মেডিকেলে ছাত্রজীবনে প্রথম পেশাগত পরীক্ষায় আমাদের যেসব ক্লাশমেট কোনো বিষয়ে অচমকা ফেল করে বসতো, তারা যেনো হুট করেই কক্ষচ্যুত গ্রহের মতো হয়ে যেতো। যারা পাস করেছে তারা থার্ড ইয়ারের ক্লাশে যেতো, ওয়ার্ডে যেতো রুগী দেখতে, ক্লিনিক্যাল ক্লাশে যোগ দিতে।
ভাগ্য আর দৈবচক্রে ফেল করা বন্ধুদের এ অধিকার ছিলো না। তারা রুমে বসে থাকতো, পাশের লতিফের চায়ের দোকানে চা গিলতো। হাসপাতাল আর ক্লাশরুম তাদের জন্য নিষিদ্ধ বস্তু, যতোদিন বা বছরে সে ফেল করা বিষয়টা পাশ করে ফাঁড়া কাটাতে না পারতো।
আমার পাশের রুমমেট, যার আমার চেয়ে বেশি মার্কস পাবার কথা ছিলো সে করেছিলো ফেল, আর আমি পাস করে ফেলায় আমার গলায় ঝুলতে লাগলো নতুন কেনা স্টেথোসকোপ ও ব্লাড প্রেসার মেশিন ।
মেডিকেলের পাস ফেল এমনই দৈবচয়নে ভরা যা আবার পরীক্ষকদের মন-মর্জি নির্ভর। অকৃতকার্যরা অনেকেই আর মূল স্রোতে ফিরতে পারে নি। অনেককে বিষন্নতা পেয়ে বসেছিলো, যা থেকে কারো কারো বহু বছরেও আর মুক্তি মেলেনি।
আমরা ভাবতাম, তাদের যুগপৎ থার্ড ইয়ারে ক্লাশ ও ফেল করা বিষয়ে পরীক্ষা দেবার সুযোগ দিলে কি হয়? এতে তারা উৎরে যাবার সুযোগ পেতো, অভিশপ্ত বিচ্ছিন্নতাবোধ আর পেয়ে বসতো না।
আর পাস করা আমরাও আতঙ্কে থাকতাম। কেননা পরের পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে ফেল করে বসলে আমাদেরও একই দশা হবে। এক মাঘে যেমন শীত যায় না তেমনি এক পেশাগত পরীক্ষা পাস হলেই কেউ পার পেয়ে যায় না।
তারপর দিন যায় মাস যায়। আমি ততোদিনে ডাক্তার হয়ে গেছি। কিছু বন্ধু সেই প্রথম ফেলের দুষ্ট চক্র থেকে বের হয়ে আর আমাদের ছুতে পারেনি।
যাই হোক, সভ্যতার চাকা সামনের দিকে এগোয়। তারই সাথে একদিন আমরা আনন্দের সাথে লক্ষ্য করি যে, মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থার সেই তারুণ্যবিনাশী ও সময়সংহারী পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছেন আমাদের শিক্ষাবিদেরা।
ফল হিসেবে ‘ক্যারি অন’ পদ্ধতি চালু হলো। অর্থ্যাৎ, কেউ ফেল করে বসলে সে তার ইয়ারমেটদের সাথে ক্লাশ-ওয়ার্ড সবই করতে পারবে। একই সাথে ফেল করা বিষয়টাও পরীক্ষা দিয়ে ক্লিয়ার করতে হবে।
স্বস্তির সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাসও কাজ করতো । ইস আমাদের সময় যদি এ ‘ক্যারি অন’ সিষ্টেমটা থাকতো! তা হলে অনেক বন্ধুর জীবন অন্যরকম হতে পারতো। এমন বেঘোরে তাদের জীবন থেকে মাস আর বছরগুলো নষ্ট হয়ে যেতো না।
আমাদের সময় ক্যারি অন না থাকায় যেখানে এমবিবিএস পাস করতে গড়ে সাত-আট বছর সময় লাগতো, ‘ক্যারি অন’ হবার পর ঠিক ঠিক পাঁচ বছরেই সবাই ডাক্তার হয়ে যেতে লাগলো। ব্যাপারটা আমার এবং আমাদের দৃষ্টিতে একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার ছিলো । সময় যতো প্রগসর হবে, পদ্ধতি ততো সংশোধিত ও বাস্তবধর্মী হবে; তাই বঞ্চিত হলেও এটা মেনে নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ ছিলো না।
মনে পড়ে, ‘ক্যারি অন’ না থাকায় ফেল করে বছর হারানোর ভয়ে আমরা প্রায়ই পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করতাম এবং সফলও হতাম। ‘ক্যারি অন’ আসায় ওই ভূত অটোম্যাটিক্যালি বিদায় নিলো।
কিন্তু, এ অভাগা জাতির কপালে ‘ভালো’ বেশিদিন সয় না। আমরা সভ্যতার হাত ধরে সামনে হাঁটার চেয়ে প্রায়ই ভূতের পা ধরে পেছনে ধাবিত হতে পছন্দ করি। একটা লোভী স্বার্থপর চক্র নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য জাতির সামগ্রিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে তিলমাত্র পিছ পা হয় না।
যেসব কথিত শিক্ষাবিদের বিশ্বের সাথে তাল মেলানো আরো যুগোপযোগী একটা কারিকুলাম সৃষ্টির মুরোদ নাই, তারা কি করলেন? তারা একটা নতুন কিছু ‘করো;র নামে ‘ক্যারি অন’ সিষ্টেমটাই বাতিল করে দিলো। ফিরে গেলেন সেই বিগত শতাব্দীতে।
ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের মতো আমাদেরও প্রশ্ন: কেনো বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের পেছনের নিগড়ে ঠেলে দেয়া হবে? ‘ক্যারি অন’পদ্ধতির সমস্যাটা কোথায়?
এসব প্রশ্নের কোনো জবাব যখন পাচ্ছিলাম না, একজন জানালেন: সবকিছু যেমন বাণিজ্যের দখলে গেছে, ‘ক্যারি অন’ বাতিলের পেছনেও কাজ করেছে বাণিজ্যবুদ্ধি।
প্রাইভেট মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘসময় ছাত্র হিসাবে আটকে রাখার মোক্ষম মওকা হলো এই ‘ক্যারি অন’ বাতিল। ডাক্তার হবার আগে যতো দীর্ঘ ছাত্রজীবন ততো বেশি ফি আদায়; এটাই নাকি মূল দর্শন। অনিবার্যভাবেই সরকারি-বেসরকারি সব মেডিকেল স্টুডেন্টকেই এ অন্যায়ের কুফল ভোগ করে যেতে হবে।
মেডিকেল কারিকুলামকে যেনো খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন। এ পদ্ধতি বাতিল প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত শিক্ষাবিদদের শকুন ছাড়া আর কিছু ভাবা কঠিন। তারুণ্যের এ সময়টার এমন অপচয়! ভাবা যায়?
‘ক্যারি অন’ সিষ্টেম বাতিলের প্রতিবাদে প্রতিটা মিছিলে মনে রেখো: আমরাও আছি ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)