চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মুজিববর্ষে মোদিকে নিয়ে প্রশ্ন আছে

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ উদযাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা নরেন্দ্র মোদি- এ খবর পুরনো। মুক্তিযুদ্ধে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সমর্থন-সহযোগিতা আর বন্ধুত্বের প্রতিদান হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এই অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা করা হয়েছে। এখানে ব্যক্তির প্রসঙ্গ শুরুতে আসেনি, তবে এখন আসছে কারণ নানা বিতর্কিত ভূমিকার কারণে আগের বিতর্কের সঙ্গে নাম জড়াচ্ছে নরেন্দ্র মোদির। তিনি তার দেশে যেমন বিতর্কিত চরিত্র, তেমনি এই দেশ এবং অন্যান্য দেশেও।

বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ উদযাপন বাংলাদেশের জন্যে বিশেষ কিছু। এর কারণ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে বাঙালির স্বাধিকার, স্বাধীনতা আর মুক্তির সম্পর্ক জড়িত। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু স্বাধিকার, স্বাধীনতার সকল আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। সেই নেতার জন্ম শতবর্ষ উদযাপন বিশেষ কিছু হওয়াই স্বাভাবিক। সরকার ইতোমধ্যে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চের সময়কে মুজিববর্ষ বলে ঘোষণা করেছে। এরই মধ্যে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। মুজিববর্ষকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের তথ্য জানানো হচ্ছে।

জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রেক্ষিতে এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে। দেশে-বিদেশে মুজিব জন্মশতবর্ষ উদযাপনে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করায় স্থানিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে উদযাপনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে জানিয়েছে মুজিব শতবর্ষ উদযাপনের পরিকল্পনায় বর্তমানে ২৯৮টি কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ বিশাল এই আয়োজন, সাজ-সাজ রব দেশজুড়ে, এবং স্বাভাবিকভাবেই এখানে সরকারের আগ্রহও লক্ষণীয়।

উদযাপন উপলক্ষে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’ হয়েছে। ১০২ সদস্যের জাতীয় কমিটি, ৬১ সদস্যের বাস্তবায়ন কমিটি কাজ করছে। এই কমিটি জানিয়েছে মুজিব শতবর্ষে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান অংশ নেবেন। উদ্বোধনী দিনের বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে আছে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, মালয়েশিয়ার অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ জায়েদ আল নাহিয়ান, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, ভারতের কংগ্রেস দলের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনসহ আরও অনেকের সঙ্গে থাকবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বনেতাদের উপস্থিতি এই অনুষ্ঠানের জৌলুস ও আন্তর্জাতিক মাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে মুজিব শতবর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেবেন নরেন্দ্র মোদি। নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রীয় এই পদ-পদবি ছাপিয়ে সামনে আসছে তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, সরকারি কর্মসূচি যা কোনক্রমেই তার এবং তার দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই মোদি বিতর্কিত। প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তিগত সাম্প্রদায়িক বিশ্বাস রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির অংশ প্রতিষ্ঠিত করতে না চাইলেও দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই সাম্প্রদায়িকতার কদর্য রূপ প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের গায়ে এখন সাম্প্রদায়িক তকমা, এবং সেটা করে চলেছেন মোদি-অমিত গং। ভারতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এবং সেটা চলছে এই মোদির নেতৃত্বেই।

নিজ দেশে মোদি বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ), জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) ও জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধন (এনপিআর) নিয়ে। এনিয়ে পুরো ভারত উত্তপ্ত। ধর্মীয় বিভাজন সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে লালন করা হচ্ছে, ধর্মীয় হিংসা সরকারি দল ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভারতের প্রগতিশীল মানুষদের মতামতকে উপেক্ষা করে এটা প্রকাশ্যে করছেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ গং। দিল্লিতে চলমান সাম্প্রদায়িক হিংসায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। অগণন মানুষের এই হতাহতের ঘটনার সঙ্গে সরকারি দলের কর্মসূচির যোগ রয়েছে, তবু মোদি গং তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে মরিয়া। ভারতের বিজেপি সরকারের এই কর্মসূচির সমর্থনে নেই পুরো দুনিয়ার প্রগতিশীল মানুষেরা। তবু নরেন্দ্র মোদি তার অবস্থানে অনড়।

সিএএ, এনআরসি, এনপিআর ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় এটা বলার সুযোগ আর থাকছে না। কারণ এর প্রভাব প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের ওপরও এসে পড়ছে, এবং পড়বে। নাগরিকত্ব হারানো মানুষের ঢল বাংলাদেশ অভিমুখে নামলে সে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সাধ্য বাংলাদেশের আছে কি না এ নিয়েও আছে প্রশ্ন। এর বাইরে ভারত তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করতে চাইলে তখন বেকায়দায় পড়ে যাবে আমাদের দেশ। শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে শক্তির লড়াইয়ে আমাদের পেরে ওঠার কথা নয়, এছাড়াও শক্ত অবস্থান নেওয়ার মত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের সরকারের আছে কি না তা নিয়েও আমরা সন্দিহান।ভারত-আসাম-নাগরিকত্ব-তালিকােআসামের নাগরিক

ভারতের সাম্প্রতিক রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির প্রভাব বাংলাদেশে পড়ার আশঙ্কা থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে শক্ত অবস্থান নেওয়া হয়নি। কিছুদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর তাৎক্ষণিক বাতিল করলেও ভারতের বিতর্কিত নানা কর্মসূচির কারণে এই সফর বাতিল হয়েছে বলে উল্লেখ করেনি বাংলাদেশ। ফলে এটা রাষ্ট্রীয় প্রতিবাদ হিসেব পরিগণিত না হয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশের প্রতি ‘অভিমান’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এই ‘অভিমান’ আদতে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে সফর বাতিল নিয়ে সরাসরি কথা বলতে না পারার কারণে। এটাকে আর যাই হোক এটা যে শক্তিশালী পররাষ্ট্র নীতি তা বলা যাচ্ছে না।

ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রটোকল অনুযায়ী সম্মান না পেলেও সরকার এ নিয়ে কিছু বলেনি। বাংলাদেশ এ নিয়ে কেন প্রতিবাদহীন থেকেছে এটা বিশাল এক বিস্ময়! এটা আমাদের অপমান। কারণ প্রধানমন্ত্রী স্রেফ সরকারপ্রধানই নন, তিনি দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বর্তমানে উষ্ণ পর্যায়ে রয়েছে এটা মুখে বলা হলেও এই সম্পর্ক এখন দ্বিপাক্ষিক না থেকে একপাক্ষিক হয়ে পড়েছে বলে দৃশ্যমান। অভিযোগ আছে এখন আমরা দিয়েই যাচ্ছি, কিন্তু পাচ্ছি কিছু। এই অভিযোগের সঙ্গে এবার সামনে আসছে মুজিব শতবর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো।

চিরকালীন অসাম্প্রদায়িক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষের অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা হিসেবে বিশ্বের উজ্জ্বল ভাবমূর্তির কোন ব্যক্তিত্বের যেখানে নির্বাচনের কথা ছিল সেখানে সাম্প্রদায়িকতা ও নানা কারণে বিতর্কিত নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো আমাদেরকে বিস্মিত করেছে। সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট একজন নেতা বিশ্বজনীন অসাম্প্রদায়িক নেতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলবেন- এটা আর যাই হোক বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন নয়।

ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধু, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো- এই যুক্তিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা করতে হবে কেন? ভারতের কেউ এই অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা হিসেবে থাকতে পারেন, তবে সেটা নরেন্দ্র মোদি পারেন না। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হওয়ার মত যোগ্যতা তিনি রাখেন না। কারণ তার ব্যক্তি পরিচয়, ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে উৎসারিত কর্মসূচি রাষ্ট্রের গায়ে চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে এই মুহূর্তে সেটা রাষ্ট্রীয় পরিচিতিকে ছাপিয়ে গেছে। এই ছাপিয়ে যাওয়া ইতিবাচক ভাবে নয়, নেতিবাচক ভাবেই।

ভারত-আসাম-নাগরিকত্ব-তালিকাতারপরেও ভারতের কাউকে যদি মুজিব শতবর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা করতেই হয় তবে সেটা সরকারপ্রধান নরেন্দ্র মোদি না হয়ে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানকে করা যায়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্ব নরেন্দ্র মোদিকে দিয়ে নয়, এটা রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাষ্ট্রের। আর মুজিব শতবর্ষের অনুষ্ঠান যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় তখন মুক্তিযুদ্ধকালীন অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারেন এই অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে যোগ্য ব্যক্তি।

জানি না, এ নিয়ে সরকার ভাবছে কি না; তবে ভাবা উচিত, কঠিন হলেও এটা ভাবা উচিত। মুজিব শতবর্ষের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কিংবা প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য দিয়ে কেউ বঙ্গবন্ধুকে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করবেন এমন না, বরং বঙ্গবন্ধু মুজিবকে নিয়ে অনুষ্ঠানে অতিথি ও বক্তা হিসেবে বক্তব্য দিয়ে এই সময়ের নেতারা নিজেরাই সম্মানিত হবেন।

যেখানে অসাম্প্রদায়িক বিশ্বজনীন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সম্মান জড়িত সেখানে বঙ্গবন্ধুর সম্মানের দিকে তাকিয়ে কঠিন হলেও সাম্প্রদায়িকতা দুষ্ট কাউকে সম্মানিত করা উচিত হবে না। এটা ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সংঘাত নয়, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপার। আমরা বঙ্গবন্ধুকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে না পারলে এটা আমাদের ব্যর্থতা; কিন্তু এই ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে অন্তত তাকে অসম্মান জানাতে পারি না। অসাম্প্রদায়িক বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান জানানোর অধিকার আমাদের কারও নেই।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)