বিজেপির দীর্ঘ ও সফল প্রচার কর্মসূচির শেষে গত ১৭ মে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দলের সভাপতি অমিত শাহ তার পাশে বসা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চলমান নির্বাচনে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, ৩০০-র বেশি আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসবে বিজেপি।
এরপর বুথ ফেরত নানা সমীক্ষায়ও বলা হচ্ছিল, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির বিজেপিই ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু বিরোধী পক্ষ এসবকে পাত্তা দেয়নি। তারা নিজের পক্ষে বাজি ধরেছে, বলেছে, ২৩ মে চূড়ান্ত ফল ঘোষণায় নরেন্দ্র মোদির ভরাডুবি হবে। কিন্তু দেখা গেল, ২৩ মে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর আশাবাদ এবং বুথ ফেরত-জরিপের তথ্যই ঠিক হলো। ভোট গণনার পর দেখা গেল, কংগ্রেস সভাপতি ও গান্ধী পরিবারের প্রতিনিধি রাহুল গান্ধীর পরিবর্তে ‘চৌকিদার’ মোদিতেই ভরসা খুঁজেছেন ভারতের প্রায় ৯০ কোটি ভোটার।
এটা ঠিক যে, ভারতের সার্বিক অর্থনীতির দুরবস্থা, বিশাল দৃশ্যমান বেকারত্ব এবং কৃষিখাতে নানা সমস্যা নাগরিকদের একাংশের মধ্যে মোদি-বিরোধী ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এসব দেখে খুব সম্ভবত বিরোধীদের মনে প্রত্যাশার জন্ম নিয়েছিল। যদিও ভোটের ফলাফলে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। এটা সম্ভবত প্রতিপক্ষের পরাজয়-কামনা করে সনাতন ধারার রাজনৈতিক ব্যাখার একটা দিক।
বিরোধীদের কুপোকাৎ করে নিজেদের বিপুল বিজয়ের পেছনে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। রাজনীতিতে আগ্রহী পাঠকদের সামনে মোদির এই সাফল্যের এই নেপথ্য কারণগুলো তুলে ধরা হলো। প্রথমত, গত কয়েক বছরে বিজেপির পক্ষে একটি দুর্দান্ত সুসংগঠিত নতুন ভোট ব্যাংক সৃষ্টি করা হয়েছে। একটি নতুন, হিন্দু-জাতীয়তাবাদ ও বর্ণভিত্তিক ভোট ব্যাংক গড়ে উঠেছে। এটি উচ্চবর্ণের মানুষদের নিয়ে গঠিত। ১৮৮৯ সাল থেকে এই শ্রেণির সমর্থন বিজেপির প্রতি ক্রমাগত কমছিল, যদিও তারা সব সময়ই বিভক্ত ছিল। কিছু ব্রাহ্মণ কংগ্রেসকে স্মৃতিকাতর (নস্টালজিক) হয়ে ভোট দিয়েছেন। ঠাকুর সম্প্রদায়ের কিছু নেতা দেশের প্রাণকেন্দ্র, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে কিছু ভোট দিয়েছেন। জনসংঘ/বিজেপি সর্বদা উচ্চ বর্ণকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে, যদিও একমাত্র বাণিয়া সম্প্রদায়ই তাদের পক্ষে ছিল। এজন্যই ইন্দিরা গান্ধী তাদেরকে “বাণিয়া পার্টি” বলে অভিহিত করেছেন, কখনো হিন্দু দল নয়।
বর্তমানে মোদির পেছনে উচ্চ বর্ণের সবাই সমবেত হয়েছে। তারা মোদির বিজেপিতে শুধু হিন্দুত্বের কারণে নয়, বরং তারা “মেধা”র নিরিখে দেখে যে, বিজেপিকে সংখ্যালঘুরা ভয় পায় এবং “কম মেধাবী” নিম্ন বর্ণের মানুষেরা বিজেপির নীতিতে ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পিছিয়ে পড়ছে। এই নতুন ভোট ব্যাংকটি সুসংগঠিত। তারা মনে করে, মুসলমানরা বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেয়। এসব কারণে ভারতে উচ্চবর্ণের ভোটারদের মধ্যে বিজেপির একচেটিয়া সমর্থন। এর ফলে মোদি মুসলমান এবং যাদবের মতো অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণে এতটা উৎসাহী। ভারতে সর্বশেষ বর্ণভিত্তিক জনজরিপ হয় ১৯৩১ সালে, তখন উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সংখ্যা ছিল ২২-২৫%, যা ভারতে বৃহত্তম একক ভোট ব্যাংক। এরা সংখ্যায় মুসলিম, দলিত বা অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণির চেয়ে বড়।
দ্বিতীয়ত, কারণটি হচ্ছে কার্যকর ক্ষুদ্র অর্থনীতির সঙ্গে তাৎক্ষণিক সমৃদ্ধ অর্থনীতির উদ্দীপনা। দলের প্রচারণা শেষ হওয়ার পর বিজেপির সংবাদ সম্মেলন শেষে অমিত শাহ দাবি করেন যে, তার দলের সরকার পরিকল্পনার শেষ বিন্দুতে পৌঁছেছে। তিনি সঠিক। দেখা গেল যে, টয়লেট, রান্নার গ্যাস সংযোগ (ঔজ্জ্বল্য), আবাসন (প্রধানমন্ত্রী আবাস পরিকল্পনা), মুদ্রা এবং গ্রামীণ বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এমন প্রকল্প, যার সুবিধা প্রাপকদের কাছে পৌঁছেছে। এগুলো নিখুঁত নয়, অবশ্যই। টয়লেটে প্রায়ই পানি কম থাকে, রান্নার গ্যাস সংযোগ গ্রহণকারীদের অনেকে সেগুলো পুনরায় ভর্তি করাতে পারেনি এবং মুদ্রা ঋণগুলি সবসময় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেনি। কিন্তু সারা দেশে এই সেবাগুলো মানুষের মধ্যে পৌঁছেছে। কৃষকদের সরাসরি ভর্তুকি সুবিধার প্রথম কিস্তি প্রদান করা হয়েছে। সত্যিই দরিদ্র এবং বঞ্চিতদের জন্য এটি একটি বড় পরিবর্তন।
দৃশ্যমান এবং বাস্তব এমন কিছু সুবিধা অনেক মানুষের হাতে পৌঁছেছে কোনো রকম ঘুষ-দুর্নীতি ছাড়া। মোট ৪ কোটি ৮১ লাখ মানুষ ২ লাখ টাকা করে ঋণ সুবিধা পেয়েছে। এই প্রকল্পগুলি দ্রুত সময়ে অনেক বেশি লোককে স্পর্শ করেছে। তারা জিডিপি বোঝে না, জিডিপির হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাও নেই। সংগঠিত কাজের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে তারা এখনও খুব দরিদ্র। সরকারের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক কিছু জিনিস হাতে পেয়ে তারা সরকারের আপনজনে পরিণত হয়েছে।
তৃতীয়ত, ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ) কিছু পরিত্যক্ত নির্মাণ-কাজ সফলভাবে শেষ করেছে। হাইওয়ে, বন্দর, মহানগর, সেতু, অন্যান্য শহুরে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য মোদি সরকারের অনেক ভালো রেকর্ড রয়েছে এবং এটি সাদা চোখেই দেখা যায়। তারা আগের সরকারের অনেক উচ্চাভিলাষী প্রকল্পও বাস্তায়ন করেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে মুম্বাইয়ের বড় অবকাঠামো প্রকল্প। উত্তর-দক্ষিণ মেট্রো, ট্রান্স-হারবার লিঙ্ক, নতুন মুম্বাই বিমানবন্দর এবং উপকূলীয় সড়কটিও আগের সরকারের আমলে গ্রহণ করা হয়। দেশের অন্যতম বড় ল্যান্ডমার্ক সেতু তৈরি হয়েছে আসামে। বিজেপি কেবল চলমান প্রকল্পগুলোর নিশান উড়িয়ে দিয়েছে, ব্যাটনটি তুলে নিয়েছে এবং প্রকল্পগুলির সঙ্গে দৌড়েছে। নিজেদের যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
চতুর্থত, ২২ বছরের কম বয়সীদের কাছে মোদি নিজেকে ‘আরাধ্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারীরা এই লোকসভা নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোটার হয়ে উঠেছিল। ধনী বা দরিদ্র নির্বিশেষে এরা সবাই আধুনিক যন্ত্রপ্রযুক্তির সন্তান। তারা শুধু একজন নেতাকেই দেখেছে, কেবল একজনেরই বার্তা শুনেছে, গুগল-পূর্ব কোনো প্রেক্ষাপট তাদের জানা নেই। গুগলে তাদের কোনো উল্লেখও নেই। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই চাকরির বাজারে বাইরে রয়েছে। তারা মোদির জন্য একটি অভূতপূর্ব সমর্থন বেস বা ভিত্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা মোদির আত্মপ্রচারের স্টাইল, আগ্রাসন, বিদেশি নেতাদের সঙ্গে কোলাকুলির ধরন এবং “মোদি-পরবর্তী (এমনকি আগের) মহাপ্লাবনের’ ধারণাটি আয়ত্ত করতে চেয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তারা পারিবারিক বনেদিপনার ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছে। বিজেপির বিকল্প হিসেবে তারা রাহুল গান্ধীর নাম উল্লেখ করে সময় নষ্ট করেনি। কিন্তু তারা এই প্রশ্ন করেছে যে, রাহুল এখন পর্যন্ত এমন কী করেছে, তার অভিজ্ঞতাই বা কী? ভারতীয় সাংবাদিকদের মতে, এবার ভারতের বহু রাজ্যের মানুষের কাছে প্রায়শই যে লাইনটি শোনা গেছে তা হলো: রাহুলকে আরও কিছু সময়ের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, কিছু অভিজ্ঞতা পেতে হবে। মোদি স্বনির্ভর এবং অভিজ্ঞ, কেন তার বিকল্পের সন্ধান করব?
মোদি পাকিস্তানে বিমান হামলার সাহস রাখেন এবং তিনি তা করেছেন – এটা ভারতের অধিকাংশ ভোটারই মনে করেছেন। এমনকি যারা টেলিভিশন সংবাদ দেখেনি, তারাও পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক যুদ্ধের কথা শুনেছিল এবং বিশ্বাস করেছিল যে সশস্ত্র বাহিনী শত্রু অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল এবং পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়েছিল। অনেকের কাছে মোদি হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় নিরাপত্তার প্রতীক। তিনি পাকিস্তানে বিমান আক্রমণ করেছেন এবং একথা বুক ফুলিয়ে বলেছেন-এটা সাধারণ ভারতবাসীর কাছে বিশাল বীরত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা মোদি জিতেছেন নিজের ক্যারিশিমা দেখিয়ে, দলের সুচিন্তিত পরিকল্পনায়, রাষ্ট্রীয় মেশিনারিজকে অত্যন্ত সুন্দর ও সূক্ষ্মভাবে ব্যবহার করে। তিনি এবং তার দল হিন্দু জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে সুকৌশলে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু – এই দুই শিবিরে দেশকে বিভক্ত করেছেন। তারপর এর ফায়দা ঘরে তুলেছেন। ফায়দা তোলার জন্য কখনও ‘গরুমাতা’র আশ্রয় নিয়েছেন। কখনও যুদ্ধবাজ হিসেবে নিজেকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
তা ছাড়া ভারতবর্ষের মানুষ এখন শাসকদের কাছ থেকে হরে-দরে নগদ নারায়ণ খোঁজে। কার চেয়ে কে ভালো, কে গরীব-মেহনতি মানুষের স্বার্থের ঝাণ্ডা তুলে আদর্শের রাজনীতি করে, কে ধর্মনিরপেক্ষ-এসব তলিয়ে দেখার যুগ এখন আর নেই। এখন সমাজে বাম-ডানের মধ্যে আপাত চারিত্রিক পার্থক্যও খুব স্পষ্ট নয়। রাজনীতিকরা একটু মিথ্যে বলবে, নিজের পাতে ঝোল টানবে, কিছু চুরি-চামারি করবে, এগুলোকে মানুষ মেনেই নিয়েছে। এর মধ্যে কে কাজের লোক, কে পাশে থাকে, কিছুটা হলেও কাজ করে, কার ছাতার তলে থাকলে আখেরে বেশি লাভ-এসবই মানুষ বেশি বিবেচনা করে। সেই দিক থেকে মোদির বিজেপি অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে ছিল। আর এর সুফল তারা পেয়েছে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)