চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর: ভার্চুয়াল জগতে সহযোগিতা শুরুর ক্ষণ

চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্ডেরা বলেছেন, সভ্যতার সংগ্রাম হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। বাংলাদেশের অগণিত মানুষের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহায়তায় বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির ধারক এবং বাহক হয়ে ওঠার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ সেগুনবাগিচায় ছোট্ট পরিসরে একটি ভাড়া বাড়িতে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস বহন করা প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। একেবারে সূচনা লগ্নেই বহু মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্মৃতিরক্ষার এই উদ্যোগে। ছোট-বড় নানা সহযোগিতা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে একটা সার্থকতা দিয়েছিল একবারে প্রথম দিন থেকে। তারপর জাদুঘর ক্রমেই প্রসারিত হয়েছে। সেই প্রসারের বড় পরিচয় আজকের এই স্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এই জাদুঘর নির্মিত হয়েছে সরকারের এবং এদেশের মানুষের আর্থিক সহায়তায়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ড স্থায়ী ভবন নির্মাণের সময় একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, স্বদেশের অর্থায়নেই এই জাদুঘর নির্মিত হবে। কোন বিদেশি সহযোগিতা নেয়া হয়নি। বিদেশি সাহায্য সহযোগিতা বিভিন্ন সময় আমরা সাদরে গ্রহণ করি, তবে এই নির্মাণের সময় দেশের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য।

এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থায়ী কাঠামো তৈরি হয়েছে, তবে এর প্রসার, প্রচার, বিস্তার, বিকাশের জন্য অনেক পদক্ষেপ নেয়া দরকার। অনেক অর্থ প্রয়োজন, অনেক রকম সম্পৃক্তি প্রয়োজন।

সারাদেশে কোটি মানুষের বিচরণ এখন অন্তর্জাল জগতে বা ইন্টারনেট দুনিয়ায়। এই প্রজন্মের কলকাকলীতে মুখরিত ইন্টারনেট জগৎ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারকগুলো ইন্টারনেট দুনিয়ার প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে তাদেরকে ইতিহাস জানায় আগ্রহী করতে পারে। সেই লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেয়া যায়। মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের সহায়তায় নতুন একটি উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠিকে ইতিহাসের পরিক্রমায় সংযুক্ত করতে পারা যাবে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওয়েবসাইটে একটি বিশেষ পাতা সংযুক্ত হয়েছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময়ের দশটি স্মৃতি স্মারকের বিবরণ ও ছবি উপস্থাপিত হয়েছে। প্রতিটি স্মারকের সাথেই জড়িয়ে আছে বিশাল ইতিহাস, বিশাল ঘটনা, বহু কিছু। এই বিশেষ পাতায় খুব সামান্য-চুম্বকাকারে স্মারকগুলোর তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। যারা এই সাইটে আসবেন এই স্মারকগুলোর পরিচয় তারা পাবেন। এই পরিচয় তাদেরকে ইতিহাসের আরো গভীরে নিয়ে যাওয়ার একটা আহ্বান জানাচ্ছে।

শুরুতে বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফ, শহীদ আজাদের বুলেটবিদ্ধ বই, শহীদ বাকীর চিঠি, নির্যাতিত বীরাঙ্গনার যন্ত্রণাক্লিষ্ট ছবি, জর্জ হ্যারিসনের নিজ হাতে লেখা বাংলাদেশ গানের কপি, জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্ম, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রচারিত লিফলেট, সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া ছোট্ট মেয়ে স্বাতী চৌধুরীর বর্ণনায় একাত্তরের পঁচিশ মার্চের কালরাত্রি-সহ দশটি স্মারকের বিবরণ সংযুক্ত হয়েছে। আশা করা যায়, ক্রমান্বয়ে অনলাইন স্মারক উপস্থাপন আমরা আরো বাড়িয়ে তুলব। একটা সময়ে এসে আমরা হয়ত এমন একটা ভার্চুয়াল জাদুঘর গড়ে তুলতে পারব, যেটাকে বলা হয় মিউজিয়াম উইদাউট ওয়ালস। সূচনায় হয়ত ১০০টি স্মারক এই ভার্চুয়াল জাদুঘরে সংযুক্ত করতে পারবো, যেগুলো থেকে গোটা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কথা বলে উঠবে।

২০১০ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পক্ষ থেকে একটা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল যার শিরোনাম ছিল ‘হিস্ট্রি অব দা ওর্য়াল্ড থ্রু হানড্রেড অবজেক্টস’। যারা জাদুঘরের সঙ্গে জড়িত তাদের জন্য এই বইটি এক অসাধারণ দিগন্ত উম্মোচন করেছিল। আমরা হয়ত কোন একদিন ‘হিস্ট্রি অব লিবারেশন ওয়ার থ্রু হানড্রেড অবজেক্টস’ শিরোনামে একটা প্রকাশনা আনতে পারব। তা কেবল গ্রন্থ নয়, অনলাইনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের বার্তা বয়ে নিয়ে যাবে।

এই বিশেষ পাতায় ইতিহাস জানার পাশাপাশি রয়েছে অনুদান প্রদানের ব্যবস্থা। খুব ছোট্ট অঙ্ক, মাত্র ১০০ টাকা অথবা ৫০০ বা ১০০০ টাকা বিকাশের মাধ্যমে এখন খুব সহজেই দেশের যেকোন স্থান থেকে যেকোন সময় যে কেউ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তহবিলে প্রদান করতে পারবে। এই উদ্যোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে https://www.liberationwarmuseumbd.org/bkash/লিংকে ক্লিক করতে হবে।

‘ক্ষুদ্র প্রয়াস রক্ষা করবে ইতিহাস’ শিরোনামের এই উদ্যোগ কেবল আর্থিক অনুদান দেওয়ার বা গ্রহণের একটা প্রয়াস, তা নয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর যেভাবে স্মারক সংগ্রহ করছে, যেভাবে বহু মানুষ স্মারকগুলো দিচ্ছে, সেসব স্মৃতি যেন সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয় এবং স্মৃতিগুলো যেন কথা বলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, সে উদ্যোগ থেকেই এ বিশেষ পাতাটি চালু করল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

এখন ইন্টারনেট দুনিয়ায় একজন থেকে আরেকজন, সেখান থেকে বহু জন, এভাবেই সম্ভাবনার দিগন্ত উম্মোচিত হোক। জাদুঘরের অনেক কাজ এখনও বাকি রয়েছে। অনেক পরিকল্পনা জাদুঘর গ্রহণ করছে। এই কাজে আর্থিক অনুদান এবং তার সাথে মানসিক সংশ্লিষ্টতা দুটোই এখানে ঘটবে। ফলে আমরা আশাবাদী, জাদুঘরের শক্তির একটা নতুন বিস্তার হবে এখানে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)