বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চীনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় ১১ই জুলাই ইয়াহিয়ার প্রতি চৌ এন লাইয়ের চিঠির মাধ্যমে। পিপলস ডেইলিতে সোভিয়েত প্রক্রিয়ার সমালোচনা করা হয় বাংলাদেশকে সমর্থন দানের জন্য। চৌ এন লাই পাকিস্তানের ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ ও “রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায়” চীনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথা জানান। জেনারেল ইয়াহিয়া খান শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন, চায়নার রেডগার্ডরা পূর্ব পাকিস্তানে এসে তার সৈন্যদের পাশে দাঁড়াবে। এরপর পূর্বপাকিস্তান থেকে বাঙালিদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মিশনটি তার পরিপূর্ণতা লাভ করবে।
এ বিষয়ে ‘অঘোষিত যুদ্ধ হচ্ছে : ভারত হামলা করলে চীন হস্তক্ষেপ করবে’ শিরোনাম সম্বলিত একটি সংবাদ ইয়াহিয়ার উদ্ধৃতিক্রমে ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আগের দিন প্রদত্ত সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রণীত সেই প্রতিবেদনটি এখানে তুলে ধরা হলো : (করাচি, ৮ নভেম্বর, পিপিআই), ভারত পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ চালালে গণচীন যেভাবে পারে পাকিস্তানকে সাহায্য করবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গত শুক্রবার লাহোরে কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের প্রতিনিধি টমাস ফেল্টনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, ভারত পাকিস্তানে আক্রমণ চালালে অবশ্যই চীন হস্তক্ষেপ করবে’।
কিন্তু লী বিনের কারণে তা আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। পাকিস্তান ও ভারত কি যুদ্ধের কাছাকাছি এসেছে, এ প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেন, এর মধ্যেই একটা অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান ভারতের প্রতি অসাধারণ সহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে। কিন্তু ভারত তাদের সীমান্তে অব্যাহতভাবে গোলাবর্ষণ করে চলেছে (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, সপ্তম খ-, পৃষ্ঠা ২১৯)।
সে সময় ইয়াহিয়ার মতো পূর্ব পাকিস্তানে আগ্রাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত পাক জেনারেল, স্থানীয় দালাল এবং বিহারিদের কাছে গণচীন ছিল আস্থা এবং স্বপ্নের এক মহাসমুদ্র। ঢাকায় বসে যেমন জেনারেল নিয়াজিরা উত্তরের দিকে তাকিয়ে থাকত, তেমনি আমাদের জনপদের বিহারিরাও সূর্যোদয়ের পর থেকে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে তাকিয়ে থাকত হিমালয়ের দিকে।
চীনাদের প্রশংসায় বিহারিরা থাকত পঞ্চমুখ। বাঙালিদের হেয় ও চীনাদের স্তুতির জন্য তারা এ সম্পর্কিত কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেই বলত, ‘হুজ্জতে বাঙাল হিকমতে চীন।’ আমাদের বেঁচে থাকার অধিকারের দাবি, আন্দোলন, সংগ্রাম ওদের কাছে ‘হুজ্জত’ হিসেবে প্রতিপণ্য হতো। ওই কালপর্বে তারা একে অপরের সঙ্গে বাতচিত করার সময় অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে বলত, ‘আয়েগা, ওলোগ জরুর আয়েগা, নাটা নাটা ফৌজ, দিলমে দ্যম হ্যায়, হিম্মত হ্যায়, জিসমমে তাগাত হ্যায়, ওলোগ আনে কা বাদ সাব কুছ সামাল লে গা, মুক্তিলোগ চুহে কি তারাহ গাড্ডামে ঘুস যায়েগা।’
এদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাকিস্তান দরদি আলতাফ চাচিও পরম আস্থায় আশায় বুক বেঁধে উত্তরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন আর আমাদের অবগতির জন্য জানাতেন, ‘আসতেছে, ওরা রওয়ানা হয়ে গেছে, কয়েক দিনের মধ্যে ওরা পূর্ব পাকিস্তানে আসি যাবে, হিমালয়ের মতো উঁচা পাহাড় ডিঙায়া আসতেছে তো তাই একটু সময় লাগতেছে, ওরা আসি গেলেই সব কিছু ঠিক হয়া যাবে।’
চাচির কথা শুনে মনে হতো ওরা আগমনের আগে তার সঙ্গে কথা বলেই পিকিং (এখনকার বেইজিং) থেকে রওনা দিয়েছে। বাবাকে এ ধরনের আশঙ্কার কথা জানালে বা কারো মুখে এ ধরনের কথা শুনলে তিনি তা হেসে উড়িয়ে দিতেন। তিনি বলতেন, ‘চীন যেন ভারতের ওপর দিয়ে এদিকে আসতে না পারে বা ভারতকে আক্রমণ করতে না পারে, সে জন্যই তো ‘ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীন এদিকে অগ্রসর হলেই পশ্চিম দিকে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যরাও তাদের দেশের দিকে ধাবিত হবে। এ কারণে চীন কখনো বোকার মতো এদিকে আসার কথা চিন্তাও করবে না।’
বাবার এ ধরনের আশ্বাস সত্ত্বেও বিহারি ও স্থানীয় দালালদের কথা শুনে মাঝেমধ্যে ক্ষুদ্র হৃদয়ে ভীতি সঞ্চারিত হতো।
১৯৭১ সালের জুন মাস থেকে পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে চীন প্রতিদিন ১০০টি লরি ভর্তি সামরিক সরঞ্জাম পাঠায়।এছাড়া স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে গেরিলা যুদ্ধবিরোধী প্রশিক্ষণদেয়ার জন্য বিশেষজ্ঞও পাঠায় তারা। শুধু ৭১ সালেই চীন পাকিস্তানকে প্রদান করেছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক উপকরণ। যার বেশীরভাগ ব্যবহার করা হয়েছিল বাঙালি নিধনে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও চীনের বৈরীতা শেষ হলো না। স্বাধীনতার পরপরই ঢাকাস্থ চীনা কন্স্যাল অফিস তারা বন্ধ করে দেয়। ৭২ সালের ২১ শে আগস্ট চীন বাংলাদেশের জাতি সংঘ সদস্যভুক্তির প্রশ্নে প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে। ৭১ সালের স্বাধীনতাকে চৌ এন লাই “এক অন্তহীন যুদ্ধের সুচনামাত্র ‘’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তারই অংশ হিসেবে চীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ‘ক্রমাগত অস্থিতিশীল পরিস্থিতি’ বজায় রাখার কৌশল গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরদিন ১৬ ই আগস্ট ১৯৭৫ চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
স্বাধীনতার পরপর সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি ‘স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ভারতের পদাবনত হয়েছে’উল্লেখ করে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েমের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আহবান জানায়। মাওলানা ভাসানী দেশে ফিরে আসার পরে ‘হক কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন, যার সম্পাদক ছিলেন একজন কলাবারেটর (দালাল)।
হক, তোহা, মতিন, আলাউদ্দিন, দেবেন সিকদার, শান্তি সেন, অমল সেন প্রমুখের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের নেতাগণ ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ স্লোগান দিয়ে শ্রেণী শত্রু খতমের নামে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির পথ বেছে নেন। মাওলানা ভাসানী এদের নেতা সেজে পল্টনের জনসভায় হুঙ্কার দিলেন, ‘আমি নতুন পতাকা ওড়াবো’। এই ঘোষণার পরপর জুলফিকার আলী ভুট্টো ভাসানীকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণপত্রে “মুসলিম বাংলা” প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ভাসানীর সহযোগীতা কামনা করেন। জামাতে ইসলাম, পিডিপি, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগের নেপথ্য শক্তিকে আড়ালে রেখে ভাসানী গঠন করেন “ হুকুমতে রব্বানী”। যার উদ্দেশ্য ছিল চরম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা।
এদের সমর্থনে বিভিন্ন সভা সমিতিতে প্রকাশ্যে হাত তুলে দোয়া করেন ‘মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য যারা কাজ করছেন তাদের আমি দোয়া করছি। আল্লাহর রহমতে তারা জয়যুক্ত হবেন’। এই মুসলিম বাংলার স্লোগানটি ভুট্টো প্রদত্ত যা ঐ সময়ে রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত হতো।
জাতীয় চার নীতি গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র,ধর্মনিরেপেক্ষতার উপরে ভিত্তি করে রচিত সংবিধানের সমালোচনা করে তিনি ঘোষণা দেন , “এই সংবিধান. মানি না। বাংলাদেশের সংবিধান কোরান হাদিসের উপর ভিত্তি করে রচিত হতে হবে”।
শুধু তাই নয় ,পল্টনের জনসভায় তিনি হুংকার দিয়ে বলেন , “বাংলাদেশকে আমি ভিয়েতনামে পরিণত করে ছাড়বো” স্বাধীনতার পরে যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে সবার সহযোগীতায় যখন দেশ গড়ার সংগ্রামের প্রয়োজন ছিলো তখন তিনি বারবার বলতে লাগলেন “আমি এই দেশে প্রতিবিপ্লব ঘটাবো”! সারাজীবন নিপীড়িত মানুষের জন্য সংগ্রাম করা ভাসানী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এভাবে চরম সাম্প্রদায়িক ৭১ এর পরাজিত শক্তি ও উগ্র চৈনিকপন্থীদের ক্রীড়ানক হয়ে গেলেন।
তথ্যসূত্র:
-বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ফ্যাক্টস এণ্ড ডকুমেন্টস
-অধ্যাপক আবু সায়ীদ-মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাকের কলাম
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)