমপ্যাথি বা আবেগকেও এটা সম্পূর্ণ নির্মূল করে দেয়। (এমপ্যাথি না থাকলে যে কেউ ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে। সাইকোপ্যাথদের এমপ্যাথি একেবারেই থাকে না বা অনেক কম থাকে)। অন্যভাবে বললে, মানুষকে দিয়ে অমানুষিক কাজ করানোর জন্য এই ড্রাগ হল একটি “আদর্শ” দাওয়াই।
২০১৪ সালে, আই এস গ্রুপ আলেপ্পোর ক্যাপ্টাগন প্রস্তুতকারক ফারমাসিউটিকল প্লান্ট দখল করে নেয় যার ফলে এখন তারা সমস্ত মিডল ইস্টেই এই ড্রাগ বিক্রি করছে। এরফলে তারা অনেক অর্থ তো পাচ্ছেই সেই সাথে অনেক আই এস জঙ্গি এবং সিরিয়ান সিভিল ওয়ারের ফাইটাররা এই ড্রাগ ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে। বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে এসেছে যে তারা ক্যাপ্টাগন ব্যবহার করছে। গত নভেম্বর মাসে ১৯ বছর বয়সী একজন আই এস মিলিট্যান্ট ফাইটার সিএনএনকে জানায়- “তারা আমাদেরকে ড্রাগ ও হেলুসিনেটিং পিল দিয়েছিল। এগুলো যদি আপনি খান তাহলে জীবন মরণের কথা না ভেবেই আপনি যুদ্ধে চলে যাবেন”।
তুরস্ক থেকে এক জঙ্গিকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে সরকার। ওই তরুণ দেশের একজন বিশিষ্ট শিল্পপতির নাতি। তার কথা শুনে মনে হয়েছে সেও এই ড্রাগ নেওয়া ছেলে। এমন ড্রাগ নেওয়াদের দিয়েই জঙ্গী বা মাদক পাচারের, মাফিয়াদের কাজ করান হয়। তাদের হাতে থাকতে পারে ক্লোন করা আপনারই ফোন। তাই একটু সাবধান হতে দোষের কী!শুধু নজরদারী ছাড়াও আইনকে যুগোপযোগী করা এখন খুব জরুরী। অপরাধ দমনে অপরাধীদের সাথে পাল্লা দিয়েই আইন বদলাতে হবে, আমাদের সব সেক্টরেই। এটা এখন সময়ের দাবী, উন্নয়নের দাবি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)