চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মৃৎশিল্পীর জীবন থেকে

কমলা রানী পাল মৃৎশিল্পী। পাহাড়পুরের পালপারা থেকে আসা এই শিল্পী প্রায় ২৫ বছর ধরে এই পেশায় নিয়োজিত। সম্প্রতি জাতীয় জাদুঘরে শুরু হওয়া পোড়ামাটির সামগ্রীর প্রদর্শনীতে নিজের স্টলে বসে ছোট্ট একটি মাটির হাতিতে নকশা করছিলেন তিনি। জানালেন ছোটবেলা থেকেই মাটির জিনিস তৈরিতে পারদর্শী তিনি। কারণ তার বাবা-মাও এই পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। জীবিকার তাগিদে ৪৯ বছর বয়সেও মৃৎশিল্পের কাজ করেন তিনি। তার বৃদ্ধ স্বামী এক সময়ে এই কাজ করতেন। কিন্তু বয়সের ভারে এখন আর সেই ক্ষমতা তার নেই। কমলা রানীর দুই ছেলে এবং তাদের স্ত্রীরা কেউ এই পেশার সাথে জড়িত না। ছেলেরা কিছু কারিগরি কাজ শিখে নিজেদের পেশায় স্বাবলম্বী। এই পেশায় আগ্রহ নেই ছেলের বৌদের। এমনকি মাটির হাড়িতে রাঁধতেও তারা পছন্দ করেনা। রান্নার জন্য তারা বেছে নেয় অ্যালুমিনিয়ামের হাড়ি আর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে প্লাস্টিকের পণ্য।

মাটি দিয়ে তৈরি নানা জিনিসপত্র

১০ ফেব্রুয়ারী থেকে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী কক্ষে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী পোড়ামাটিতে তৈরি সামগ্রীর মেলা ও প্রদর্শনী। ইউনেস্কোর রকফান্ড অ্যান্ড ট্রাস্টের পৃষ্ঠপোষকতায় এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদ। এই প্রদর্শনীতে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার সংলগ্ন দুটি গ্রাম মিঠাপুর ও জামালপুরের ২৬ জন মৃৎশিল্পীকে নিয়ে আসা হয়েছে। চিরাচরিত পদ্ধতিতে মৃৎপাত্র তৈরিতে অভ্যস্ত এই শিল্পীদের নিয়ে ৯ মাসের প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী একাধিক অনুশীলন কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এই কর্মশালায় তাঁদেরকে পাহাড়পুরের মৃৎফলকের রেপ্লিকা, টেপা পুতুল ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি শেখানো হয়। তাদের তৈরি এসব সামগ্রী প্রদর্শন এবং বিক্রি করা হচ্ছে।

প্রদর্শনীর গ্যালারীতে ঢুকতেই মাটির গন্ধ অনুভব করা যায়। সেখানে থরে থরে সাজানো আছে পোড়া মাটির হাড়ি, পিঠার পাতিল, তৈজসপত্র, ঘর সাজানোর পুতুল, মাটির ব্যাংক এবং আরো নানান জিনিসপত্র। সেই সঙ্গে কিছু পাটের ব্যাগও প্রদর্শন করা আছে। মৃৎশিল্পীরা তাদের স্টলে বসে কেউ নিজের হাতে তৈরি পুতুল রঙ করছেন, আবার কেউ কেউ ভেজা মাটি দিয়ে নকশা করে পুতুল তৈরি করছেন। প্রদর্শনীতে একটু সময় করে ঢুঁ মারতে পারলে শহুরে কৃত্রিমতা ভুলে গিয়ে গ্রামের সরলতা অনুভব করা যাবে। আর তার কারণ হলো সহজ সরল এই মৃৎশিল্পীরা নিজেরাই জানাবেন তাদের শিল্পের কথা, জীবনের কথা।

প্রদর্শনীর আরেকজন শিল্পী কার্তিক পাল এই পেশায় আছেন ছোটবেলা থেকে। তারও বাবা-মায়ের মাধ্যমেই এই পেশায় হাতেখড়ি। তিনি জানান, এই পেশায় তিনি নিজের সন্তানকে আনবেন না। তাই সন্তানকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। এই কষ্টের পেশার কোনো ভবিষ্যৎ দেখছেন না কার্তিক পাল। তাঁর মতে প্লাস্টিক এবং অ্যালুমিনিয়ামের এই যুগে মাটির জিনিসের কোনো কদর পাওয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, মৃৎশিল্পে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এই শিল্প হারিয়ে যাবে অচিরেই।

মাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করছেন মৃৎশিল্পী

প্রকল্পের দ্বায়িত্বে থাকা ইউনেস্কোর প্রতিনিধি কিযি তাহনিন জানান, এই শিল্পীদেরকে স্বাবলম্বী করে দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি শিল্পীদের সাথে মার্কেটের যোগাযোগ তৈরি করা। ইতিমধ্যে কিছু বড় প্রতিষ্ঠান শিল্পীদের থেকে নিয়মিত মৃৎ-পণ্য নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

 

কিযি তাহনিন বলেন, ‘আশার ব্যাপার হচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই শিল্পীদেরকে তাদের নিজ এলাকায় দোকান তৈরি করে দেবে, যাতে তাঁরা সেখানে নিজেদের তৈরি পণ্য স্বাচ্ছন্দ্যে বিক্রি করতে পারেন’।