এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ণ করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা পালাই পালাই ভাব। কিন্তু কোথাও পালানো হয় না। চাইলেও এ শহর ছেড়ে যাওয়া হয় না। আসলে আলসেমির কারণে চেনা ছকের বাইরে কোথাও যেতেও ইচ্ছে করে না। তারপরও বেশ কিছু দিন ধরেই বুকের মধ্যে গুঞ্জরিত হতে থাকে, ‘দূরে কোথায়……. দূরে….. দূরে…’।
সব বন্ধন ছিন্ন করে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার জন্য মনটা ভীষণভাবে আইঢাই করছিল। আর বুকের মধ্যে যখন কোনো কিছু চেপে বসে, সেটা থেকে পরিত্রাণ না পেলে স্বস্তিও মেলে না। আর এই স্বস্তির জন্যই যেখানে মেঘ আছে, যেখানে বৃষ্টি আছে, যেখানে পাহাড় আছে, আছে নদী-নালা, আছে জোছনা-জোনাকি, তেমন কোথাও যাওয়ার জন্য মন ছুটে যায়। ছুটে যাওয়া মনটাকে তো আর আটকে রাখা যায় না।
আকাশে জোছনা উঁকি মারতে দেখে মনে হলো ঘুরে আসা যাক ‘জোছনা ধরার কারিগর‘ হুমায়ূন আহমেদ-এর জন্মভূমিতে। তার লেখায় তো ফুটে ওঠেছে নেত্রকোনার মানুষের জীবনযাপন। তাতে সারল্য যেমন আছে, আছে গরলও। সেই মানুষদের কাছ থেকে দেখার একটা ইচ্ছে তো ছিলই। তাছাড়া নেত্রকোনারই কৃতী সন্তান ‘না প্রেমিক না বিপ্লবী ’ কবি নির্মলেন্দু গুণ আর প্রেমের কবি হেলাল হাফিজ। এই মাটিতে এমন কী জাদু আছে? যে কারণে এই কবিরা এমন সব কবিতা লিখেছেন, যা কবিতা অনুরাগীদের মুখে মুখে ফেরে। সেটাও অনুধাবন করতে চেয়েছি। সব মিলিয়ে না দেখা ভাটির দেশটির প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করতে থাকি। যদিও তাল পাকা এই গরমে কোথাও ঘুরতে যাওয়া সুবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত নয়। তারপরও সব পিছুটানকে উপেক্ষা করে ‘মন চলে যায় বন্ধুর দেশে’।
ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ যাওয়ার পর ভালোই হোঁচট খেতে হয়। বাস স্টেশন থেকে নির্বিকারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের গন্তব্য সুসং দুর্গাপুর অব্দি ইদানিং কোনো বাস চলাচল করে না। রাস্তার গতিক নাকি মোটেও সুবিধের নয়। যেতে হবে ভেঙে ভেঙে। বাধ্য হয়ে জারিয়া পর্যন্ত সিএনজি রিজার্ভ করতে হয়। কিছু দূর যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম, কত ধানে কত চাল। এ রাস্তায় চলাচলের জন্য অদম্য সাহস আর ফিজিক্যাল ফিটনেস যে গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার, সেটা আগে জানা ছিল না। ক্যাঙ্গারুর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে যেভাবে সিএনজি চলছিল, তাতে করে চালক মহাশয় একটু বেচঈন হলে যে কোনো অঘটনা ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। কখনও কখনও রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি কিনা সেটা নিয়ে বিভ্রম সৃষ্টি হয়। কোথাও ঢাউস ঢাউস গর্ত, কোথাও সংকীর্ণ পথ, কোথাও কোথাও বিমূর্ত চিত্রকলার মতো দুর্বোধ্য।
সেটা বুঝতে গেলে হকচকিয়ে যেতে হয়। অবশ্য দিগন্তবিস্তৃত সবুজ, রকমারি গাছগাছালি, রোয়ানো আমন ধান, খাল-বিল-হাওর-পুকুর, বর্ষার জমে থাকা টলটলে পানি, শাপলা-শালুক, মাছ ধরার সরঞ্জামাদি, ঘাস খাওয়ায় মগ্ন গরুর পাল, উড়ে উড়ে যাওয়া মেঘের ভেলা চোখের জন্য ছিল আরামদায়ক। আর ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা’ মনটাকে ক্ষণে ক্ষণে উদাস করে দিচ্ছিল।
ঘণ্টা দুয়েক অনেক লড়াই-সংগ্রাম করে পৌঁছাই কংস নদের তীরে। ঘেয়ে-নেয়ে একদম একাকার অবস্থা। শরীরটা যেন ঝরনা হয়ে যায়। ঘামের সঙ্গে বালুর সংমিশ্রণে শরীর চিটচিট করছিল। পুরো এলাকায় উড়তে থাকে বালু। কংসকে এখন আর নদী বলে মনে হয় না। একসময়ের খরস্রোতা নদটি ভরাট হতে হতে নাব্যতা সংকটে ভুগছে। পাহাড়ি ঢলের সাথে আসা বালি আর পলি পড়ে পড়ে নদীটি তার গতিপথ হারিয়ে ফেলেছে। জারিয়া-ঝানজাইল কংস নদে বাঁধ দিয়ে নদীর উপর সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। আগেকার বেইলি ব্রিজটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর এ কারণে এ পথে স্বাভাবিক চলাচল থমকে গেছে। বালি পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারও ভালো অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। এ নিয়ে কাউকে খুব একটা বিচলিত মনে হলো না।
নৌকায় কংস নদী পেরিয়ে ঝানজাইল বাজার যাওয়ার পর মনে হলো, যে পথটুকু পাড়ি দিয়ে এসেছি, সেটা তো ঢের ঢের ভালো ছিল। এখন দেখি, আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে মরণফাঁদ। সিএনজিতে ওঠার পর প্রতি মুহূর্তে ‘বিপথে’ যাওয়ার তীব্র হাতছানি। রাস্তাঘাট ভেঙে চুরে বেহাল। একটুখানি এদিক-সেদিক হলেই ছিটকে পড়তে হবে। বালু আর কাদার সঙ্গে রীতিমতো লড়াই আর সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে করতে এগিয়ে যেতে হয়। বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িকে সাইড দিতে গেলে হৃকম্পন শুরু হয়ে যায়। আর বৃষ্টির দিনে রাস্তাঘাটের হালত নাকি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। অথচ পথিমধ্যে স্থানীয় একজন আদিবাসী ভদ্রলোক জানালেন, একসময় তিনি নাকি প্রতিদিন দুর্গাপুর থেকে ঢাকায় অফিস করতেন। তার কথা শুনে বর্তমানে রাস্তাঘাটের হাল দেখে তার দিকে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। দুর্গাপুরে ঢোকার মুখে সোমেশ্বরী নদীর উপর নির্মিত ব্রিজটিও দাঁড়িয়ে আছে হুমকি হয়ে। যাহোক, সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে পৌঁছে যাই ‘দুর্গম গিরি কান্তার’ দুর্গাপুরে।
আগে থেকে নির্ধারিত জেলা পরিষদের বিবর্ণ ডাকবাংলায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেই। এ এলাকার প্রধান বাহন মূলত সিএনজি, অটোরিক্সা আর মটরসাইকেল। একটি অটোরিক্সার সঙ্গে রফা করে অচেনা নেত্রকোনার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি। চালকই আমাদের ফ্রেন্ড-ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। শুরুতেই নেত্রকোনা বুকের মধ্যে জাগিয়ে দেয় বিপ্লবের স্পন্দন। তেভাগা টঙ্ক নানকার আন্দোলনের স্মৃতিরক্ষা কমিটির উদ্যোগে ১৯৯৩ সালে নির্মাণ করা হয়েছে ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ। শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের নেতা ও স্থানীয় সন্তান কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে চল্লিশের দশকে এই আন্দোলন সংগঠিত ও পরিচালিত হয়। সেই আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছিল পূর্ব বাংলাকে। প্রতি বছর তার স্মরণে আয়োজন করা হয় মণি সিংহ মেলা। নির্জন স্মৃতিস্তম্ভের পাশের পুকুরে বিশ্রাম নেওয়া হাঁসগুলো বাড়িয়ে দেয় সৌন্দর্যের খানিকটা ছটা। ফুটবল খেলা যে এখনও গ্রামের মানুষের প্রিয়, সামনের মাঠে স্থানীয় যুবকদের খেলতে দেখে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না।
একসময় সুসং রাজ্যের রাজধানী ছিল দুর্গাপুর। দীর্ঘকাল এ এলাকা পর্যায়ক্রমে শাসন করেন সোমেশ্বর পাঠক ও তার বংশধররা। সেই স্মৃতি বহন করছে উপজেলা রোডের সুসং দুর্গাপুর মহারাজার সবুজ পরিবেষ্টিত দু’আনি বাড়ি। এই বাড়ি এখন ‘দ্য চাইল্ড প্রিপারেটরি স্কুল’। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইন পাস হওয়ার পর রাজবংশের সদস্যরা ভারতে চলে যান। তারা না থাকলেও তাদের নির্মিত বাড়িগুলো এখনও নজর কেড়ে নেয়। এত রঙদার বাড়ি সাধারণত দেখা যায় না। এই রঙ কি হাল আমলে করা? টিনের চালা দেওয়া বাড়ি হলেও এর সৌন্দর্য একটুও ম্লান হয় নি। চারপাশে গাছপালা আর ফুলের গাছ। দেওয়ালে টাঙানো হিন্দু দেব-দেবতাদের ছবি।
মেঘালয়-নেত্রকোনা সীমান্ত সংলগ্ন গোপালপুর এলাকা। যেতে হয় সোমেশ্বরী নদী পেরিয়ে। সবুজের বাগিচার মধ্যে দিয়ে কিছুটা পথ হাঁটতে হয়। পাশ দিয়ে পাহাড়ি ঝরনা থেকে নিঃসৃত জল নালি বেয়ে ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে। চীনা মাটির পাহাড় বেয়ে ওঠলেই দেখা যায় ভারতীয় সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়া। তা দেখার জন্য বিকেল হলে দলে দলে মানুষ ছুটে আসেন। এ এলাকায় গারো ও হাজং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আধিপত্য। তারা নিজেদের মতো করে বসবাস করছেন। অপ্রয়োজনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করেন বলে মনে হলো না। বিভিন্ন এনজিও এখানে বেশ সক্রিয়। আদিবাসী মেয়েরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্য দূর-দূরান্তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটে যায়। কেউ ছাতা মাথায় হেঁটে হেঁটে। আবার কেউ কেউ সাইকেল চালিয়ে। সবাই লক্ষ্যে অবিচল।
বিকেল বেলায় সোমেশ্বরী নদীর কাছাকাছি একটি গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে দেখতে পাওয়া যায় গ্রামীণ দৃশ্যপট। এক কিশোরীর নৌকা বেয়ে চলা, দুটি গরুর শক্তির লড়াই, ভাসান জাল দিয়ে মাছ ধরা, নিজস্ব কায়দায় শিশুকোলে আদিবাসী তরুণীর হেঁটে চলার চিরায়ত প্রতিচ্ছবি। যেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের তুলির আঁচড়ে ফুটে ওঠা জীবন্ত সব চিত্রকাব্য। সেইসঙ্গে দূরের পাহাড়ের হাতছানি। যদিও মৃদু মন্থরে সন্ধ্যা নেমে আসায় বেশি দূর যাওয়া হয় নি।
নেত্রকোনার আনন্দ ও গর্ব সোমেশ্বরী নদী। ভারতের মেঘালয়ের বৃষ্টি আর ঝরনাধারা থেকে এ নদীটির উৎপত্তি। এ নদীটি দু’হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে রেখেছে নেত্রকোনার অনেকখানি এলাকা। কোথাও কোথাও মিলেছে কংস নদের সঙ্গে। আটরাখালি ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে কিছুটা দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায় শীর্ণকায় নদীটির বয়ে যাওয়া। দেখা যায় অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভা। এ দৃশ্য দেখার জন্য ব্রিজে ভিড় বাড়তে থাকে। বৈকালীন আড্ডার জন্য জায়গাটি অনেকের কাছেই প্রিয়। তবে নদীটিতে পানির একদমই প্রবাহ নেই। শাওন মাসেই কেবল নদীটি ফিরে পায় তার যৌবনজোয়ার।
দুর্গাপুরের পরিচিত একটি স্থান বিরিশিরি। এখানে উপজাতীয় সংস্কৃতি চর্চার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি। আলো-আঁধারিতে এই একাডেমিতে যাই। কিন্তু রাতে এর কোনো কার্যক্রম ছিল না। ধবধবে জোছনায় বিরিশিরিকে মনে হতে থাকে মায়াপুরী।
একটু অন্ধকার হলেই জোছনায় মাখামাখি হয়ে যায় পুরো সুসং দুর্গাপুর। কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের মতো ‘আমি ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া/জোছনা ধরতে যাই/হাত ভর্তি চান্দের আলো/ধরতে গেলে নাই।’ জোছনায় অবগাহন করার জন্য রিক্সা নিয়ে ছুটে যাই সোমেশ্বরের কূলে আটরাখালি ব্রিজে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল চারপাশ। নদীর চরে ঝিকিয়ে ওঠছিল আলোকরশ্মি। কিন্তু মটর সাইকেলের হর্ন আর ক্ষণে ক্ষণে উটকো আলোর কারণে ধ্যানস্থ হয়ে জোছনার সৌন্দর্য উপভোগ করা যাচ্ছিল না। ফিরে আসি আমাদের আবাসস্থলে। ঈদগাহের পাশ দিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে চলে গেছে পিচঢালা অপ্রশস্ত পৌরসভা সড়ক। চারপাশ নির্জন। নিরিবিলি। নিঃশব্দ। মাথার উপর কেবল চাঁদের বাঁধ ভাঙা হাসি। ঝরনাধারার মতো সেই হাসিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে হৃদয়। রাস্তার পাশের ঝোঁপের আড়ালে দেখতে পাওয়া যায় জোনাকিও। মনের আনন্দে ছোটাছুটি করছে।
জোছনা আর জোনাকির মধ্যে দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো হেঁটে যেতে থাকি। কী যে মোহময়। কী যে মায়াময়। কী যে মুগ্ধকর। সঙ্গী সুধীর কৈবর্ত দাসের সুরেলা কণ্ঠে পরিবেশিত হতে থাকে একটির পর একটি মন কেমন করা গান। পরিবেশটি আরো বেশি মাদকতাময় হয়ে ওঠে। রাত যত গভীর হচ্ছিল, আমরা ততই যেন জোছনাগ্রস্ত হচ্ছিলাম। ছুটতে থাকি আলেয়ার পিছনে। কিন্তু অনেক দূর যাওয়ার পর আমাদের হুস হয়। আরে! আমরা তো অনেকটা পথ চলে এসেছি। অথচ এ পথ চিনি না। এর গন্তব্যও জানি না। এই শহরে আমরা নবাগত। এসেছি মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। এতটা ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হলো? এমন প্রশ্ন মনে উদয় হতেই বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হয়। তাতে অবশ্য খুব একটা আক্ষেপ ছিল না। আমরা যতটা পারি জোছনায় ভিজেছি। উপভোগ করেছি জোছনার সান্নিধ্য।
পরের দিন সকালে তেরী বাজার থেকে নৌকায় সোমেশ্বরী নদী পাড়ি দেই। এ সময় নদীটিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। স্রোতহীন নদী। বর্ষাকালে নদীটি ভরাট থাকলেও এরপর নদীটিতে টান পড়ে। তখন হারিয়ে যায় এর রূপ-রস-গন্ধ। নদী থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ভেসে আসা কয়লা, নুড়িপাথর ও বালি। কয়লা আর বালি এ এলাকার প্রধান সম্পদ হয়ে ওঠেছে। নদী পেরিয়ে অপর পাড়ের শিবগঞ্জ বাজারে যেতে হলে হাঁটু পানিতে নেমে পড়তে হয়। জুতা খুলে আর প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়ি ঝরনার স্বচ্ছ জলধারায়। তীব্র তাপদাহেও শীতল অনুভূতি হয়। জুড়িয়ে যায় মনপ্রাণ। মনে পড়ে যায় শৈশবে পড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী’ : ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি/দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি/চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা।’ বাস্তবিকই এই কবিতার সঙ্গে ভাদ্রের সোমেশ্বরী নদীর একটুও অমিল নেই।
শিবগঞ্জ বাজারে যেন আমাদের অপেক্ষায় মটরসাইকেল নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছেন। যাওয়া মাত্র আমাদের নিয়ে ছুটে চলার জন্য তর সইছে না। দরাদরি করে চেপে বসি মটরসাইকেলে। নেত্রকোনার অন্যতম আকর্ষণ সাদা মাটির পাহাড়। মেঠোপথ দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে আমাদের বাহন। দুর্গাপুর উপজেলা থেকে সাত কিলোমিটার দূরে বিজয়পুর গ্রামে ব্যতিক্রমধর্মী এই পাহাড়। যেন বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই একবুক দুঃখ নিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। নীরবে করে চলেছে অশ্রুপাত। এ অশ্রু থেকেই যেন সৃষ্টি হয়েছে জলাশয়ের। সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া শান্তশিষ্ট নীল পানির আধারটি মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। শীতকালে এই পানির রঙ হয়ে ওঠে নীলনয়না নারীর মতো। তখন নাকি একদমই চোখ ফেরানো যায় না। পাহাড়ে রয়েছে অনেক অবগুণ্ঠিত গুহা। রহস্যময়তার কারণে সেদিকে কেউ পা মাড়ান না। সাদা মাটি সিরামিক শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ কারণে এর চাহিদা অনেক। তাই কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই পাহাড় ও টিলা কেটে কেটে সংগ্রহ করা হয় এই মাটি। এমন কি মাটি কেটে নিয়ে অকারণেই রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্যের এই আকরখনি। মানা হচ্ছে না আদালতের নির্দেশনাও। যা কিছু অমূল্য সম্পদ, তা নিষ্ঠুরভাবে সংহার করার জন্য আমরা যেন মুখিয়ে থাকি।
বিজয়পুরে ঢোকার মুখে বহেড়াতলীতে স্থাপন করা হয়েছে টঙ্ক ও কৃষক আন্দোলনের নেত্রী হাজংমাতা শহীদ রাশিমণির স্মৃতিস্তম্ভ। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রতিরোধ আন্দোলনে সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন রাশিমণি ও তার সহযোদ্ধা সুরেন্দ্র হাজং। তাদের স্মরণে প্রতি বছর স্মৃতি সৌধ প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় রাশিমণি স্মৃতি মেলা। এ মেলায় ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকেও অনেকেই যোগ দেন।
মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কমলা পাহাড় নামে পরিচিত স্থানে শীতকালে কমলার ফলন হয়। উঁচু এই পাহাড়ে উঠতে বেশ ঘাম ঝরাতে হয়। পাহাড়ের উপর স্থাপন করা হয়েছে বড় একটি টাওয়ার। যত দূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। আর হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায় মেঘালয়ের আকাশ।
অনেকটা ভিতরের দিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়ে তোলা পাকা রাস্তা দিয়ে যেতে হয় রাণীখং ক্যাথলিক চার্চ। ঢোকার মুখে ডান পাশে রাণীখং উচ্চ বিদ্যালয় ও ডাকঘর। পাহাড়ের উপর ১৯১২ সালে গড়ে তোলা সাধু যোষেফের ধর্মপল্লীতে স্বাগত জানায় যিশু খ্রিস্টের ভাস্কর্য। তার কোলে একটি শিশু। চারপাশে ছড়ানো খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন স্থাপনা। আছে ধর্মপাল বিশপ হার্জ আর পাঁচ গারো হাজং আদিবাসীর ভাস্কর্য, কারুকার্যম-িত ক্যাথলিক গির্জা, সাধু যোষেফের ভাস্কর্য, মিশন পরিচালিত স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেল। গাছ-গাছালি আর ফুলের বাগান দিয়ে পুরো চত্বরটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে, তাতে এটি হয়ে ওঠেছে ভাস্কর্যের নন্দনকানন।
রোদে পুড়ে পাহাড়ের নির্জনতায় শান্তি কুটির বিশ্রামাগারে গিয়ে শরীর জুড়িয়ে যায়। সেইসঙ্গে চোখও। পেছনের গরাদে দিয়ে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় সৌন্দর্যের রাশি রাশি প্রাচুর্য। পাশ দিয়ে মন্থর গতিতে বয়ে চলেছে সোমেশ্বরী নদী। তাতে সারি সারি ডিঙি নৌকা। কয়লার সন্ধানে মগ্ন জীবিকাজীবীরা। ভারতীয় সীমানার দিকে তাকালে বুকের মধ্যে বেজে ওঠে কানন দেবীর গাওয়া কাজী নজরুল ইসলামের অমর সেই গান, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’। (ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল র্যাডক্লিফ একটু সদয় হলে কিছু পাহাড় হাতের নাগালেই পাওয়া যেত।) রৌদ্রকরোজ্বল আকাশের নিচে এক একটি মুহুর্ত যেন জলরঙে আঁকা দুর্লভ সব ছবি। একটুক্ষণের জন্যও চোখ সরাতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, পুরোটাই সাজিয়ে রাখি হৃদয়ের গ্যালারিতে। এমন সঞ্চয়ের জন্য এ স্থানে ফিরে ফিরে আসতে হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)