বেগুনি রঙ দিয়ে দুরদর্শী চিন্তাভাবনাকে বোঝানো হয়, সেই সাথে লিঙ্গ সমতাকে বোঝানো হয় বেগুনি রঙের মাধ্যমে, যার জন্য আজও নারীরা যুদ্ধ করে যাচ্ছে।
আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জাতিসংঘ ২০২২ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে “নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ”। এই মূল প্রতিপাদ্যেও আলোকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- “টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য”।
টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’ দিবসের এই প্রতিপাদ্যটিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে চ্যানেল আই অনলাইন জেন্ডার সমতায় তিন তরুণ ইনফ্লুয়েন্সারদের কথা তুলে ধরেছে। যারা সমাজে নানা ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিজেদের নিয়ে যাচ্ছে অন্য উচ্চতায়।
উবারের প্রথম নারী ড্রাইভার লিউজা
উবার বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রাইভার লিউজা আক্তার কৃষ্টি জানালেন, আমার রাইডার, পুরুষ এবং নারী উভয়েই।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নিজেদের প্ল্যাটফর্মের নারী ড্রাইভার পার্টনারদের অবদানের কথা তুলে ধরার জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে উবার বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানে প্ল্যাটফর্মটির নারী ড্রাইভার হিসেবে সেরা ইনফ্লুয়েন্সার নির্বাচিত হন।
লিউজা বলছিলেন, আমি কখনোই নেগেটিভ কমেন্ট পাইনি। অনেকেই আমাকে বলেছে রাতে মেয়েদের ড্রাইভ করা উচিত নয়। পজেটিভ কমেন্টগুলো আমাকে অনেক বুস্টআপ করেছে। অনেকেই বলেছে মেয়েরা ড্রাইভ করছে এটা বাহিরের দেশে দেখা যায়, বাংলাদেশে দেখিই না। আবার অনেকেই মনে করে বাংলাদেশে গাড়ি ড্রাইভিংয়ে আরও অনেক নারীদের আসা উচিত।
২০০৭ সাল থেকে নিজের গাড়ি ড্রাইভ করা লিউজা আক্তার কৃষ্টি ২০১৭ সালে উবারে রেজিস্ট্রেশন করেন।বললেন, গাড়ি ড্রাইভ করতে তার অনেক ভালো লাগে। নিজেদের পরিবারে গাড়ি থাকার সুবাদে আস্তে আস্তে ছোট বেলাতেই শেখা হয়ে গেছে গাড়ি চালানো।
চাকরি থেকে গাড়ি চালানো হাজার গুণ ভালো অ্যাখায়িত করে লিউজা বলেন, উবার সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টা গাড়ি চালালে ২০ হাজার টাকা দিচ্ছে নারীদের। আমি সপ্তাহে পাঁচদিন চালাই। আমার সংসার ভালোই কেটে যাচ্ছে। উবারে আমি মাসে লাখ টাকা কামানো যায়। বেশি করলে দেড় লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
লিউজা বললেন, সম্প্রতি নতুন রেস্তোরা ব্যবসা চালু করতে যাচ্ছি। শুধু সমাজ একটু পরিবর্তন হলেই আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারি। সকলের মাঝে লিঙ্গ-সমতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে এবং নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করতে হবে।
লিউজা বলেন, “আমি উবারের কয়েকজন নারী ড্রাইভার পার্টনারদের একজন হতে পেরে গর্বিত। আমি আরও ভালো বোধ করি যখন আমার রাইডার, পুরুষ এবং নারী উভয়েই, আমার কাজের প্রশংসা করে এবং আমি আশা করি আরও বেশি নারীরা উবার বাংলাদেশের নমনীয়তা এবং স্বাধীনতা অনুভব করবে এবং প্ল্যাটফর্মটিতে যুক্ত হতে চাইবে।”
নিজের মতো বাঁচি, মানুষের কথায় নয়
নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে ছোট বেলাতেই ক্লাসেই বুলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন সাদ বিন রাবী ওরফে সাদ মুআ। ছোটবেলায় তার অঙ্গভঙ্গি দেখে অনেকেই বাজে কমেন্ট করত। তবে পরিবার পাশে থাকায় পথ চলা অনেকটা সহজ হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
মেকআপ টিউটোরিয়ালসহ বিউটি কেয়ারের নানা ধরনের ভিডিও কনটেন্ট বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে পড়েন মেকআপ আর্টিস্ট সাদ বিন রাবী ওরফে সাদ মুআ। পরিচিতি পান ‘বাংলাদেশের প্রথম পুরুষ বিউটি ব্লগার’ হিসেবে।
সাদ বলেন, আমাদের সোসাইটিতে পুরুষ বিউটি ব্লগার হওয়াটা কঠিন ছিল। আমি এখনও পজেটিভ ও নেগেটিভ দুটোই কমেন্ট পাই। তবে আমি মানুষের কথায় কান দেই না। একজন ঘৃণা করলে আমাকে দশজন ভালোবাসে। যারা আমাকে আগ্রহ দেয় তাদের কথা ভেবেই এগিয়ে যাচ্ছি।
ভবিষ্যতে কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিজের মেকআপ ব্র্যান্ড চালু করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
নিজের নন বাইনারি পরিচয় সম্পর্কে সাদ রাবী বলেন, একজন নন বাইনারি জেন্ডার যে কিনা কখনো পুরুষ রূপে আবার কখনো নারী রূপে নিজেকে দেখতে পছন্দ করে।
পরিবারের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বললেন: পরিবারের সাপোর্ট ছাড়া এখানে আসতে পারতাম না। তারা যেহেতু আমার বাবা-মা তাই আমার বিষয়ে সবই তাদের জানা। আমি তাদের নিয়ে গর্বিত।
স্যোশাল মিডিয়াতেও সাদের ভালো বন্ধু রয়েছে। সাদ জানালেন, তিনি বাঁচেন নিজের মতো করে, মানুষের কথায় নয়।
নারী দিবসে অনুভূতি জানতে চাইলে সাদ বলেন, আসলে জেন্ডার কোন বিষয় নয়, আমি চাই সব নারীই হোক সে ট্রান্স ওমেন যথাযত যেন সম্মান ও মর্যাদা পায়। তাদের যেন কোন ধরণের লাঞ্ছিত হতে না হয়। আমরা যারা আছি তারাও যেন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, অন্য নারীদের মতো এক কাতারে।
নিজেই স্বামীকে স্কুটি চালানো শিখিয়েছি
বগুড়ার মেয়ে রাবেয়া আক্তার রোজী, প্রেম করে বিয়ে করেছেন। তার স্বামী সরকারী কর্মকর্তা, পরমাণু শক্তি কমিশনে কর্মরত। দুজনেই ঘুরতে খুব পছন্দ করেন। স্বামীর একার আয়ে সৌখিনতা সম্ভব নয় তাই রোজী বেছে নেন বাইক ড্রাইভিং। রাজধানী জুড়েই মাঝে মাঝে স্বামী স্ত্রী সন্তান মিলে বাইকে ঘুরতে বের হন। তাইতো নিজের স্বামীকেও শিখিয়েছেন স্কুটি চালানো।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নিজেদের প্ল্যাটফর্মের নারী ড্রাইভার পার্টনারদের অবদানের কথা তুলে ধরার জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে উবার বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানে প্ল্যাটফর্মটির নারী বাইকার হিসেবে সেরা ইনফ্লুয়েন্সার নির্বাচিত হন।
রোজীর ভাষ্য ‘‘যাত্রীদের ক্ষেত্রে অনেক নিরাপত্তা ও ভালো ব্যবহার পেয়েছি। তবে আমাদের সমাজের বিষয়তো জানেনই; ধরেন বাইক পার্কিং করছি চায়ের দোকানদার থেকে একটা কটুকথা বলে বসল, তবে আমি কখনোই বিষয়গুলো আমি নজরে নিতাম না। নিজেকে কখনো নারী হিসেবে ভাবি নাই। সব সময় মানুষ হিসেবে ভেবেছি। নিজের মতোই বাইক চালিয়েছি।’’
রোজী জানালেন, ২০১৯ সালে উবার চালানোর জন্য রেজিস্ট্রেশন করি, পরে পাঠাওতে। আসলে আমরা ভ্রমণ পিপাসু। আমি বাংলাদেশের অনেক পাহাড়েই হেঁটে উঠেছি।
বাইক ড্রাইভিংয়ে রোজগার কেমন? জানতে চাইলে তিনি বলেন: আমি সাভার ইপিজেড থাকি। আমার ট্রিপ নিতে উত্তরা কিংবা গাবতলী আসতে হয়। আসলে যারা ঢাকায় বাইক চালায় তাদের রোজগারটা বেশি হয়। আমি সন্ধ্যার ভেতর সাভার ফিরে আসি। তারপরও আমার তেল খরচ দিয়ে প্রতিদিন এক হাজার টাকা থাকে।
কেন অন্য পেশায় যান নি এমন প্রশ্নের জবাবে রোজী বললেন: বাইক ছোটবেলা থেকেই চালিয়েছে। এই্ পেশায় একটা সুবিধা আছে যখন ইচ্ছা রাইডার নিলাম, যখন ইচ্ছা নিলাম না। এছাড়াও রোজগার ভালোই হয়। কোম্পানি থেকেও প্রণোদনা পাওয়া যায়।
রোজী বলেন, সবসময় কাজকে কাজ মনে করেছি। লিঙ্গ ভেদাভেদ করিনি। আমাদের সামাজিক ধ্যান ধারণা বদলানো দরকার। আমার অদম্য স্পৃহা ছোট বেলা থেকেই ছিল। আমি যদি একজন ভাইয়ার বাইকে নিরাপদ থাকতে পারি তাহলে একজন ভাইয়া কেন আমার বাইকে নিরাপদ থাকতে পারব না।
নারী তার মেধা ও শ্রম দিয়ে যুগে যুগে সভ্যতার সকল অগ্রগতি এবং উন্নয়নে সমঅংশীদারিত্ব নিশ্চিত করেছে। সারাবিশ্বে তাই আজ বদলে গেছে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। এখন নারীর কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বীকৃতি। নারীর এগিয়ে চলা আগামীতে এভাবেই আরো বেগবান হবে।