‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটার প্রতিই আজন্ম দুর্বলতা। আমার ধারণা, যারা বাংলাদেশকে মনে প্রাণে ধারণ করেন, তারা প্রত্যেকেই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটির প্রতি দুর্বল।
একাত্তরে একেক জন মানুষ যখন মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন, তখন একমাত্র দেশের মুক্তি ছাড়া তাঁদের আর কোন স্বার্থ ছিল না। কতটা নি:স্বার্থ হলে একজন মানুষ জীবনের মায়া ফেলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও নির্দ্ধিধায় সশস্ত্র বাহিনীর বন্দুকের সামনে নিজেকে বিলিয়ে দেন! একাত্তরে কোন কিছুর বিনিময়েই তাঁদের কেনা সম্ভব হয়নি। প্রয়োজনে তারা সানন্দে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। কতটা নির্দ্বিধায়, নি:স্বার্থ হলে এটা সম্ভব! একটাবার একটু ভাবুন। যতবার এটা ভাবি, ততবার নিজেকে শুদ্ধ করে তুলি।
বেশ কিছুদিন যাবত সরকারি চাকরিতে ‘কোটা’ নিয়ে বেশ হচ্ছে। এবং যতবার এই আন্দোলনটা সামনে আসছে, ঠিক ততবারই বিব্রত হচ্ছি। নিজেকে সংকুচিত করে ফেলছি। লজ্জায়। কারণ আন্দোলনটা যে ‘কোটা’ নিয়ে, সেখানের সর্ববৃহৎ ‘৩০%’ কোটাই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সংশ্লিষ্ট।
এই ‘কোটা’ পদ্ধতির আবিষ্কার হয়েছিল দেশের পিছিয়ে পড়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য। অনেকটা করুণা স্বরূপ। পুনর্বাসনও বলা যায়। যেমন ভারতে নিম্মজাতের (!) জনগোষ্ঠীর জন্যও এই কোটা সিস্টেম প্রচলিত। একবার এই কোটার বিরুদ্ধে উচ্চ জাতের (!) কিছু মানুষ আন্দোলন করে আত্মহূতির ঘটনাও ঘটিয়েছিল।
বর্তমানে আমাদের দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে ৫৫ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের অগ্রাধিকার কোটা রয়েছে। আর বাকি ৪৫ শতাংশ নিয়োগ হয় মেধা কোটায়। এই শতাংশের বিভাজনটা আমার বোধে আসে না। কোনও যুক্তিতে মিলে না। একটা দেশ, প্রশাসন চালাবে ৫৫% অপেক্ষাকৃত কম মেধার লোক!
এটাও বড় ব্যাপার না। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, একজন মেধাবীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে তার শিক্ষাজীবনেই জানিয়ে দিচ্ছে, তুমি ৪৫% এর দলে। তাই সাবধান। চাইলেই তুমি পারবা না। আমার বিশ্বাস এদেশে সরকার চালাতে হলে মেধাবী কোটা ৪৫% থেকে কমিয়ে ২০% নামিয়ে আনলেও ক্ষতি নেই। সরকার দিব্যি ভালোভাবেই চলবে।
এই ‘কোটা’ নিয়ে আমার সমস্যাটা অন্য জায়গায়। যতবার ‘কোটা’ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, ঠিক ততবারই লজ্জায় নিজেকে সংকুচিত করে রেখেছি। যেহেতু ‘কোটা’র সবচেয়ে বড় অংশ ৩০% ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সংশ্লিষ্ট, তাই এই আন্দোলনের গাল-ধাক্কাগুলো তাঁদের উপরেই পড়ছে। এখানেই আমার আপত্তি।
মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, একজন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ কখনো কোন বাড়তি সুবিধা গ্রহণ করেন না। সুবিধা গ্রহণ করলে তাঁর কোন মর্যাদাও থাকে না, আর নিজস্ব কোন আত্মাও থাকে না। সুবিধা নিয়ে বাকী জীবন অন্যের আত্মা নিয়েই জীবন যাপন করে।
এই দেশ এক অদ্ভুত দেশ। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হালনাগাদ করতে হয়। বছরে বছরে নতুন নাম ঢুকে, আবার বাদও পড়ে। একাত্তরে ৪/৫ বছর বয়সের কেউ কেউ এই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন (খবরে প্রকাশ)। এগুলো পড়লে খুব মর্মাহত হই।
মনে প্রাণে এও বিশ্বাস করি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার রক্ত যার শরীরে বহমান, সেই সন্তান কখনোই কারো দয়ায় বা কোন বাড়তি সুবিধা নিয়ে কোন কিছু ভোগ করবেন না। তিনি কখনোই কারো করুণার পাত্র হতে চাইবেন না। যা কিছু করবেন নিজের যোগ্যতায়ই করবেন। শুধু শুধু কেন তাদেরকে সবার সামনে ছোট করা হচ্ছে? অসম্মান করা হচ্ছে?
আচ্ছা, ঠিক আছে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য কিছু করতে চাইছেন তো। ভালো কথা। সেটা যদি মনে প্রাণে সঠিকভাবে করতে চাইলে, একটা প্রস্তাবনা রইলো: প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানদের ছোটকাল থেকে স্পেশাল বৃত্তির ব্যবস্থা করে পড়ালেখা করানো, প্রয়োজনে উন্নত মানের আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে মেধাবী করে গড়ে তুলুন। তারপর অনায়াসেই তারা প্রতিযোগিতায় মেধাবী হিসেবে স্থান পাবে। শুধু শুধু তাদেরকে করুণা করবেন না।
প্রতিবছর কোন প্রতিযোগিতামূলক জাতীয় পরীক্ষার পর খবর বের হয়, দরিদ্রতায় জর্জরিত অন্যের জমিতে কাজ করার ফাঁকে পড়ালেখা করা, ভ্যানচালক/অন্যের বাড়িতে ঝি-এর সন্তান, রিক্সাঅলার সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলসহ বিভিন্ন জায়গায় নিজ নিজ মেধায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। একবার এদের কথা ভাবুন। যে পারার সে সব জায়গায়, সব পরিবেশেই পারে। একজন সত্যিকারের মেধাবী হতে হলে মনের মধ্যে প্রবল ইচ্ছা শক্তি ও অদম্য জানার স্পৃহা থাকতে হয়।
সবশেষে ব্যক্তিগত মতামত। কোটা সিস্টেম পুরোপুরি ১০০% উঠিয়ে দেয়া উচিত। এদেশের প্রত্যেকটা নাগরিককে তার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান নিশ্চিত করুন। তাহলে আর কোটা সিস্টেমের প্রয়োজন পড়বে না, আন্দোলনও হবে না। ৪৭ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের গালমন্দও হজম করতে হবে না।
স্মার্ট শব্দটার মানে হলো যুগের সাথে মানানসই হয়ে, সংস্কার-সহযোজন-বিয়োজন করে মানিয়ে চলা। যারা চলতে পারেন তারা এগিয়ে যান, আর যারা চলতে পারেন না, তারা পিছাতে পিছাতে নিজেকে দেয়ালে ঠেকিয়ে দেন। আমাদের অবস্থাটাও এরকম। আমরা কি যুগের তালে মানানসই সিস্টেমের সামনে আগাবো না-কি চেতনা নাশক বড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে থাকবো।
বি.দ্র: আজকে আন্দোলনে যারা মার খাচ্ছেন তাঁরাই একদিন পাবে বীরের মর্যাদা, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।