দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচিত মেয়রেরা দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। কারাগার আর উচ্চ আদালতেই কেটে যাচ্ছে তাদের মেয়াদকাল। কারাগারে যাচ্ছেন তারা, জামিন নিচ্ছেন আর সরকার একের পর এক তাদেরকে বরখাস্ত করছে, তারাও ফিরে আসছেন। জামিন শেষে এসে দেখেন তাদের মেয়রের চেয়ার নাই, এরপর ফি-বার উচ্চ আদালত, সেখানে থেকে মেয়রের চেয়ার ফিরে পাচ্ছেন আইনি প্রক্রিয়ায়।
এটা যেন এক মিউজিক্যাল চেয়ার, ঘুরছে ত ঘুরছেই!
২০১৩ সালের সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর গত চার বছরে বরিশাল বাদে বাকি সিটি মেয়র এবং হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়রকে মোট ১২ বার সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বরখাস্তের চিঠিটি নিশ্চিতভাবেই আইনি দোহাইয়ে পরিপূর্ণ, যেকোনো ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এ আইনের দোহাই দিয়ে একের পর এক বরখাস্ত হয়ে চলেছেন নির্বাচিত মেয়রেরা। এবং এরপর ওই আইনি প্রক্রিয়াতেই তারা ফিরে এসেছেন, বসেছেন মেয়রের চেয়ারে। কিন্তু তাদের এ বসাটাও নির্বিঘ্ন হচ্ছে না, নতুন কোন বরখাস্তের খড়গ ঝুলছে মাথায়; কারণ তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে, হচ্ছে, অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে আর মন্ত্রণালয়ের বরখাস্তের চিঠি আসছে।
বিভিন্ন মিডিয়ার খবর, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এমএ মান্নানের বিরুদ্ধে ত্রিশটির মত মামলা। এত মামলা মাথায় নিয়ে এ পর্যন্ত তিনি ৩ বার বরখাস্ত হয়েছেন। বরখাস্তের খুব অল্প সময়ের মধ্যে অথবা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওই সিটিতে প্রতিবার আওয়ামী লীগের একজন কাউন্সিলর ভারপ্রাপ্ত মেয়র হয়েছেন। মেয়াদকালের অধিকাংশ সময়ে নির্বাচিত মেয়র থেকেছেন কারাগারে, আর আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর বসেছেন মেয়রের চেয়ারে ভারপ্রাপ্ত নামে। স্বভাবত প্রশ্ন জাগে তাহলে কী দরকার নির্বাচনের, নির্বাচিত মেয়রের; যেখানে মেয়রের বরখাস্তের চিঠি আসার সাথে সাথেই ভারপ্রাপ্ত মেয়র প্রস্তুত থাকেন!
গাজীপুর সিটির মেয়রের পরিণতি এবং ভারপ্রাপ্ত মেয়রের এমন কাহিনী উল্লেখ কেবল উদাহরণের জন্যে। বাকি সিটিগুলোতেও মেয়রের অবর্তমানে কখনও ভারপ্রাপ্ত মেয়র, কখনও প্যানেল মেয়র আবার কখনও কাউন্সিলরদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণ প্রধান প্রকৌশলী ক্ষমতার অধিকারি হয়েছেন। এমন অবস্থায় স্বাভাবিক প্রশ্ন তাহলে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ পদের কি কোন প্রয়োজন আছে? দরকার কোনো নির্বাচনের? খোদ সরকারই যেখানে স্থানীয় সরকারের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে!
অনেকেই হয়ত আপত্তি করে বলবেন সরকার ধ্বংস করে দিতে চাইবে কেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী হলে সরকারেরই ত লাভ। হ্যাঁ, সরকারের লাভ; কিন্তু এ লাভের চাইতে বড় হয়ে যেখানে দেখা দিচ্ছে সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে লাভালাভের হিসাবটাই বৃথা। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দেওয়ার মিশনে নামা দলীয় সিদ্ধান্ত সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কারণে এমনটাই ঘটছে। অথচ রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রম আলাদা থাকার কথা ছিল।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিকে পর্যবেক্ষণ করলে বলা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে বিভিন্নভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার মিশনে নেমেছে। এক্ষেত্রে তারা কাগুজে বিরোধিদলের জন্মও দিয়েছে। জাতীয় পার্টি সংসদে থাকা কাগুজে বিরোধি দল, কিন্তু ভোট ও মাঠের রাজনীতিতে দলটির প্রভাব উল্লেখের মত নয়। এক দশকের মত সরকারের বাইরে থাকার পরেও বিএনপিই এখন পর্যন্ত একমাত্র সরকারবিরোধি শক্তিশালি রাজনৈতিক শক্তি। তাদের কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দেশবান্ধব আদর্শ না থাকলেও আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি হিসেবে ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব এখনও অক্ষুণ্ণ। নির্বাচনে অংশ নিয়ে কোন বাস্তবসম্মত কর্মসূচি উপস্থাপন ও প্রচার-প্রচারণা চালাতে না পারলেও দলটি এখনও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষমতা রাখে।
দেশের অধিকাংশ সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি দলীয় মেয়রেরাই নির্বাচিত। ঢাকা (উত্তর), ঢাকা (দক্ষিণ), চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, গাজীপুর ও খুলনার মধ্যে কেবল ঢাকার দুই অংশ, চট্টগ্রাম, রংপুর ও নারায়ণগঞ্জে সরকারদলীয় নেতারা মেয়র পদে আছেন। এক বরিশালের মেয়র বাদে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা মেয়রেরা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন নি। মেয়াদের বেশিরভাগ সময়েই তারা কারাগারে কাটিয়েছেন।
- স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মামলার অভিযোগপত্রে নাম আসায় মেয়রদের বরখাস্ত করছে, ওখানে হয়ত আইনি যুক্তি আছে; কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে আইনি ব্যাখ্যার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তারা পায় নি। মেয়রগণ দায়িত্বে থাকলে তারা জনগণের সকল দাবি পূরণ করতে পারতেন তা না, কিন্তু অন্তত সরকারকে দোষারোপের কোন সুযোগ থাকত না। কারাগারের বাইরে অর্থাৎ দায়িত্বে থাকা মেয়রগণ নাগরিক চাহিদা পূরণ করেছেন এমন না, তবে নাগরিকের চাওয়ার জায়গা ছিল। এখানে তারা অন্তত আঙুল উঁচিয়ে কাউকে সফল-ব্যর্থ হিসেবে মূল্যায়ন করতে পারছে। বিপরীতে যারা মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েও মেয়াদকালের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন তাদের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে জনগণের মাথাব্যথা নেই; উলটো আছে পাবলিক সিম্পেথি, আর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলেও সরকারের প্রতি অভিযোগ। এই পাবলিক সিম্পেথিই তাদের আগামি নির্বাচনি বৈতরণি পার করতে যে সহায়ক হবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে?
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের ইতিহাস খুব পুরনো নয়। গণতন্ত্র এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় নি- এটা সাধারণ অভিযোগ। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকিকরণের প্রাথমিক পর্যায় যদি প্রান্তিক পর্যায়ে গণতন্ত্রের বিকাশকে দিয়ে শুরু করা হয় তবে এক্ষেত্রে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তৃণমূলে ভিত মজবুত হয় গণতন্ত্র, অথচ তৃণমূল থেকে আমরা গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠাচ্ছি কীনা- এনিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসেছে।
একটা সময়ে অধিকাংশ নাগরিক মনে করত সরকারবিরোধি দলের কেউ কোনো পর্যায়ে নির্বাচিত হলে উন্নয়নের সুযোগ নাই, অথবা কম; এখন অধিকাংশ নাগরিকের মধ্যে এ বিশ্বাস জন্মেছে যে সরকারবিরোধি দলের কেউ নির্বাচিত হলে তাকে পদ থেকে বরখাস্ত করা হবে! এটা আমাদের গণতন্ত্রের বিকাশের পথে যে বড় এক বাধা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অদ্য আওয়ামী লীগ বিএনপি দলীয় মেয়রদের বরখাস্ত করছে; আগামিতে তারা কখনও সরকারের বাইরে গেলে যে এর শিকার হবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে? আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে সরকারিদল আওয়ামী লীগ এনিয়ে যে ভাবছে তা দৃশ্যমান হচ্ছে না।
বরখাস্তের চিঠিতে মন্ত্রীতে সাক্ষর করেন না, আমলারা করে থাকেন; কিন্তু সিদ্ধান্ত যা আসে তার দায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। আরও একটা বিশদ করে বললে এর মূল দায় গিয়ে পড়ে সরকারের ওপর। দেশে রাজনৈতিক সরকার বর্তমান, এবং সকল সিদ্ধান্তের দায় ও দায়িত্ব কোনোভাবেই সরকার এড়াতে পারে না। ধারণা করি, আওয়ামী লীগ নিজেরাও জানে তাদেরকে স্বাভাবিক নিয়মেই হয়ত একদিন ক্ষমতার বাইরে যেতে হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা কেন বিষয়টিকে আমলে নিচ্ছে না, কেন ভাবছে না আজ বরখাস্তের যে খড়গ বিএনপি দলীয় নেতাদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে কাল তাদের ওপর দিয়েও যেতে পারে!
জনগণ যখন ভাবতে শুরু করেছে কেবল বিএনপি দলীয় রাজনীতির কারণে দেশের বেশিরভাগ মেয়রদের দায়িত্ব পালন করতে দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ সরকার, তখন দলটি কেন ভাবছে না এটা তাদের রাজনৈতিক পরাজয় ও প্রতিহিংসা চরিতার্থের রূপক হয়ে ওঠেছে। অথচ এ দলটিই বাংলাদেশ স্বাধীন করা থেকে শুরু করে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। গণতন্ত্রের জন্যে যাদের প্রতিষ্ঠা ও আজীবন সংগ্রাম তারা কেন এক্ষেত্রে গণতন্ত্র হন্তারকের ভূমিকায় নামবে?
দেশের বেশিরভাগ মহানগরের মেয়রেরা যখন দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাচ্ছেন না তখন শোনা যাচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামি বছরের এপ্রিলের মধ্যে ছয় সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ধারণা করা হচ্ছে ওই নির্বাচনে বিএনপিও অংশ নেবে। ওই নির্বাচনগুলো যদি সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয় তখন যে ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত সিলেট, বরিশাল, খুলনা, ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন এবং একই বছরের ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফলের মত যে হবে না সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। ওই মহানগরগুলোর মেয়রদের মধ্যে বিএনপি নেতা হয়েও কেবল বরিশালের মেয়র দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন, বাকিরা নির্বিঘ্নে পারেন নি।
আগামি সিটি নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে তার বছরখানেকের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। বেশিরভাগ সিটিতে ফের যদি বিএনপির কাছে ধাক্কা খায় আওয়ামী লীগ তার প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বেই।
২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পরেও কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় নি বিএনপি। দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসে বর্তমানে সহায়ক সরকারের দাবি করছে। তবে ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে সহায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হলেও বিএনপি নির্বাচনে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় সিটি মেয়রদের দায়িত্ব পালন করতে না দেওয়া বিষয়ক প্রচারণা ভোটের মাঠে নির্ণায়ক হয়ে উঠতেও পারে। এটা সরকারি দল আওয়ামী লীগের জন্যে যে শুভকর হবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে সহ্য করতে পারছে না- এটা তাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযোগ। একের পর এক মেয়রকে বরখাস্ত করে তাদেরকে দায়িত্ব পালন করতে না দেওয়া জনগণের ম্যাণ্ডেটকে অস্বীকার করা, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকিকরণে বাধা দেওয়া- এমন অভিযোগও জোরালো হয়ে ওঠেছে। ভোটের মাঠে এটা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
আর মাত্র কয়েক মাস, এরপর সিটি নির্বাচন; এমন অবস্থায়ও আওয়ামী লীগ সরকার যদি নির্বাচিত মেয়রদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয় তাহলে সেটা হবে দুঃখজনক। এখানে আইনি দোহাইয়ের সুযোগ নাই, খোদ যেখানে মন্ত্রিসভার সদস্যদের কেউ শপথভঙ্গজনিত উচ্চ আদালতের রায়ে অভিযুক্ত আর নিম্ন আদালত কর্তৃক শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েও দায়িত্বপালন করতে পারেন।
চাইলেই সম্ভব যদি নিজের দলের নেতাদের প্রতি উদার মানসিকতা হয়, তাহলে অন্য দলের ক্ষেত্রে কেন নয়!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)