চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মুজিব পরদেশীর নস্টালজিয়ায় অবুঝ মন

আমরা যখন মেডিকেল কলেজে পড়তাম, শেষবর্ষের দিকে এসে আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়লো ফোক গায়ক মুজিব পরদেশী। হোস্টেলে বন্ধুদের অনেকেই দরাজ গলায় গাইতো- আমি বন্দী কারাগারে, আছি গো মা বিপদে, বাইরের আলো চোখে পড়ে না, মা। গানটি তখন সর্বস্তরে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলো।

জর্জ মাইকেলের কেয়ারলেস হুইসপারের পাশাপাশি হোস্টেলে বাজতো এই গান। হোস্টেল লাইফ তথা মেডিকেল জীবনের অনেক স্মৃতি হঠাৎই জীবন্ত হয়ে ধরা পড়ে যখন কলেজ জীবনের বন্ধুদের সাথে দেখা হয়।

নিউইয়র্কের অভিবাসী জীবন এখনো আমাকে মুজিব পরদেশীর বন্দীদশার কথা মনে করিয়ে দেয়, গানের সাথে একটু ভিন্নভাবে একাত্ম করে তোলে। আছি গো মা বিপদে বলে মায়ের আশীর্বাদ ভিক্ষায় আমিও আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। পরদেশে স্বেছায়বরণকৃত বিশাল কারাজীবনে, কিছুসময়ের জন্য নস্টালজিক সেই কলেজ জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যায় বন্ধুবর ফারুক সাথে যোগ দেয় আরেক বন্ধু সিনহা।

দু’জনেই আমার মেডিকেল কলেজের সহপাঠী বন্ধু। উভয়ের পরিবারের সাথে আমার পরিবারের সম্মিলিত সাক্ষাত, আড্ডা এবারই প্রথম। আমরা যখন সপরিবারে ফারুকের দাওয়াত গ্রহণের জন্য তার প্রাসাদোপম বাসায় পৌঁছাই তখন ওদের টিভি পর্দায় পরিনীতা চোপরার ‘দাওয়াত ঈ ইস্ক’ চলছিল। ফারুকের বাসায় দাওয়াতটাও অনেকটা ‘ইস্ক’ এর পর্যায়ে, তা না হলে নিজে ৪৫ মিনিটের পথ ড্রাইভ করে কেউ গাড়ি করে অতিথিকে নিয়ে আসে না, আবার মধ্যেরাতে অতিথিকে তার আশ্রমে পৌঁছে দেয় না। একইরকম আতিথিয়তা বন্ধু সিনহার কাছ থেকেও পেয়েছি। নিউ ইয়র্কে আর্থিক ও সামাজিকভাবে ডাক্তারদের অবস্থা ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। সুতরাং তাদের অতিথিবৎসলতার কমতি থাকার কথা নয়। তারওপর আবার মেডিকেল কলেজ জীবনের বন্ধু। তাছাড়া এখানে উইকএন্ড মানে কোথায় বেড়াতে যাওয়া কিংবা বাসায় পার্টি।

সেই বিবেচনায় এটা কোনো পার্টি না। ঘরোয়া আড্ডা। কলেজ জীবনের বন্ধুত্রয়ের আড্ডা, তাই জমতে বেশিক্ষণ লাগেনি। বাচ্চারা মেতেছিল ওদের মত। আড্ডা চলতে থাকে। মাঝে মাঝে চলচ্চিত্র নিয়ে কথা হয়। ‘দাওয়াত ঈ ইস্ক’ ফারুকভাবী এপর্যন্ত ১১বার দেখছেন, সাথে আমরাও দেখছি।

সিনহা গল্প তোলে শাহরুখ খানের ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবি নিয়ে এবং তাকে ২০০৯ ও ২০১২ সালে পর্যায়ক্রমে নিউজার্সি ও নিউ ইয়র্কের এয়ারপোর্টে সাময়িক আটকে দেয়ার কাহিনীও চলে। দু’বারই আটকে দেয়ার পেছনে মুসলমানভীতি বা মুসলমানদের প্রতি বিরূপ মনোভাবই যে মূল তা প্রকাশ্যে উচ্চারিত না হলেও আমেরিকার বেশির ভাগ মুসলমান সেটাই বিশ্বাস করে।

অবশ্য ২০০৯ সালে জিজ্ঞাসাবাদের নামে সাময়িক আটকে দেয়ার ঘটনায় শাহরুখ খান নিজেই বলেছেন, নামের পিছনে ‘খান’ থাকার কারণেই তাকে ২ঘন্টা অনাকাঙ্খিতভাবে এয়ারপোর্টে থাকতে হয়েছিলো।

সে বার তিনি নিউ ইয়র্কে তার ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবির শুভমুক্তি উপলক্ষে প্রচারকাজে এসেছিলেন। তার সেই ছবির মূল বক্তব্য ছিল-অ্যাম আই অ্যাম খান, আই অ্যাম নট টেরোরিস্ট। অর্থাৎ মুসলমান মানেই যে টেরোরিস্ট নয়, সেটাই ছিল সেই ছবির মূল বক্তব্য।

আমেরিকায় বসবাসরত অনেক মুসলমানই এখন মুসলমান হওয়ার কারণে হয়রানির আতঙ্কে ভোগেন। অবশ্য কেউ কেউ মুসলমান হিসাবে হয়রানির বিষয়টি মানতে নারাজ। তাদের কথা ওটা মুসলমানদের মনের ভয়, বাস্তবে তেমন কোন ডিস্ক্রিমিনেশন নেই।

অন্যদিকে ছবির মূল বক্তব্যের সাথে এয়ারপোর্টের ঘটনার প্রতিফলন দেখে অনেকেই বলেছেন হতে পারে ছবির বক্স অফিস হিট করার জন্যই পুরো ঘটনাটা ছিলো একটা পাতানো নাটক। আবার কেউ বলছে, না এতে ছবির বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে। কথা ওঠে ২০১৫ সালের ছবি ‘বাজরাঙ্গি ভাইজান’ নিয়ে। ছবির নাম ‘বাজরাঙ্গি মামা’ হলো না কেন, এ নিয়ে ফারুকভাবীর রসিকতাপূর্ণ আপত্তি।

ছবিতে যাকে নিয়ে গল্প সেই কিশোরী, হারিয়ে যাওয়ার পরও কেন তার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার দু:খটা প্রকাশ পায়নি? একজন মায়ের কাছ থেকে এভাবে তার সন্তান হারিয়ে যাওয়াটাও কি মেনে নেয়া যায়? তবে হারিয়ে যাওয়ার গল্পগুলো তো এমনই হয়; কাহিনীর ভুল-শুদ্ধসহ নানান বিষয় নিয়ে আলোচনায় জমে ওঠা আড্ডা চলচ্চিত্রের আসর হয়ে ওঠে।

আসরে সরবভাবেই ‘টাইটানিক’ এর অসমশ্রেণীর প্রেম নিয়ে বিরোধিতা করেন শিল্পী ভাবী (মিসেস সিনহা)। পক্ষে অকাট্য যুক্তিও দেখান তিনি। কিন্তু প্রেম যে শ্রেণী এবং যুক্তি মানে না সেটিও উঠে আসে আসরে। আসরে বাদ যায় না বাংলাদেশের পুরনো ছবি নিয়ে কথাবার্তা। ‘অবুঝ মন’, দোস্ত দুশমন, ‘ডাকু সুলতান’ নিয়ে যেমন স্মৃতিচারণ হয় তেমনি কথা হয় ‘ওরা এগারো জন’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সহ বিভিন্ন ছবি নিয়ে

সিনহা’র চুরি করে চিত্রালী পড়া দিয়ে শুরু হয়েছিল বাংলা ছবির আলোচনা তা শেষ হয় ঢাকাই ছবি সম্পর্কে হতাশা দিয়ে। ৬০ দশকের দেশব্যাপী সিনেমা হলের ব্যাপক বিস্তার সংকুচিত হতে হতে ২০১৫তে এসে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে কোনো রকমে ঠাঁই নিয়েছে।

রাত ততক্ষণে অন্যতারিখে পাড়ি দেয়ার সময় হয়েছে, খাওয়া-দাওয়া শেষে তাই তড়িঘড়ি ফটো সেশন। আসলে বয়স একটা ব্যাপার। যতই বয়সকে ঢাকার চেষ্টা করি না কেন, লাভ হয় না। বয়স বাড়া মানে স্মৃতির ভাণ্ডার বাড়া। টুইম্বর স্মৃতির ভাণ্ডারতো উপচে পড়বেই। এখন সময় স্মৃতিচারণের।