চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

মূর্তিকারিগর আমি কেনো পড়লাম!

এবারের বইমেলায় আবিষ্কার প্রকাশনী প্রকাশ করেছে জাহিদ নেওয়াজ খানের মূর্তিকারিগর। বইটি নিয়ে এবার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন সাংবাদিক রুদ্রাক্ষ রহমান। ফেসবুকে মূর্তিকারিগর নিয়ে লেখা তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো নিচে।

মূর্তিকারিগর আমি কেন পড়লাম!
স্মার্ট গদ্য বলে? জুয়েল, মানে জাহিদ নেওয়াজ খান আমার পরিচিত, একধরনের বন্ধু বলে? ফেসবুকে বইটা নিয়ে অনেক কথা আসছে তা দেখে কী লিখেছে এটা জানার জন্যে?

মূর্তিকারিগরের লেখক জাহিদ নেওয়াজ খানের সঙ্গে আমার পরিচয় বিগত শতাব্দীর শেষ দশকের একদম গোড়ায়। আমাদের ভবিষ্যৎহীন এলোঝেলো সময়, সূর্যসেন হল, মধুর ক্যান্টিন আর টিএসসিতে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধনারকেল বৃক্ষ জানতো জুয়েল দারুণ গল্প লেখে। আর সে সময় থেকেই দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার; তারপর আরো কত মাধ্যম ছুঁয়েছে সে। তবে সাংবাদিকতা ছাড়েনি জুয়েলকে; জুয়েলও তাই। সঙ্গে লেখালেখি। জুয়েল যে শুধু চনমনে বাংলা লেখে তা নয়, চমৎকার গদ্য লিখিয়েদের খবরও রাখে। ওই যে সময়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে জুয়েলের কক্ষটি আমাদের অনেকের এক ধরনের আশ্রয়। আর তখন শাহবাগের আজিজ মার্কেট মানেই বইয়ের দোকান। শহরের স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি বিজু একাই এক বইয়ের দোকান দিয়ে বসেছেন। নাম ‘পাঠক সমাবেশ’ শহরবাসীকে শুনাচ্ছে কথাটা-‘আসা যাওয়ার পথের ধারে একটি বইয়ের দোকান’। তারপর ওই মার্কেট খ্যাতি পেয়েছে দেশজুড়ে; একদা বইয়ের জন্য, এখন পোশাকসহ বারোয়ারি অনুষঙ্গে। তো বইয়ের জন্য যখন তুমুল খ্যাতি আজিজ মার্কেটের; জুয়েল এক সন্ধ্যায় আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো জয় গোস্বামীর ম্যাজিক গদ্যের সঙ্গে। বইয়ের নাম ‘হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষে’। আমার টাকায় কেনা বইয়ের সাদা পৃষ্ঠায় জুয়েল লিখে দিলো-‘এমন গদ্য না পড়া পাপ’। সেই থেকে আমিও তো জুয়েলের মতো ভালো-চটপটে গদ্যের অনুরাগী। বিষয় যতো মজবুতই হোক আমাকে বেশিদূর তা টানে না ভাষা বাঁশপাতার মতো চিকন আর গতিময় না হলে।

দুই.
এই প্রশ্নে মূর্তিকারিগর আমার কাছে অনন্য। শুরুটা দারুণ পদ্যময়। জুয়েল রিপোর্টার আর রিপোর্টার যখন গল্প লেখেন তখন ভাষাও হয়ে যায় ঝরঝরে-টানটান। এই গুণেই মূর্তিকারিগর আমাকে একটানে নিয়ে গেছে শেষ পৃষ্ঠায়। একটু ধীরে হাঁটি বলে ৭ থেকে ৮৮ পৃষ্ঠা ভ্রমণ করতে আমার সময় লেগেছে চার ঘণ্টার মতো। এই সময়টাতে আমি একটা শহরকে দেখলাম নতুন করে। আমি ওই শহরের মানুষ নই, তারপরও অনেক পরিচিত নাম, অনেক জায়গা উঠে এসেছে বইয়ের পাতায় পাতায় চরিত্রের হাত ধরে। উঠে এসেছে একটা সময়; একটা স্বাধীন দেশের জন্মক্ষণকাল!

মূর্তিকারিগর একটা গল্পইতো; কতগুলো চরিত্র সেখানে। সন্ধ্যাদি, সত্যেন স্যার, বশির স্যার আর ওই যে মূর্তিগড়ার শিল্পী নৃপেন বাবু তারপর বাদল-এক মূর্তিকারিগর; যাকে ঘিরে গল্পের শুরু এবং শেষ। গল্পটা একটা সময়ের, এটা শহরের কতগুলো মানুষের হলেও; গল্পটা ভীষণ সুখের এবং গভীর বেদনার হলেও নানা ঘটনায় তা সময় এবং চেনা চরিত্রকে ছাড়িয়ে চলে গেছে। যেমন চিন্তার ঐক্যে এ গল্পের সঙ্গে চলে এসেছে মানুষের জীবন-সংগ্রামের বহমান স্রোত। রাশান লেখক নিকোলাই অস্ত্রভস্কির আলোড়িত সৃষ্টি ‘ইস্পাত’। তার প্রধান চরিত্রের বয়ানে আমরা পাই-‘জীবন মানুষের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ। এই জীবন সে পায় মাত্র একটি বার। তাই এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে বছরের পর বছর লক্ষ্যহীন জীবন যাপন করার যন্ত্রণাভরা অনুশোচনায় ভুগতে না হয়, যাতে বিগত জীবনের গ্লানিভরা হীনতার লজ্জার দগ্ধানি সইতে না হয়; এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মৃত্যুর মুহূর্তে মানুষ বলতে পারে: আমার সমগ্র জীবন, সমগ্র শক্তি আমি ব্যয় করেছি এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্যে; মানুষের মুক্তির জন্যে সংগ্রামে।’ মূর্তিকারিগর বাদল বাংলাদেশের অগ্নিসময়ে ময়মনসিংহে বসে এমন একটা জীবনইতো যাপন করেছেন; করতে চেয়েছেন! তাইতো?

তিন.
গল্পকার, ঔপন্যাসিক জাহিদ নেওয়াজ খান তার মূর্তিকারিগরে বাদল নামে এক শিল্পীকে গড়েছেন। এই শিল্পী মূর্তি গড়েন, মানুষের মূর্তি, সৌন্দর্যের মূর্তি। এই কারিগর এমনি কারিগর যে তিনি ডুবে যাওয়া সূর্যের জন্য কাঁদেন, সৌন্দর্যের জন্য কাঁদেন; কাঁদেন মানুষের জন্য। তিনি শিল্পী, সৌন্দর্য নির্মাতা; তাইতো নিষ্ঠুরতম তার মৃত্যুদৃশ্যেও মঙ্গল প্রার্থনা করেন জগতের জন্য।

একটি অনিবার্য উপলব্ধি: ভীষণ গোলমেলে এই সময়ে ‘মূর্তিকারিগর’ সত্যি সত্যি এক সাহসী প্রয়াস। অভিনন্দন জাহিদ নেওয়াজ খান জুয়েলকে। এবং আমি খুব করে চাইছি বইটি অনেক অনেক আলোচনায় আসুক!