ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আর নামকরা সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়েই বিগত কয়েকদিন ধরে চলছে আলোচনা, সমালোচনা। যাদের সন্তান সেখানে পড়াশোনা করেছেন বা যারা করছেন তাদের বাবা-মায়েরাও রয়েছেন এসব নিয়ে খুবই চিন্তায়। এবার এই বিষয় নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলেন প্রবাসী শিক্ষক আমিনুল ইসলাম।
নিজের ফেসবুক পেজে তিনি লিখেন, এক মা আমাকে ইনবক্স করেছেন। আমি তার মেসেজ’টা পুরোপুরি তুলে দিচ্ছি। তবে তিনি অনুরোধ করেছেন কোনো পরিচয় যেন আমার লেখায় তুলে ধরা না হয়, তাই কোনো নাম পরিচয় তুলে ধরছি না। তিনি আরও অনুরোধ করেছেন আমি যেন আমার ভাষায় তার মেসেজটা তুলে ধরি।
প্রিয় আমিনুল,
আপনাকে নাম ধরেই ডাকলাম, আপনি আমার সন্তানের বয়েসি হবেন। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম আপনাকে একটা বিষয় লিখবো। এতদিন আলসেমি করে লেখা হয়ে উঠেনি। তবে গুলশানের ঘটনার পর মনে হয়েছে ব্যাপারটা আপনাকে জানাই। ওই ঘটনার পর পত্রিকায় আপনার কিছু লেখা পড়ে মনে হয়েছে আপনাকে ব্যাপারটা জানানো যায়।
আমার ছেলে ঢাকার সব চাইতে নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর একটাতে পড়েছে। আমার অবশ্য ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানোর তেমন কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কিন্তু স্বামীর পরিবার মোটামুটি সচ্ছল। তাই ওর বাবা চেয়েছিলো ছেলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুক। আমি আর মানা করিনি।
তবে স্কুল পাশ করার পর আমি আর আমার ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে চাইনি। কারণ আমার একটাই সন্তান। আমি চেয়েছি ছেলে দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো সাবজেক্টে পড়ে দেশেই চাকরি করুক। ওর বাবাও রাজি হয়। ছেলেও পরীক্ষা দিয়ে দেশের নামকরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব চাইতে ভালো সাবজেক্টগুলোর একটিতেই ভর্তি হয়।
সমস্যার শুরু এখান থেকেই। আমার ছেলে কয়েকদিন ক্লাসে যাওয়ার পর বাসায় এসে বলতে থাকে- ‘আমার এই সব জায়গায় পড়তে ভালো লাগে না। ক্লাসমেট গুলো কেমন ক্ষ্যাত; স্যাররাও যেন কেমন!’
আমি ভেবেছিলাম হয়তো প্রথম প্রথম এমন লাগছে ওর। সময় গেলে ঠিক হয়ে যাবে। তিন চার মাস চলে যাওয়ার পরেও দেখি একই অবস্থা। একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে এসে বলল- ‘এইসব জায়গায় আমি পড়তে পারবো না। পরিবেশ ভালো না, ক্লাসের ছেলেপেলেদের কথাবার্তাও আমার পছন্দ হয় না; সব কিছু অন্য রকম লাগে। আমাকে হয় তোমরা বিদেশে পড়তে পাঠাও, নইলে নামকরা কোনো ইংলিশ মিডিয়াম প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে আমি ভর্তি হবো।’
আমরা শেষপর্যন্ত আমাদের একমাত্র সন্তানকে অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে পাঠিয়েছি। ও এখন সেখানেই পড়ছে। ও ভালোই আছে সেখানে। কোনো অভিযোগ নেই সেখানে যাওয়ার পর। তবে গুলশানের ঘটনার পর মনে হলো এই বিষয়টা আপনাকে জানাই। আপনি যেহেতু এইসব নিয়ে লেখালেখি করেন; আপনি হয়তো আপনার মতামত তুলে ধরতে পারবেন।
আমি উনার মেসেজ পড়ে এই লেখা লিখতে বসেছি। আমার ঠিক জানা নেই কি লেখা উচিত এই বিষয়ে। তবে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সে পড়তো, সেই স্কুলের বন্ধুবান্ধব, পরিবেশ আর যেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সে পরবর্তীতে ভর্তি হয়েছিলো সেটা হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এরপরে আমিনুল ইসলাম আরো লিখেন, এই লেখা লিখতে লিখতে এক বাবার সাথে স্কাইপে কথা হচ্ছিলো। সেই বাবা তার ছেলেকে মালয়েশিয়া পড়তে পাঠিয়েছেন। তার ছেলেও ঢাকার একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তো। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক। কিন্তু ছেলের অন্য বন্ধু বান্ধবরা সবাই বিদেশে পড়াশুনা করছে, ছেলে তাই দেশে আর পড়তে চায় না; বাধ্য হয়ে তিনিও তার ছেলেকে বিদেশে পড়তে পাঠিয়েছেন।
এমন তো হওয়া উচিত না। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থাকুক; সেখানে ভালো পড়াশুনাও হোক, কোনো সমস্যা নেই এতে। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ হতে হবে মূল ধারার বাংলাদেশের মানুষদের মতো। নইলে তো এরা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের সাথে মিশতে পারবে না।
সবশেষে আমিনুল ইসলাম লিখেন, এই সমস্যা এখনো খুব প্রকট হয়নি, কারণ দেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের জোয়ার শুরুই হয়েছে ১০ থেকে ১২ বছর আগে। এর আগ পর্যন্ত কয়েকটি নামি দামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থাকলেও তাদের ছাত্র সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু এখন তো এর সংখ্যা অনেক। ছাত্রের সংখ্যাও অনেক। আরও ৫/৭ বছর পরে বিশাল সংখ্যার এই ছাত্ররা যখন তাদের স্কুল শেষ করে দেশের মূলধারার মানুষের সাথে মিশতে যাবে তখন একটা সংঘাত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
এখনো সময় আছে এই সব শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নজর দিন। ইংরেজি মিডিয়াম থাকুক সমস্যা নেই; কিন্তু সেখানকার পরিবেশ যেন নিজ দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি বিরোধী হয়ে না উঠে সেই দিকে খেয়াল রাখা খুব প্রয়োজন।