চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর চলচ্চিত্র: বিগত দশ বছরের খতিয়ান

২০১০ থেকে ২০২০। এই দশ বছরে বাংলা ভাষায় নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন জনরার চলচ্চিত্র। তারমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর ছবির সংখ্যা অতি নগন্য। এই দশকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে হাতেগোনা। যদিও বরাবর বলা হয়, ‘নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পৌঁছে দিতে শিল্প, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে গুরত্ব দেয়ার বিকল্প নেই!’

বাস্তবে এমন কথার প্রয়োগ ঠিক উল্টো, অন্তত চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে! প্রতি বছর গড়ে ৪০-৫০ টি চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেও বিগত দশ বছরে অন্তত ৪০০-৫০০ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। অথচ এরমধ্যে উল্লেখ করার মতো ১০টি মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। যদিও বিগত ৪৯ বছরে মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর ছবির সংখ্যা সাকুল্যে ৫০-এর একটু উপরে!

কিন্তু কেন মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে ঝোঁক কম নির্মাতাদের? তার জবাবও বিভিন্ন সময়ে দিয়েছেন এই সময়ের নির্মাতারা। বেশির ভাগই বলেছেন, যুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হলে যে বাজেট প্রয়োজন, তার বরাদ্দ নেই। আবার অনেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মত-বিভেদ মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর চলচ্চিত্র তৈরিতে অন্তরায় বলে মনে করেন।

তবে প্রতিবন্ধকতা যাই হোক, আগামীতে সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে অন্যান্য জনরার ছবির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বীর গাঁথা রচিত হবে চলচ্চিত্রেও, এমন আশাবাদ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবার।

গত দশ বছরে মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর যে চলচ্চিত্রগুলো সাড়া ফেলেছে, দেখে নেয়া যাক ছবিগুলো সম্পর্কে:

গেরিলা:
সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলতি দশকের মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর সবচেয়ে সাড়া জাগানো ছবি ‘গেরিলা’। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত এই সিনেমা পরিচালনা করেছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। ছবিতে অভিনয় করেছে এটিএম শামসুজ্জামান, জয়া আহসান, ফেরদৌস, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা সহ আরও অনেকে। ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত গেরিলা ছবিটি বাণিজ্যিক ভাবেও দারুণ সফলতা পায়। ছবিটি ২০১১ সালে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অংশগ্রহণ করে এবং ১৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০১১-এ নেটপ্যাক পুরস্কার জিতে নেয়।

আমার বন্ধু রাশেদ:
২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ছবিটি মুহম্মদ জাফর ইকবাল রচিত শিশুতোষ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে। ছবিটি পরিচালনা করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। ১৯৭১ সালে মফস্বল শহরের কয়েকজন কিশোর কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তারই কিছু চিত্র ফুটে উঠেছে গল্পে। ছবিতে অভিনয় করেছে চৌধুরী জাওয়াতা আফনান। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইনামুল হক, হুমায়রা হিমু, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, আরমান পারভেজ মুরাদ। এছাড়াও শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছে রায়ান ইবতেশাম চৌধুরী, কাজী রায়হান রাব্বি, লিখন রাহি, ফাইয়াজ বিন জিয়া, রাফায়েত জিন্নাত কাওসার আবেদীন।

জীবনঢুলী:
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা যে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তারই এক চলমান দলিল ‘জীবনঢুলী’। ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিটি নির্মাণ করেন গুণী নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল। ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন শতাব্দী ওয়াদুদ।

মেঘমল্লার:
কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোট গল্প ‘রেইনকোট’ অবলম্বনে ‘মেঘমল্লার’ নামের ছবিটি মুক্তি পায় ২০১৪ সালে। যার চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেন জাহিদুর রহিম অঞ্জন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্ষার টানা তিন দিনের কাহিনি নিয়ে ‘মেঘমল্লার’ ছবির বিয়োগান্ত আখ্যান গড়ে উঠেছে। এতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন শহীদুজ্জামান সেলিম। সরকারি অনুদানে নির্মিত এবং বেঙ্গল এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডের প্রযোজনায় চলচ্চিত্রটি পরিবেশনা করে বেঙ্গল ক্রিয়েশন্‌স।

অনিল বাগচীর একদিন:
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর অনিশ্চয়তা, মানবিকতা, স্বপ্ন, সম্প্রীতি প্রভৃতি অণুষঙ্গগুলো সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে ‘অনিল বাগচীর একদিন’ নামের এই চলচ্চিত্রটির মধ্য দিয়ে। একই নামে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিটি প্রযোজনা করেছে বেঙ্গল ক্রিয়েশনস। ছবিতে অনিল বাগচীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরেফ সৈয়দ। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন গাজী রাকায়েত, তৌফিক ইমন, জ্যোতিকা জ্যোতি, ফারহানা মিঠু, এবং মিশা সওদাগর।

বাপজানের বায়োস্কোপ:
তরুণ নির্মাতা রিয়াজুল রিজু পরিচালিত ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আলোচিত ছবি ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’। কারুকাজ ফিল্মস-এর ব্যানারে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে গাঁথা এই সময়ের এক বাস্তব গল্পে নির্মিত একটি ছবি। যার কাহিনী লিখেছেন মাসুম রেজা এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন মাসুম রেজা ও রিয়াজুল রিজু। ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, শতাব্দী ওয়াদুদ ও সানজিদা তন্ময়। ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট আটটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।

ভুবন মাঝি:
একজন সাধারণ মানুষের জীবনে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার গল্প ‘ভুবন মাঝি’। গল্পের শুরু ১৯৭০ সাল, শেষ ২০১৩। ১৯৭১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ইতিহাস ও প্রেম, বিদ্রোহ ও মানবিকতা, স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি এসব নিয়ে গড়ে উঠেছে ছবির গল্পে। ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিটি রচনা ও পরিচালনা করছেন ফাখরুল আরেফিন খান। ছবির তিন কেন্দ্রীয় চরিত্র কলকাতার পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, বাংলাদেশের অপর্ণা ঘোষ ও মাজনুন মিজান।

রীনা ব্রাউন:
প্রেম, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, বিচ্ছেদ এবং এই সময়ের বাংলাদেশ নিয়েই নির্মিত হয়েছে ‘রীনা ব্রাউন’। যদিও পরিচালক এটিকে শুধু মুক্তিযুদ্ধের একটা গল্প হিসেবে দর্শকের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে রাজি নন। বরং ‘রীনা ব্রাউন’ এমন একটি সময়ের প্রেক্ষাপট নিয়ে নির্মিত যেখানে দুজন মানুষের ভালোবাসা, প্রেম আর বিরহগুলোও সুঁচালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সরকারি অনুদানে নির্মিত ‘রীনা ব্রাউন’ ছবির সহ–প্রযোজক ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। ‘রীনা ব্রাউন’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রমা পাবনী। আরও অভিনয় করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বরুণ চন্দ, সাবেরি আলম, আতাউর রহমান, শম্পা রেজা, মানস চৌধুরী, তানভীর হোসেন প্রবাল, মাহফুজ রিজভী প্রমুখ।

এছাড়াও গত দশ বছরে আলোচনায় ছিলো রুবায়েত হোসেনের মেহেরজান, আনোয়ার হোসেনের কারিগর, গোলাম মোস্তফা শিমুলের অনুক্রোশ, মান্নান হীরার একাত্তরের ক্ষুদিরাম, শাহ আলম কিরনের ৭১-এর মা জননী, মানিক মানবিকের শোভনের স্বাধীনতা, মুশফিকুর রহমান গুলজারের লাল সবুজের সুর এবং আবির খান ও রাশেদ শামীম স্যামের পোস্ট মাস্টার-৭১।