রাশিয়া বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর নতুনদের নিয়ে দল সাজিয়ে কোপায় সাফল্য আনার আশায় আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসি দলে ফেরায় আশার কলসি আরো বেশি ভারী হয়েছে। কিন্তু ফুটবল দুনিয়ায় তাদের সেই আশা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি! বিশ্বকাপ বিপর্যয়ের আট মাস পর জাতীয় দলে প্রত্যাবর্তন হয় মেসির। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মাঠ ওয়ান্ডা মেট্রোপলিটানোতে এলএমটেন পা রাখার মাত্র ছয় মিনিট না যেতেই আর্জেন্টাইন গোলকিপার ফ্রাঙ্কো আরমানিকে পরাস্ত করেন ভেনেজুয়েলার স্ট্রাইকার সালোমন রন্ডন।
বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার দলে থাকার পরও ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ৩-১ গোলের হার বুঝিয়ে দিয়েছে ব্রাজিলে কোপা আমেরিকার আসর শুরু হওয়ার আগে কত কাজ করতে হবে আর্জেন্টিনাকে। মেসির জায়গা নিয়ে হয়তো কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্ত বার্সেলোনার উইজার্ডের পেছনে, আর্জেন্টিনার সম্ভাব্য লাইনআপে এমন কোন পজিশনটা আছে, যেটা নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়?
এমন অনিশ্চয়তার কারণে এরইমধ্যে উপরমহল থেকে দল নিয়ে ফিল্টারিং শুরু হয়েছে। নিজের কোচ এবং ১৯৭৮ বিশ্বকাপজয়ী লিজেন্ড সিজার মেনোত্তির মতো বর্তমান কোচ লিওনেল স্কোলানিও হয়তো সামনের টুর্নামেন্ট নিয়ে খুব একটা আশা করতে পারছেন না।
দায়িত্ব নিয়ে দলে বেশকিছু নতুন মুখ যোগ করেন স্কোলানি। যার জন্য বাহবাহও পেয়েছেন। কিন্তু কৌশলগত বিষয়গুলোতে তার অনভিজ্ঞতা অত্যন্ত ভয়ানক, যা ভেনেজুয়েলা মাচের আগে কমই উন্মুক্ত ছিল। এটা এমনকি ২০১৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের সময়ের চেয়ে খারাপ। তিন ডিফেন্ডার ব্যবহারের কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া তার পছন্দের ব্যাকলাইনেরও কোনো চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না।
ভেনেজুয়েলার কাছে হার ও মরক্কো ম্যাচের আগে স্কোলানি বলেছেন, ‘সব দায় আমি নিচ্ছি, কিন্তু এর জন্য ভবিষ্যতে খেসারত দিতে হবে। এটা এমন একটা খেলা যেখানে আপনি হারতে পারেন। তবে তাদের ইতিবাচক জিনিস আনতে হবে।’
সেই ইতিবাচক জিনিসটা কী তা ব্যাখ্যা করেননি স্কোলানি। এটা অন্তত বলা যায় যে, সাম্প্রতিক দুটি প্রীতি ম্যাচে আর্জেন্টিনার জন্য ইতিবাচক জিনিসের আস্তরণ খুবই পাতলা ছিল।
আর্জেন্টিনা দল নিয়ে একটি মূল্যবান মতামত দিয়েছেন দেশটির অনূর্ধ্ব-২০ দলের কোচ হুম্বারতো গ্রন্দোনা। আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশনের দীর্ঘদিনের সভাপতি জুলিও গ্রন্দোনার ছেলে বলেছেন, ‘মেসি সঙ্গে থাকলে আমরা একটি প্রতিযোগিতামূলক জাতীয় দল হতে পারি, তাকে ছাড়া আমরা শুধুই অন্য একটা দল, সেটা দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির।’
স্কোলানি একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘ফলাফল কখনো মিথ্যা বলে না।’ আসলেও তাই, দায়িত্ব নেয়ার পর কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনার সম্ভাব্য তিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ম্যাচ খেলেছে স্কোলানির দল। কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা ও ব্রাজিলের বিপক্ষে খেলা তিন ম্যাচের একটিতেও জিতে পারেনি তারা। এরমধ্যে দুটি হার ও একটিতে ড্র। এক গোল দেয়ার বিপরীতে খেয়েছে চার গোল।
ভেনেজুয়েলা-মরক্কো ম্যাচের আগে স্কোলানির অধীনে আর্জেন্টিনা জিতেছে গুয়েতেমালা, ইরাকের বিপক্ষে। তার আগে কোচহীন ম্যাচে মেক্সিকোর বিপক্ষে জিতেছিল আলবিসেলেস্তারা।
কোচ বলেছেন, কোপা আমেরিকা স্কোয়াডের ৮০% খেলোয়াড় নিশ্চিত। কিন্তু ১৫ জুন সালভাদরে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে দলের এক নম্বর জার্সিটা (গোলকিপার) গায়ে তুলবেন কে? ডিফেন্সেই বা কারা খেলবেন? কৌশল ও কর্মীরদের (খেলোয়াড়) পরিপ্রেক্ষিতে তার পছন্দের সেটআপটা কি? তিনি কীভাবে প্রথম পছন্দের মিডফিল্ড জুটি লেন্ড্রো প্যারেডেজ এবং লো সেলসোর ধাঁধা সমাধান করবেন? যারা বর্তমানে না চাপ নিতে পারছেন, না সৃজনশীল কিছু করতে পারছেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, মেসির ফরোয়ার্ড পার্টনার কে সেটা এখনো আজানা। ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে গোল পেলেও মরক্কো ম্যাচে নিষ্ঠুর হতাশার মধ্যে ফেলেছেন লোতারো মার্টিনেজ। তারপরও সার্জিও আগুয়েরোর বিকল্প হিসেবে এই ইন্টার মিলান তারকাই আছেন। কারণ, ইন্টারে মার্টিনেজের সতীর্থ মাউরো ইকার্দি জাতীয় দলের জার্সিতে নিজেকে রাঙানোর সামর্থ্য এখনো দেখাতে পারেননি।
পাওলো দিবালার প্রতিভা থাকলেও যোগ্যতা এখনো অনিশ্চয়তার আরেকটি বিষয়। জুভেন্টাস তারকা আর্জেন্টিনাকে আরো একটি ম্যাচে অকার্যকরভাবে হতাশ করেছেন, মরোক্কো ম্যাচে সুযোগ পেয়ে সফল হতে ব্যর্থ এবং অভিষেকের চার বছর পরও এই স্তরে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন, সেই সঙ্গে সবাইকে বিস্মিতও করছেন।
২০১৫ সাল থেকে আর্জেন্টিনা দলে যতজন কোচ এসেছেন, প্রায় প্রত্যেকে কোচই বলে আসছেন, দিবালা ও মেসি কখনো দলে এক হয়ে খেলতে পারবেন না। তবে আশার কথা এটুকুই যে, স্কোলানি দেখিয়েছেন সেই সূক্ষ্ম কাজ সমাধান করার একজন মিস্ত্রি তিনি।
গত একদশক আর্জেন্টিনা ফুটবলের একটা সাধারণ অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ট্রফি জিততে হলে মেসি একা যথেষ্ট নয়।
আর্জেন্টিনার একজন শক্তিশালী মানুষের প্রয়োজন, যে খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাদের সতীর্থদের ভালোভাবে একবাক্সে বন্দি করতে পারবেন এবং একইসঙ্গে তার হাতে লাঠি থাকবে, যিনি প্রয়োজনে লাঠিচার্জও করবেন। সবশেষ দুটি ম্যাচ একটা বড় প্রমাণ, যেখানে মেসি উপস্থিত ছিলেন, আবার ছিলেন না। ফলে তারা কোপা আমেরিকা পর্যন্ত (ট্রফি জেতা) যেতে চাইলে ‘অস্থিতিশীল’ এই দলকে একটা ‘অলৌকিক’ কাজ করতে হবে।
সাউথ আমেরিকান ফুটবল লেখক ড্যানিয়েল এডওয়ার্ডসের লেখা অবলম্বনে