এরশাদ আমলের ঘটনা। হাজী মুহম্মদ মুহসিন হলের আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটি হেলিকপ্টার। সশস্ত্র এক ছাত্রের এতে ভারী রাগ হয়ে গেল। মহাপতঙ্গের দিকে এক রাউন্ড গুলি করে ওই ছাত্র তার রাগ মিটিয়ে ছিলেন বলে জানা যায়। এ মজার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি নই, কারণ তখন আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, মায়ের হাত ধরে হয়ত বাড়ির উঠোনে হাঁটছিলাম।
উল্লেখিত ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইদের কাছে শোনা। চাকুরী সূত্রে এখন আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক; কিন্তু লেখাপড়া আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। নানা কারণে এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি। এ কারণগুলোর অধিকাংশই আবার অকারণ। হলের ফটক, ফুটপাত, রোড ডিভাইডার, হাকিম কিংবা মিলন চত্বরের চা, বিভাগের শিক্ষক কিংবা সাংবাদিক সমিতির অফিস, কখন যে কোনটা কারণ হয়ে যায়, আগে থেকে বলা মুশকিল। রাজনৈতিক কারণে ঢাবি ক্যাম্পাসের অনুকূল পরিবেশে আসা-যাওয়াটা প্রতিদিন না হলেও নিয়মিত।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা মহলে আলোচনায় এসেছে মেট্রোরেল সংক্রান্ত বিষয়ে। ছাত্রলীগ করা এক ছোটভাই রাজু ভাস্কর্যের ঠিক পাশ দিয়ে মেট্রোরেল যাচ্ছে এমন ছবি দিয়ে ফেসবুকে প্রতিবাদী ছবি দিলে আমিও ক্ষুদ্ধ হয়ে মন্তব্য লিখেছি। পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ফেসবুকের ওই ছবিতে যেমন রাজু ভাস্কর্যকে ভেঙ্গে পড়ে পড়ে অবস্থায় দেখানো হয়েছে নির্মাণ কাজে তা আসলে হবে না।
গ্রামের মানুষ হলেও বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত শহরে যাওয়ার, থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, জেনেভা, স্টকহোম, কোপেনহেগেন, রোম, পিটার্সবুর্গ, কুয়ালালামপুর, পার্থ, দুবাই ইত্যাদি শহরের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নিজের চোখে দেখেছি; ব্যবহার করেছি। আর মর্মে মর্মে অনুধাবন করেছি, আমাদের যাদুর শহর ঢাকায় আমূল পরিবর্তন দরকার। ইতিহাসের অস্ত যাওয়া সূর্য কোলকাতায়ও এ পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো।
যতগুলো শহরের নাম বললাম তাদের প্রায় সবটাতেই গণপরিবহনের প্রাণ হচ্ছে রেল। এই রেলগাড়ির আবার রকমফের রয়েছে। কোনোটা শহরের আশপাশ ও অভ্যন্তরকে সচল রাখে; কিছু রেলগাড়ি পুরো দেশের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ নিশ্চিত করে। ম্যানহাটান থেকে ব্রংস এ গিয়ে গ্রামের এক বড় ভাইয়ের বাসায় কই মাছ, গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে ৪২তম সড়কে গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে ফিরে আসতে আমার এবং একজন এসএসএফ কর্মকর্তার সময় লেগেছিল সব মিলিয়ে দেড় ঘণ্টা। আরেক সফরে টোকিও থেকে হিরোশিমায় গিয়েছিলাম ৪ ঘণ্টায়। ১২০০ কিলোমিটার ভ্রমণ করেছি অনায়াসে। ট্রেন কীরকম আরাম আর দ্রুত গতির হতে পারে তা শিনকানসেনে (বুলেট ট্রেনে) না উঠলে বোঝা যাবে না।
জগতের সমস্ত আধুনিকতা আর আরাম নিয়ে যেন এ ট্রেনগুলো তৈরি করা হয়েছে। স্মোকিং রুম, টয়লেট, শাওয়ার রুম, এক কম্পার্টমেন্ট থেকে আরেক কম্পার্টমেন্টে যাওয়ার অটোম্যাটিক সেন্সিং ডোর দীর্ঘভ্রমণে যাত্রীর পুরো খাতির করার সব বন্দোবস্ত আছে এসব ট্রেনে। ম্যানহাটানে গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলের নিচেই সাবওয়ে জংশন। মাটির নিচে কবর ছাড়াও যে কীরকম স্থাপনা হতে পারে, তার উদাহরণ এই সেন্ট্রাল স্টেশন। কয়েক তলা বিশিষ্ট এ স্টেশনের বিভিন্ন রুটের ট্রেন ধরতে লম্বা লম্বা এসকেলেটর ব্যবহার করতে হয়। মিনিটে মিনিটে ট্রেন আসছে, যাচ্ছে।
নানা চেহারের, সৌন্দর্য্যরে শত শত মানুষ ট্রেনে উঠছে, নামছে। ট্রেন থেকে নামলেই টাইম স্কায়ার, বাংলাদেশী অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটস, চায়না টাউন। যাকেই ফোন করি বলে, সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট অপেক্ষা করো, আসছি। চিন্তা করে দেখুন, ঢাকায় কি এটা সম্ভব! উত্তরা থেকে কেউ আধাঘণ্টায় বাসে করে মতিঝিল আসতে পারবেন? শাহবাগ থেকে ফার্মগেট যেতেই প্রায় ৪০/৪৫ মিনিট সময় লাগে। মাঝে মাঝে ভাবি, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতারা, ১৪ ডিসেম্বরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলীরা বেঁচে থাকলে হয়তো ঢাকা আগেই উন্নত শহরে পরিণত হত।
ঢাকার জনসংখ্যা আর তিনটা ভারতের সমান অস্ট্রোলিয়ার জনসংখ্যা প্রায় একই সাইজের। এ বিশাল সংখ্যক মানুষের সুপরিবহন নিশ্চিত করতে হলে রেল ব্যবস্থা ছাড়া উপায় আছে কি? ঢাকা শহরের আয়তন আমি হিসাব করি ক্যান্টনমেন্টগুলোকে বাদ দিয়ে; কারণ ক্যান্টনমেন্টেগুলোর প্রশ্ন, খালি রাস্তায় আমাদের পরম বন্ধু লোকাল বাসগুলোর প্রবেশাধিকার নেই। কেউ যদি আমায় বলে, উন্নত শহর দেখতে কেমন হয়? আমি বলি, কোনভাবে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে ঘুরে আস; বিদেশ যেতে হবে না। ঢাকার সাধারণ মানুষ বাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘেমে গলদর্ঘম হয়ে, দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিদিন যে কষ্ট করে তার যৎকিঞ্চিৎও এই সাজানো গোছানো ক্যান্টনমেন্টগুলো শেয়ার করতে চাইতো না। সুমতি হওয়ায় ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে অনুমতি দিয়েছিল, তার সুফল সাধারণ মানুষ ভোগ করছে।
ক্যান্টনমেন্টের মত জায়গার উপর দিয়ে যদি ফ্লাইওভার হতে পারে তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে মেট্রোরেল হতে পারবে না? এমন যদি হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত জাতীয় কোনো স্থাপনা ভেঙ্গে সেখানে মেট্রো রেলের কোনো কিছু নির্মাণ করা হচ্ছে, তাহলে সবার আগে আমরাই জান কোরবান করতাম। যতটুকু জানি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ দিয়ে বাংলা একাডেমি হয়ে রেললাইন চলে যাবে, তাও উপর দিয়ে। দোয়েল চত্বরের ওখানে একটা স্টেশন হবে।
যাদের প্রত্যক্ষ, বাস্তব জ্ঞান আছে, তাদের খুশিতে গদগদ হওয়ার কথা যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে মেট্রোরেল লাইন যাবে এবং এখানে একটা স্টপেজ হবে। যতদিন আমি হলে থাকতাম, ততদিন ক্যাম্পাসের বাইরের মানুষগুলোকে ঠিক আমার মত মানুষ মনে করতাম না। ঢাকার কষ্ট আমি বুঝতাম না। হলে থেকে, খেয়ে, ঘুমিয়ে ঢাকার কষ্ট বোঝা যাবে না। বাংলাদেশের রেললাইনগুলো কোন না কোন গ্রামের, জনপদের, মসজিদ কিংবা মন্দিরের পাশ দিয়ে গেছে। ইমাম কিংবা পুরোহিত যদি বলে- রেলগাড়ির শব্দে উপাসনায় অসুবিধা হয়, তাহলে কি রেল চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে?
জয় বাংলা স্লোগানেও অনেক পড়ুয়া ছাত্রের মনোযোগ নষ্ট হয়, তাহলে কি জয় বাংলা স্লোগান হবে না? মেট্রোরেলবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার একজন তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, “দোয়েল চত্বর ও তিন নেতার মাজার সংলগ্ন একটি স্টপেজ হবে। এতে পুরাতন ঢাকাবাসী এ স্টপেজটি ব্যবহার করবে। ফলে ভাসমান দোকান, সিএনজি স্টেশন, রিক্সা স্ট্যান্ড, টেম্পু বা হিউম্যান হলার এর জন্য স্ট্যান্ড তৈরি হবে এবং গুলিস্তান বাজারে পরিণত হবে।”
যিনি এই কথাগুলো লিখেছেন, আমি তাকে দোষ দিই না। কারণ সম্ভবত তিনি এখানো ছাত্র; হলে থাকেন; কষ্ট হবে এ চিন্তায় নীলক্ষেত পার নিউমার্কেটে যেতেই হয়ত ভয় পান। তিনি কি ইদানিং গাবতলী দেখেছেন? গাবতলী গিয়ে দেখে আসেন, পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে।
আর মেট্রোরেল এমনই এক ব্যস্ত প্রযুক্তি যাকে ঘিরে ভাসমান দোকান, মাস্তান, টেম্পো, হিউম্যান হলার থাকার প্রশ্নই উঠে না। যাই হোক, সাধারাণ ছাত্রদের বলব, বিদেশে গিয়ে রেললাইন কোথায় কোথায় যায় দেখে আসার। যেহেতু সুযোগ নেই, ইন্টারনেটের আশ্রয় নিয়ে ঘুরে আসুন।
সাধারণ ছাত্ররা ঠিকই বুঝবে; বুঝবে না কিছু রাজনৈতিক দলের ছেলেমেয়েরা। ‘বুঝবে না’ না বলে বলা উচিত বুঝতে চাইবে না। এদের দেখে দেখে আমার একটা ধারণ বদ্ধমূল হয়েছে: যে মানুষগুলো উন্নয়নকে ভয় পায়; হয়ত উন্নয়ন তাদের বুলিগুলিকে মানুষের সামনে দুর্বল করে দেয়, তাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)