তাঁর খুব ভক্ত আমরা। কিন্তু কেন জানি তার কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ আমরা পাইনি। তার শরীরে নীল রক্ত বহমান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিচিত্রায় তার লেখা ‘এপিটাফ’ নিয়ে প্রচ্ছদকাহিনি ছাপা হয়। বিশপ হেবারের চোখে বাংলাদেশ কিংবা উনবিংশ শতকে ঢাকার সংস্কৃতি চর্চা এমন অবাক করা বইয়ের লেখক তিনি। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ধান শালিকের দেশে তার উপন্যাস এক বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হলো। বইয়ের নাম ‘দ্বীপ দ্বীপান্তর’। আসেম আনসারীর আঁকা আশ্চর্য কুশলী ইলাস্ট্রেশান নিয়ে গেল অলৌকিক কোনো দ্বীপে। দূর থেকে দেখি তাকে। পাতলা ছিপছিপে। দ্রুত ছুটে বেড়ান। দ্রুত বেগে। তাকে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে। তাকে দেখতে পাই বিচিত্রার কার্যলয়ে। ঝড়ের বেগে শাহাদাৎ চৌধুরীর কক্ষে প্রবেশ করছেন। তাকে দুর থেকে দেখি বাংলা একাডেমির মহুয়া গাছের তলায়। সেলিনা হোসেনের সঙ্গে নিচুস্বরে কথা বলছেন। আবার দেখি বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২নং স্টুডিওতে। শিল্পী জয়নুল আবেদীনকে নিয়ে কথা বলছেন। তিনি একজন চিত্র সমালোচক। আল মনসুর এবং আলী ইমামের বন্ধু। তাদের সঙ্গে উচ্চস্বরে হাসছেন এবং খুনসুটি ও রসিকতা করছেন।
তার নাম মুনতাসীর মামুন। পেশায় অধ্যাপক। ঢাকাও ঢাকার ইতিহাস গবেষক হিসেবেও অতি পরিচিত। নিরন্তর গবেষণাধর্মী কাজ করে যাচ্ছেন। দু’হাতে লিখতে পারেন। বিশাল ভলিয়ুমের সাত খণ্ড রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ প্রায় এককভাবে অনেক বই লিখেছেন এই বিষয় নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, রাজাকার, সামরিক শাসন, পাকিস্তানি জঙ্গি শাসক এদের নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মুনতাসীর মামুনের মতো বৈদিক সাধকের দেখা পাওয়া যায না। প্রচণ্ড পরিশ্রম ও বাংলাদেশের জনমানুষের প্রকৃতি, সাংস্কৃতিক যাত্রা, ঢাকা, ঢাকা সংক্রান্ত সমগ্র বিষয়কে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন।
মুনতাসীর মামুনের কর্মপরিধির দিকে তাকিয়ে আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই। স্বল্প পরিসরে মুনতাসীর মামুনের রচনাবলী নিয়ে কিছু লেখা সম্ভব নয়। তার মূল্যায়নও আমার মতো অর্বাচিন কী করে, তার প্রকৃত মূল্যও এই পোড়া দেশে হয়নি। মুনতাসীর মামুন এর গম্ভীর মুখ দেখে কেউ ভাববেন না, তিনি পুঁথি পড়া পণ্ডিত, তার পাণ্ডিত্যের আড়ালে আছে বিদগ্ধ, পরিশীলিত, এক মগ্নসত্তা। তার সঙ্গে মেশার সুযোগ হলে বোঝা যাবে তিনি কতোটা আন্তরিক। কতোটা প্রাণবন্ত কতোটা দিলখোলা ব্যক্তি।
সারাক্ষণ সৃষ্টিশীল উন্মাদনা মধ্যে থাকেন। কথা বলেন অনর্গল, অসম্ভব প্রেরণাশক্তি আছে। তার কপট গাম্ভীট ভেঙে তার মধ্যে পরবর্তীকালে প্রবেশ করতে পেরেছি। তার বন্ধুদের আমি ‘ভাই’ সম্বোধন করলেও তাকে ‘স্যার’ বলে থাকি। তার শিক্ষক সত্তা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই এখনো ইতিহাস বিভাগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস চর্চাই জাতিকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়েছে।
মুনতাসীর মামুন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ তার গবেষণা প্রিয় বিষয়। হাজার হাজার বিষয় নিয়ে লিখেছেন। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বারবার ঘুরে বেড়িয়েছেন গবেষণা কর্মের জন্য। অসাধারণ কর্মনিষ্ঠ তার। এর বাইরে থাকা বিশেষণ হিসাবে তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি তার। দুএকটি ব্যতিক্রম বা প্রায় একক প্রচেষ্টায় প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ‘ঢাকা’ নিয়ে গবেষণা করছেন। ঢাকার সেকাল ও ইতিহাস পুনর্বিবেচনার জন্য আমরা বারবার তার দারস্থ হবো। আজকাল ঢাকা নিয়ে অনেক টুকরো টুকরো ফিচার নিবন্ধ দেখি। এসব লেখার উৎস মুনতাসীর মামুন। বাজারে বইও বেরুচ্ছে হরদম ঢাকা বিষয়ে। কিন্তু মুনতাসীর মামুনের নাম কোনো স্বীকৃতিপত্রে থাকে না। মামুন স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু এ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। তিনি হাসতে হাসতে স্বভাবসুলভ ফোঁড়ন কেটে বলেন, ‘কেউ আমার লেখা নকল করুক। তাতে অসুবিধা কী? বিভিন্নমুখী চর্চা হবে ঢাকা নিয়ে। আমরা তো সেই চেষ্টাই করেছি। মুনতাসীর মামুনের আরও অনেক গুণাবলী আমাদের আকৃষ্ট করে। তিনি খুব ভালো বক্তৃতা দেন। সহজ ভঙ্গিতে কাউকে পরোয়া না করে তিনি বক্তৃতা দেন। খুব কমুনিকেটিভ ভাষায় ফিচার লেখেন। যা তার কলাম হিসেবে বিখ্যাত। খুব জোরালো যুক্তি, পরিচ্ছন্ন ভাষাভঙ্গি এবং সততার সাথে সত্য উচ্চারণে দ্বিধাহীন। তার কলামে খুবই জনপ্রিয়। প্রধান দৈনিকে দেখেছি প্রথম পাতায় ‘লিড’ আর্টিকেল হিসাবে তার কলাম ছাপা হয়েছে। সাহসী সেই কলাম বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথকে সঠিকপথে সন্ধান দিয়েছে।
এর বাইরেও মুনতাসীর মামুনের অনেক পরিচয় আছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। পিএইচডি করেছেন। পৃথিবী বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চস্তরের সেমিনারে বহুবার বক্তৃতা দিয়েছেন। চিত্রকলার তিনিএক দুরন্ত সমঝদার। তার সংগ্রহে দেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের চিত্রকলা সযত্নে সংরক্ষিত আছে। শিল্পী হাশেম খান তার প্রিয় অগ্রজ। দুজন মিলে তারা অনেক কাজ করেছেন। ঢাকা নগর জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছেন। খুলনায় নির্মাণ করছেন গণহত্যা জাদুঘর। স্বপ্নকে কিভাবে বাস্তবায়িত করতে হয় তার উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদের মুনতাসীর মামুন। উচ্চবংশীয় সন্তান তিনি। তার প্রয়াত পিতাও গবেষণাধর্মী লেখা লিখেছেন। মহিউদ্দিন খান আলমগীর ও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তার পিতৃব্য। মুনতাসীর মামুনের বন্ধুরাও স্বক্ষেত্রে খ্যাতিমান। আলী ইমাম, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, শাহরিয়ার কবির, প্রয়াত বেবী মওদুদ, আল মনসুর, চিন্ময় মুৎসুদ্দী এরকম গুচ্ছ গুচ্ছ অনেক নাম।
জয়বাংলা’ শিরোনামে মুনতাসীর মামুনের একটা বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস আছে। সেই বইতে বিস্ফোরণ উন্মুখ উনসত্তরের বাংলাদেশ আছে তেমনই তাদের বেড়ে ওঠা ইতিহাসের গন্ধও পাওয়া যায়। বইটা সিটি আনন্দ সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়। এখন তিনি বইমেলায় প্রকাশিত কোনো বই আর পুরস্কারের জন্য জমা দেন না। কারণ তার বই-ই তো সেরা বই। তাহলে বারবার তিনিই পুরস্কার পাবেন। এইজন্য খ্যামা দিযেছেন।
মুনতাসীর মামুন সহজে টেলিভিশনে আসতে চান না। চ্যানেল আই থেকে আমরা অনেক অনুরোধ করি। তিনি খুব একরোখা মানুষ একবার না বললে ‘হ্যাঁ’ হবে না। তাঁর প্রাসঙ্গীক বিষয় না হলে তিনি কথা বলেন না। খুব পরিহাসপ্রিয় ব্যক্তি। সারাক্ষণ দুষ্টুমিভরা চোখে সিরিয়াস কথা বলে যান। চ্যানেল আইযের কোনো অনুষ্ঠানে এলে সাগর ভাই আর আমার খোঁজ একবার হলেও নেবেন। সাগর, তোমার শরীরের দিকে নজর নিচ্ছো না। ভালো চিকিৎসা করো। এতো পা ফুলে থাকবে কেন তোমার? আমাকে দেখে হয়তো বলবেন, একটা কথা আছে তোমার সঙ্গে শোনো। তুমি অনেক লিখেছ। কিন্তু সেসব লেখার যথাযোগ্য সম্মান তুমি পাওনি। এজন্যে তোমার নিজেরই উদ্যোগ নেয়া প্রযোজন। বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছ। দুর্ভাগ্য তোমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবেই। যাদের তিনি পছন্দ করেন তাদের জন্য অনেক উদার তিনি। খুব সহানুভূতিশীল শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রিয় মানুষদের খোঁজ খবর রাখেন নিয়মিত।
কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন সারাক্ষণ। সচরাচর কোনো অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যায না। খুব প্রয়োজন না থাকলে তিনি অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন। শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের অনেককে দেখেছি মুনতাসীর মামুনকে তারা ভয় পান। তার বাক্যবাণে জর্জরিত হওযার চেয়ে পালিয়ে থাকা অনেক ভালো। অনন্যার মনিরুল হক, সময় প্রকাশনের ফরিদ আহমেদ, কবি তারিক সুজাত এই ধরনের উদ্যোগী ও কর্মনিষ্ঠ প্রকাশকদের সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্ব। নিজে কাজের লোক। তাই কাজের লোকদের অনেক ভালোবাসেন। মুনতাসীর মামুনকে এখন অনেক কাছ থেকে দেখি। তিনি আমার প্রিয় ব্যক্তি। প্রিয় চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক। প্রিয় বক্তা। জীবন জয়ী মুনতাসীর মামুন আমাদের আদর্শ ও চিরপ্রণম্য ব্যক্তি।