গাছগাছালি-পাখপাখালিতে ভরা মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ যেনো দাঁড়িয়ে আছে শান্তির ছায়া হয়ে। কিন্তু ৪৫ বছর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সবুজ এই ক্যাম্পাসটিকেই টর্চার সেলে পরিণত করেছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আল বদর বাহিনীর কমান্ডার আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ।
ওই সময় কলেজের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন মো. রহম আলী। তিনি দেখেছেন, নিজামী-মুজাহিদ এবং অন্যরা কিভাবে বাঙালিদের কষ্ট দিয়ে মেরেছে। কিভাবে চোখ তুলে ফেলেছে, আঙুল থেঁতলে দিয়েছে। এরপর হত্যা করেছে নির্মম কায়দায়।
বয়সের ভারে রহম আলী অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না। কথাও বলতে পারেন না খুব একটা। তার ছেলে মো. রুস্তম আলীর তখন বয়স ছিলো ২১। বাবার পাশে পাশে থেকে অনেক কিছু তিনিও দেখেছেন। ভয়ে সবসময় কুঁকড়ে থাকলেও গোপনে গোপনে সহায়তা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
মুজাহিদের মামলায় সাক্ষী ছিলেন তিনি। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হওয়ার পর চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে আরেকবার বর্ণনা করলেন কিভাবে মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিলেন মুজাহিদ।
রুস্তম আলী বলেন, সারা বাংলাদেশে যতো হত্যাযজ্ঞ চালানো হতো তার আগে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও মুজাহিদ বাহিনীর সব মিটিং হতো এই কলেজ ক্যাম্পাসে। কলেজটি ছিলো যুদ্ধাপরাধীদের সব কাজের হেড কোয়ার্টার।
‘এখানে নারীদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। ছেলেদের ঝুলিয়ে মারা হতো। ভুলে পাকিস্তানের পক্ষের কাউকে ধরে আনা হলে ছেড়ে দেওয়া হতো। বাকি সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলতো তারা। কোনো মুক্তিযোদ্ধা যদি পানি চাইতো, তা হলে তাদের পেশাবও খাওয়ানো হতো,’ মুজাহিদের নির্মমতার কথা বলতে গিয়ে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে রুস্তম আলীর।
এসব স্মৃতির কথা মনে পড়লে এখনও খুব অশান্তি লাগে তার। বলেন: বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে এখানেই। আল বদর আল শামস, মুজাহিদ বাহিনীর জন্মও এখান থেকেই। এই কলেজে তাদের ট্রেনিং দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
তিনি জানান, টর্চার সেলটিতে মুজাহিদ যেমন আসতেন, তেমনই আসতেন গোলাম আযম এবং মতিউর রহমান নিজামী।
‘এখানে বসেই তারা পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে চা-নাস্তা খেয়ে মিটিং করতেন। মিটিং-এর পর মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নতুন করে শুরু হতো অমানুষিক এবং পাশবিক নির্যাতন,’ ৪৫ বছর আগের ওই সময়ের বর্ণনা দিয়ে রুস্তম আলী জানান: বিভিন্ন বিভাগে বাহিনীগুলো কিভাবে কাজ করবে তার দিক-নিদের্শনা ও পরিচালনাও হতো মোহাম্মদপুরের এই টর্চার সেল থেকে।
স্বাধীনতার এতো বছর পর লম্বা সময় নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে রুস্তম আলী বলেন, আগের সরকারগুলোর ব্যর্থতার জন্য বিচারগুলো এতো বছর ঝুলে ছিলো। এখন সরকার চেষ্টা করেছে, তাই বিচার হচ্ছে।
‘আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল হওয়ার কারণে সাক্ষ্য দেওয়ার মতো সাহস হওয়ার কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে,’ বলেও মনে করেন মুজাহিদের মামলার সাক্ষী।
সাক্ষী হওয়ার কারণে তিনি ভয় পান না। কিন্তু মনে করেন যে সাক্ষী সুরক্ষা আইন হলে যারা সাক্ষী তারা এবং তাদের সন্তানরা নিরাপদ বোধ করবেন। তিনি জানান, কয়েক মাস ধরে মিটিং হচ্ছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সাক্ষী সুরক্ষা আইন নিয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।