সুন্দর সুশোভিত দেশ ভুটান। পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গুছানো শহর। শান্ত আর সুসভ্য এখানকার নাগরিক। গহীন জঙ্গলে ছাওয়া পাহাড়। দূষণহীন নদী। ঝিরিঝিরি বাতাস অন্তর মাতিয়ে রাখে। পাহাড়ের আড়ালে মেঘের লুকোচুরি। সাথে সুর্যালোকের লুকোচুরিতে তন্ময় হয়ে থাকতে হবে। প্রাকৃতিক এমন সৌন্দর্যের অবগাহন কেবল ভুটানেই সম্ভব।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভুটান ভারতীয় উপমহাদেশে হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত। দেশটির উত্তরে চীনের তিব্বত অঞ্চল এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত।
এখানকার পাহাড়ী পথে পথে চোখে পড়বে ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ও রানী জেতসুন পেমার ছবি। এমনকি ব্যক্তিগত যে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী, তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেও টানানো রাজা-রানীর ছবি। কারণটাও অদ্ভুত। ভুটানিজরা মনে করেন, একরাজা, একদেশ। আর কোনো নেতাকে তারা চিনতেও চান না, জানতেও চান না।
মূলত ভুটান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘ভূ-উত্থান’ থেকে যার অর্থ ‘উঁচু ভূমি’। জিএনএইচ বা গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস হচ্ছে ভুটান সরকারের দেশ পরিচালনার মূল মন্ত্র। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় সকল মানুষকে সুখী রাখা।
পাহাড়ী জনপদের কারণে ভুটানের মানুষগুলো বেশ কর্মঠ। মাত্র আট লাখ নাগরিক বাস করেন ভুটানে। লোকসংখ্যা কম হওয়ায় রাস্তাঘাটে যানজট নেই বললেই চলে। সকলের মুখে হাসি লেগেই থাকে।
ভুটানে দেখার মতো অনেক সুন্দর সুন্দর স্থান রয়েছে। ফুন্টশোলিংয়ের চিড়িয়াখানা, তোর্সা নদী, চেইন জ্যাম আর চুখা নদী। দেখে নিতে পারেন পটেটো ফ্যাক্টরি আর একটি বৌদ্ধ মন্দিরও।
ফুন্টশেলিং ঘুরতে বেশী সময় লাগে না। অর্ধদিবসই যথেষ্ট। রাতে থাকতে পারেন এখানেই। এখানে একটি সিনেমা হলও আছে। চাইলে পরিচিত হতে পারেন এখানকার চলচ্চিত্র জগতের সাথেও। আছে বেশ কিছু পাইকারী ও খুচরা দোকানও। প্রয়োজনীয় জিনিস পাবেন সেসব দোকানগুলোতে।
এরপর যেতে পারেন ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে। ভুটানের সব থেকে আকর্ষণীয় এবং নান্দনিক সৌন্দর্যের স্থান হল থিম্পু। এই স্থানটি দেশের সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র। এখানে আছে সিমতোখা জং। এটি ১৬২৭ সালে তৈরি থিম্পু ভ্যালির গেটওয়ে। এখানে আছে রিগনে স্কুল ফর জঙ্ঘা অ্যান্ড মোনাস্টিক স্টাডিজ। এছাড়াও ফ্রেশকো এবং স্টেট কার্ভিংস এ অঞ্চলের বিশেষ আকর্ষণ। রয়েছে রাজধানী থিম্পুর প্রাণ থিম্পু জং। এটি তৈরি হয় ১৬৬১ সালে। দ্য ন্যাশনাল এসেম্বলি, রাজার থ্রোন রুম, সরকারি ডিপার্টমেন্ট এবং সেন্ট্রাল মোনাস্টিক বডির গ্রীষ্মকালীন হেডকোয়ার্টার্সও এখানেই।
ভুটানের তৃতীয় রাজা জিগমে দরজি ওয়াঙ চুকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৭৪ সালে মেমোরিয়াল কর্টেন নামে এই স্তূপ তৈরি হয়েছিল। এই কর্টেন মূলত একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এর ভেতরে অনেক ধরনের পেইন্টিং এবং স্ট্যাচু রয়েছে, যা বৌদ্ধ দর্শনের প্রতিবিম্ব। এখানেই দেখতে পাবেন বুদাপয়েন্ট। বৌদ্ধের বিশাল এক মুর্তি রয়েছে এখানে। সাথে রয়েছে আরো অনেক দেব দেবী। ছোট এই শহরেই চোখে পড়বে সার্ক হল, এফবিসিসিআই ভবনসহ সব প্রয়োজনীয় অফিস আর আদালত। থিম্পুতে আরও রয়েছে হ্যান্ডিক্রাফট এম্পোরিয়াম, ট্র্যাডিশনাল মেডিকেল ইন্সটিটিউট এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামও।
থিম্পু থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পুনাখা শহর। এখান থেকে হিমালয়কেও দেখতে পারবেন আপনি। ভুটানের সব থেকে উর্বর ভ্যালি এই পুনাখা। পুনাখা জং, ফো ছু এবং মো ছু নদীও দেখতে পাবেন পুনাখায়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভুটানের রয়েছে অজস্র দর্শনীয় স্থান। ছোট শহর পারো তাদের মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে বসন্তে পারোর রূপ হয়ে উঠে এক কথায় অসাধারণ। এখানে রয়েছে পারো জং, ন্যাশনাল মিউজিয়াম। এ অঞ্চলের সব থেকে বড় আকর্ষণ টাইগার্স নেস্ট।
বুমথাংকে বলা হয় ভুটানের আধ্যাত্মিক হৃদয়ভূমি। কারণ, ভুটানের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ জং মন্দির এবং মহল এই অঞ্চলে অবস্থিত। আরও দেখা যাবে, ওয়াংগডিচোলিং প্যালেস, জাম্বে লাখাং মন্দির, সব থেকে বড় ভুটানিজ মন্দির জাকার এবং হট স্প্রিং এরিয়া। এই এলাকায় বন্টু শিপ, মাস্ক ডিয়ার, হিমালয়ান ভাল্লুক চোখে পড়তে পারে। সব বুমথাংয়ে একমাত্র জাকারেই ভালো রেস্তোরাঁ পাবেন।
ভারত-ভুটানের বর্ডার ওপেন তাই তাদের ভিসা লাগে না। ভিসা লাগেনা ভুটানের, তবে এন্ট্রি পারমিট নিতে হয় অবশ্যই, ওটাই ভিসা।
এখানে বলে রাখা ভালো এয়ারপোর্টে অন এ্যরাইভাল যে ভিসা দেয় তা শুধু ভুটানের তিনটি শহর ফুন্টশোলিং, থিম্পু আর পারো’র জন্য। অন্য জায়গায় যেতে হলে তার জন্য আলাদা করে ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে ভিসা নিতে হয়।
ভারত এবং বাংলাদেশিদের জন্য ভুটানে ঢুকতে কোনো টাকা লাগেনা। পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকদেরকে প্রতিদিনের জন্য ২০০ ডলার করে ফি দেয়া লাগে ভুটান সরকারকে।
নিজেরা গেলে খরচ অনেক কম পড়বে। প্লেনে যাওয়াই ভালো, যাওয়া-আসার ভাড়া ট্যাক্সসহ ১৬,৫০০ টাকা ড্রুক এয়ারে। ভুটানের মুদ্রার নাম নিউলট্রাম, সংক্ষেপে একে নিউ বলে। ফুন্টশেলিংয়ে ৮০০-১২০০ নিউলট্রামে হোটেলে ঝকঝকে ডাবল রুম পাবেন। অর্থাৎ মাথাপিছু খরচ পড়বে ৪০০-৫০০ নিউ। খাওয়ার খরচ আপনার ওপর। রুপি আর নিউলট্রামের ভ্যালু একই। রুপিও চলে পুরো ভুটানেই।
খরচ কমাতে চাইলে বাসে যেতে পারেন। রাস্তা খুব ভালো। ইন্ডিয়ার ভিসা নিতে হবে শুধু, ট্রানজিট ভিসা। ক্রেডিট কার্ড না থাকলে পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করতে হবে ব্যাংক থেকে, ইন্ডিয়ার ভিসার এ্যাপ্লিকেশনের জন্য। বুড়িমারি-চেংরাবান্ধা বর্ডার থেকে ডলার ভাঙিয়ে রুপি করে নিতে পারবেন। ভুটানে ইন্ডিয়ান রুপি ওদের নিজস্ব মুদ্রার মতোই চলে, একই মান।
এখানেই আপনাকে অন অ্যারাইভাল ভিসা দিয়ে দেবে। সাথে এক কপি ছবি ও পাসপোর্টের ফটোকপি রাখবেন।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
১. ট্রানজিট ভিসার জন্য আবেদন করুন।
২. অনলাইন ফরম পূরণ করার পর এর প্রিন্ট কপি।
৩. পাসপোর্ট (ছয়মাস মেয়াদ থাকতে হবে)
৪. NID ফটোকপি
৫. যে বাসায় থাকেন, তার বিদ্যুৎ বা গ্যাস বিলের ফটোকপি
৬. চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে NOC Letter মূল কপি পরিচয়পত্রের ফটোকপি।
৭. ডলার এনডোর্স সার্টিফিকেট
৮. পাসপোর্ট এর প্রথম দুই পেজের ফটোকপি
৯. এক কপি বাড়তি ছবি (ভারতের জন্য ২ ইঞ্চি বাই ২ ইঞ্চি)
১০. বাসের আসা-যাওয়ার টিকেট।
শ্যামলী, বিআরটিসি, এসআর-এর এসি বাস পাবেন বুড়িমারি পর্যন্ত। রাতে রওনা হলে সকালে গিয়ে পৌঁছাবেন। বুড়িমারি নিরাপদ। ঐদিনই ভারত-ভুটান সীমান্ত জয়গাঁও গিয়ে ভুটানে ঢুকে যেতে পারেন।
ঢাকা থেকে বুড়িমারী আসা-যাওয়া টিকেট সাড়ে ৮০০ থেকে ১৫০০ পর্যন্ত উঠানামা করে। বাসের সুপারভাইজারকে পাসপোর্ট দিয়ে দেবেন। তিনি সেটা নিয়ে ব্যাংকে জমা দিয়ে দেবেন বুড়িমারীতে। ৫০ টাকা সার্ভিস চার্জ নেবে। ওরা সীমান্তের সব কাজে হেল্প করে। এমনকি ওই পারেও। বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পুলিশ কোনো রিসিট ছাড়া আসা ও যাওয়ার সময় প্রতিবার ১০০ টাকা নেবে, যদি আপনার সবকিছু ঠিক থাকে। না থাকলে আরও বেশি। চ্যাংড়াবান্ধা থেকে জয়গাঁও ট্যাক্সিতে জনপ্রতি ৩০০-৩৫০ রুপি। বাসে গেলে ময়নাগুড়ি থেকে জয়গাঁও, অর্ধেকের কম খরচ। জয়গাঁও ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে ভুটান গেইট দিয়ে ফুন্টশোলিং হেঁটে ঢুকতে হবে, কোনো খরচ নাই। সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ হাজার রুপীতে আপনি অনায়াসেই ঘুরে আসতে পারেন ভুটান।