‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি’, রণাঙ্গনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা এই গানের মতো মন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে প্রজন্মের জন্য সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে লড়েছিলেন। একাত্তরে পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে বিজয় নিয়ে আসা বাংলার এসব দামাল ছেলেদের বয়স এখন ষাটের কোঠায়। একটি ফুলকে বাঁচিয়ে তারা বাংলাদেশ নামের বাগান গড়েছিলেন ৪৬ বছর আগে। এই বাগানে ফুলের কলি হয়ে ফুটছে নতুন প্রজন্ম।
মাথা উঁচু করে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পাওয়া প্রজন্মের মনে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রয়েছে বিনম্র শ্রদ্ধা। তাদের মুক্তিযোদ্ধা বাবা, দাদা-নানার হাত থেকে মুক্তির মশাল বহনের দৃপ্ত প্রত্যয়ের প্রকাশ দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিদর্শন বইতে।
জাতির গৌরবের-সংগ্রামের সংগ্রহশালায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-স্মারক যেন একাত্তরে বাবার সঙ্গে রণাঙ্গনে নিয়ে যায় টুটুলকে। নরসিংদীর শিবপুর থেকে ঢাকায় এসে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে পরিদর্শন বইতে মাহফুজুর রহমান টুটুল লিখেছেন: একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে এই সংগ্রহশালাটি পরিদর্শন করে আমি মুগ্ধ, প্রচণ্ডভাবে আবেগতাড়িত। অনেক কিছুর মাঝেই যেন যুদ্ধকালীন সময়ের আমার বাবার স্পর্শ পেয়েছি। আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
সৈয়দপুরের ডা. জিকরুল হক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জিতে এক জনসভায় দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন দিতে প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে জীবন দিয়েই কথা রেখেছিলেন দেশমাতার এই বীর সন্তান। ২০০১ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়।
এ বছরের আগস্ট মাসের ২৯ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসে পরিদর্শন বইতে শহীদ ডা. জিকরুলের সন্তান মুজিবুল হক লিখেছেন: আমার পিতা শহীদ ডা. জিকরুল হক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ও ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি সৈয়দপুর শহরের একজন জনপ্রিয় চিকিৎসক ও সমাজসেবক ছিলেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভের পর সৈয়দপুর হাইস্কুল মাঠে এক জনসভায় বলেছিলেন: পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সহজেই বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করবে না। এর জন্য আমাদের অনেক ত্যাগ ও রক্ত দিতে হবে। এদেশের স্বাধীনতার জন্য যদি জীবন দিতে হয় তাহলে আমি ডা. জিকরুল হক নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত।
বাবা কথা রেখেছিলেন জানিয়ে পরিদর্শন বইতে ডা. জিকরুলের সন্তান লিখেছেন: তিনি নিজের জীবন দিয়ে আমাদেরকে একটি ভূ-খণ্ড ও লাল সবুজের পতাকা দিয়ে গেছেন। আজ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসে রণাঙ্গনের স্মৃতিগুলো দেখলাম। স্মৃতিগুলো এখনও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস ও লক্ষ লক্ষ শহীদের স্মৃতিগাঁথাগুলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থান ও দেখার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। সেজন্য তাদের জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিজের বাবার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা জানতে পেরে গর্বিত মাসুম লিখেছেন: গণহত্যার বিমর্ষতা দেখিনি, দেখিনি স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার বিজয় উল্লাস। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে বাবার মুখ থেকে পাকিস্তানিদের বর্বরতা ও মুক্তিযোদ্ধা দুঃসাহসিক অভিযানের কথা শুনেছি। আজ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে সত্যি গর্ব হচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধা নানার বীরত্বের শোনা গল্পগুলো বাস্তব হয়ে ওঠার অনুভূতি লিখেছেন ঢাকার কদমতলীর সুমাইয়া। তিনি লিখেছেন: আমি সুমাইয়া আক্তার রাত্রি, ঢাকার কদমতলী থেকে এসেছি। আমার নানা নায়েক সুবেদার মো. জহিরুল ইসলাম বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি। আজ সেসব গল্পের বাস্তবতা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দেখলাম।
মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্মের গর্ব-শ্রদ্ধায় আর প্রত্যয়ে ভরা মন্তব্য লেখা আছে ৭’শ পৃষ্ঠার পরিদর্শন বইগুলোতে।
জাদুঘরের শিক্ষা ও প্রকাশনা ব্যবস্থাপক সত্যজিৎ রায় মজুমদার চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান: এ বছর এপ্রিলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সেগুনবাগিচা থেকে আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবনে বড় পরিসরে যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত মন্তব্যের জন্য খোলা দু’টি পরিদর্শন বই একাত্তর দেখা মানুষদের স্মৃতি এবং পরবর্তী প্রজন্মের পরিচয় খুঁজে পাওয়া মন্তব্যে পরিপূর্ণ হয়েছে। এ মাসেই তৃতীয় পরিদর্শন বইটি খোলা হয়েছে। এই বইটিও মন্তব্যে পূর্ণ হবে বিজয়ের এই মাসে।