চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মুক্তিযুদ্ধে অধিনায়ক আকবর হোসেন এবং তাঁর বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় পর্যায়ে যে সব আঞ্চলিকবাহিনী গড়ে উঠে তার মধ্যে অন্যতম ‘শ্রীপুরবাহিনী’ তথা ‘আকবরবাহিনী’।

এই গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক বাহিনী গড়ে উঠেছিল তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার শ্রীপুর থানাতে। শ্রীপুর থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবং শ্রীকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টুপিপাড়া গ্রামের মিয়া আকবর হোসেনের সুদক্ষ নেতৃত্বে এই বাহিনী গঠিত হয়।

এই বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন তিনি। যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত পাক হানাদার এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে এই বাহিনীকে পরিচালনা করেন অধিনায়ক আকবর হোসেন। তাঁর সুদক্ষ কমান্ডেই বাহিনী পরিচালিত হয়। এই বাহিনীতে এক হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগী ছিল।

যুদ্ধ শুরুর পরপরই আকবর হোসেন আরেক সাহসী আওয়ামী লীগ নেতা, সহযোদ্ধা মোল্লা নবুয়ত আলী এবং বন্ধু মৌলভী নাজায়েত খোন্দকারকে পাশে রেখে শ্রীপুর থানা আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে এই বাহিনীকে সংগঠিত করেন। কিন্তু দ্রুতই ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, রাজবাড়ি, ঝিনাইদহ, মাগুরাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে বিদ্রোহ করে আসা সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, মুজাহিদ সদস্যরা এই বাহিনীতে যোগ দিলে এই বাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। পরবর্তীতে আশেপাশের বিভিন্ন থানা থেকে তরুণ যুবকরা এসে গোপনে এই বাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধকালীন সময়ে ছোট-বড় ত্রিশটিরও বেশি ছোট বড় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন এই বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এই বাহিনী কখনও সম্মুখ আবার কখনও গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করে বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনী এবং তাদের দোসরদের পরাস্ত করে।

এই বাহিনীর দুঃসাহসী সব যুদ্ধ মাগুরা, রাজবাড়ি, ঝিনাইদহ যুদ্ধ ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছে। এখনও সাধারণ মানুষের মুখে এই বাহিনীর গল্প শোনা যায়। এই বাহিনীর কারণেই একাত্তরে মাগুরার শ্রীপুর থানা কার্যত ছিল মুক্তাঞ্চল। পাকবাহিনী এবং রাজাকাররা কখনই শ্রীপুরে তাই স্থায়ীভাবে সক্রিয় থাকতে পারেনি। শ্রীপুরে কোনো রাজাকার ক্যাম্প গড়ে তুলতে পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়। তবে এই বাহিনী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের প্রতি এতোটাই অবিচল ছিল যে, শুধু নিজ এলাকাতেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা নয় একই সাথে মাগুরা সদর, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, ঝিনেদার বিরাট অংশ পাক হানাদার মুক্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নিজ এলাকার বাইরে গিয়ে ফরিদপুর, রাজবাড়ি, ঝিনেদার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে পাক আর্মিদের ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে দখল করে নেয়। স্বভাবতই এই বাহিনী পাক হানাদারদের কাছে ছিল এক মহা আতংক। এ কারণেই বাহিনীর প্রধান আকবর হোসেনকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল পাক হানদাররা। একাত্তরে এই বাহিনীর গড়ে উঠা, শক্র প্রতিরোধ, রণকৌশল, গেরিলা যুদ্ধ দারুণভাবে প্রশংসিত হয়। এই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধকালীন সময়ে ৮ নম্বর সেক্টর কর্তৃক এই বাহিনী বিশেষভাবে স্বীকৃতি লাভ করে।

মুক্তিযুদ্ধ এবং আকবরবাহিনীর আত্মপ্রকাশ:
শ্রীপুরবাহিনী তথা আকবরবাহিনী যার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা অধিনায়ক আকবর হোসেনের জন্ম মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার খামারপাড়া গ্রামে। শ্রীপুর উপজেলা মাগুরা সদর উপজেলা থেকে পনেরো কিলোমিটার উত্তরে। প্রথম জীবনে আকবর হোসেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকরি নিলেও পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ করে ৫৪ সালের ৮ আগস্ট চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে নিজ গ্রামে চলে আসেন। এরপর তিনি স্থানীয় সাধারণ মানুষের সেবা করার অভিপ্রায়ে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দেন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের থানা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি নিজ ইউনিয়ন শ্রীকোলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং টানা ২৪ বছর স্বপদে থাকার অনন্য কৃতিত্ব দেখান। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে আকবর হোসেন মিয়া সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিজ থানা শ্রীপুরেই ছিলেন।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আওয়ামী লীগ নেতা আকবর হোসেন নিজের দলীয় কর্মী এবং এলাকার তরুণদের নিয়ে যুদ্ধের জন্যে মানসিকভাবে তিনি তৈরিও হতে থাকেন। ২৫ মার্চ রাতে পাক আর্মিরা ঢাকায় বাঙালির ওপর অতর্কিত হামলা চালালে তিনি তৎক্ষণাৎ সহযোগীদের নিয়ে সভা করে থানা সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন এবং সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে অনুরোধ করেন। দ্রুতই নিজ থানা শ্রীপুরের বরিশাল গ্রামের মোল্লা নবুয়ত, খামারপাড়া গ্রামের সহযোদ্ধা খন্দকার সুজায়েত আলী, মৌলভী নাজায়েত আলীসহ শত শত তরুণদের সাথে নিয়ে মাগুরার সর্বত্র পাক হানাদারদের প্রতিরোধের পরিকল্পনা নেন। এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্রলীগের বড় একটি দল নিয়ে প্রথমে মাগুরাস্থ আনসার ক্যাম্প দখলে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু করেন। মুহূর্তেই আকবর হোসেনের সাহসী নেতৃত্বের কথা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। মুক্তিকামী মানুষের মাঝে তাঁকে ঘিরেই নূতন এক প্রাণের সঞ্চার হয়। মাগুরা, মহম্মদপুর, রাজবাড়ি, পাংশাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর সাহসী ভূমিকার কথা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে তরুণরা পালিয়ে এসে তাঁর দলে যোগ দিতে থাকে। তাঁর বাহিনী দ্রুতই মাগুরার মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দেশপ্রেমিক সাধারণ জনতার কাছে এক অন্যরকম আস্থায় পরিণত হন। এদিকে তিনি সহসাই কাছে পান একদল সাহসী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যোদ্ধা। যারা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিদ্রোহ করে অস্ত্রসহ পালিয়ে এসে তাঁর সাথে দেখা করেন তাঁর বাহিনীতে যোগ দেন। ফলে অচিরেই তাঁর বাহিনী দারুণভাবে সংগঠিত হয়ে পড়ে।

একই সাথে তিনি কাছে পান সাহসী অকুতোভয় কিছু মুক্তিযোদ্ধা। এঁরা হলেন- মৌলভী খন্দকার নাজায়েত আলী (খামারপাড়া), মো. আনারুদ্দিন শেখ ( শ্রীকোল, শ্রীপুর) জহরুল আলম মুকুল (শ্রীপুর সদর, মাগুরা), সেনাবাহিনীর মো. বদরুল আলম (বেলনগর, মাগুরা), চৌধুরী জহুরুল হক (বরিশাল, শ্রীপুর, মাগুরা), ইরাদুল আখতার ফয়েজ (টুপিপাড়া, শ্রীপুর, মাগুরা), খন্দকার আবু হাসান (খামারপাড়া শ্রীপুর, মাগুরা), খন্দকার আবু হোসেন (খামারপাড়া শ্রীপুর, মাগুরা), সৈয়দ মারুফ আহমেদ (মাজাইল, শ্রীপুর, মাগুরা), নুরুল হোসেন মোল্লা (কাজলী, শ্রীপুর, মাগুরা), আব্দুল মান্নান (বালিয়াডাঙ্গা, মাগুরা), শফি জোয়ার্দ্দার (খামারপাড়া, শ্রীপুর, মাগুরা), মুন্সী গোলাম মোস্তফা (বারইপাড়া, শ্রীপুর, মাগুরা), ওলিয়ার মৃধা (খামারপাড়া, শ্রীপুর, মাগুরা), আব্দুল মালেক (আমতৈল, শ্রীপুর, মাগুরা), সিরাজুল ইসলাম খোকন (আমতৈল, শ্রীপুর, মাগুরা), ইন্তাজ আনসার (আমলসার, শ্রীপুর, মাগুরা), আবুল হোসেন (বালিয়াডাঙ্গা, মাগুরা), মনিরুল ইসলাম জেন্টেল (আমতৈল, শ্রীপুর, মাগুরা), হারেজ উদ্দিন (বগুড়া, শৈলকূপা, ঝিনেদা), আব্দুল খালেক (গাড়াগঞ্জ, শৈলকূপা, ঝিনেদা), মো. সুলতান (কাঁচেরকোল, শৈলকূপা, ঝিনেদা), নওশের আলী (দ্বারিয়াপুর, শ্রীপুর, মাগুরা), মো. মোশাররফ হোসেন (আমতৈল, শ্রীপুর, মাগুরা), মো. আনোয়ার হোসেন (কাজলী, শ্রীপুর, মাগুরা) মো. আব্দুর রশিদ (হরিন্দী, শ্রীপুর, মাগুরা), গোলাম মোস্তফা (তারাউজিয়াল, শ্রীপুর, মাগুরা), হাবিলদার জালাল উদ্দিন (বহরপুর, বালিয়াকান্দি, রাজবাড়ি), আব্দুর রাজ্জাক নান্নু (কাশিয়ানি, গোপালগঞ্জ), পুলিশ বাচ্চু মিয়া (বালিয়াকান্দি, রাজবাড়ি), গোলাম মওলা, (হবিতপুর, শৈলকূপা, ঝিনেদা), সায়েম উদ্দিন কালা (শ্রীপুর সদর, মাগুরা), হবিবর রহমান (গোপালপুর, শ্রীপুর. মাগুরা), আখতার সুলতান (বেষ্টপুর, শ্রীপুর, মাগুরা), শেখ মুক্তাদির (শ্রীকোল, শ্রীপুর, মাগুরা) মকসেদ আলী (শ্রীকোল, শ্রীপুর, মাগুরা), মনোয়ার (নোহাটা, শ্রীপুর, মাগুরা), ইপিআর মনোয়ার হোসেন (বড়বাড়ি. বগুড়া, শৈলকূপা), ইপিআর সিরাজুল ইসলাম (নারুয়া, বালিয়াকান্দি, রাজবাড়ি), মাহবুবর রহমান বাবু ( সারঙ্গদিয়া, শ্রীপুর, মাগুরা), মোল্লা মতিয়ার রহমান (কাজলী, শ্রীপুর, মাগুরা), হাফিজুর রহমান মাস্টার (খালিয়া, মোহাম্মদুপর, মাগুরা), আশরাফুল ইসলাম কালা (বরইচারা, শ্রীপুর, মাগুরা), নজরুল ইসলাম রাজু (হরিন্দী, শ্রীপুর, মাগুরা), আব্দুস সাত্তার (পুলিশ) জোকা, শ্রীপুর, মাগুরা, হাফিজুর রহমান (কাজলী, শ্রীপুর, মাগুরা), ছোট কবীর ( বরুনাতৈল, শ্রীপুর, মাগুরা), বড় কবীর (মাগুরা), নুরুল হুদা পল্টু, এফ এফ (জজকোর্ট পাড়া, মাগুরা) আবু ইশা (জজকোর্ট পাড়া, মাগুরা), সুধীর বিশ্বাস, এফএফ (পারনান্দুয়ালী মাগুরা)সহ আরো অনেকে।

যারা সাহসে বীরত্বে ছিলেন সবসময়ই অগ্রগ্রামী। এদিকে প্রতিদিনই এই বাহিনীতে এসে যোগ দিতে থাকেন বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণরা।এই বাহিনীতে শুধু শ্রীপুরই নয় মাগুরা সদর, মোহাম্মদপুর, শৈলকূপা, পাংশা, বালিয়াকান্দি এবং রাজবাড়ি সদর থানার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈনিক-পুলিশ-আনসার এবং তরুণ অংশগ্রহণ করে। লোকমুখে খবর পেয়ে দেশের আরো অন্যান্য জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসে এই বাহিনীতে যোগদান করে। গ্রামের অনেক সাধারণ কৃষক লাঙ্গল ফেলে এই বাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশ স্বাধীনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। এই বাহিনী তাই ধীরে ধীরে ‘আকবরবাহিনী’ হিসেবেই জনমানুষ তথা সাধারণ্যের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে।

এই বাহিনী গড়ে তুলতে যারা বিশেষভাবে অবদান রাখেন এবং সহযোগিতা করেন তাঁরা হলেন- প্রয়াত শাহবুদ্দিন চেয়ারম্যান (নবগ্রাম), প্রয়াত খোন্দকার সুজায়েত আলী (খামারপাড়া), প্রয়াত খন্দকার নাজায়েত আলী (খামারপাড়া), প্রয়াত আব্দুর রশিদ মিয়া (বিলনাথর), প্রয়াত কাজী ইউসুফ (আঠারোখাদা), প্রয়াত খন্দকার আব্দুল মাজেদ (শিবরামপুর), প্রয়াত আব্দুর রহিম জোয়ার্দ্দার (শ্রীপুর), প্রয়াত শাহাদত মোল্লা (কাবিলপুর), প্রয়াত মোকাররম আলী চৌধুরী (সারঙ্গদিয়া), প্রয়াত নওশের আলী চৌধুরী (সারঙ্গদিয়া), প্রয়াত ইন্তাজ বিশ্বাস (দ্বারিয়াপুর), প্রয়াত তৈয়ব মাস্টার (চৌগাছী), প্রয়াত হাফিজ মাস্টার (মোহাম্মদপুর), প্রয়াত সৈয়দ আলী মেম্বর অলংকারপুর, ফরিদপুর), প্রয়াত আব্দুল জলিল বিশ্বাস (বেলনগর), প্রয়াত কামরুজ্জামান (মীনগ্রাম), প্রয়াত মমিন ফকির (খামারপাড়া), প্রয়াত ডা. সন্তোষ কুমার (খামারপাড়া), ডাক্তার আলী আহমেদ (দাইরপোল), প্রয়াত আলী হোসেন খাঁ (রামনগর), প্রয়াত আবু বক্কার (আলফাপুর), প্রয়াত মাসুদুর রহমান (বরিশাল ব্যাপারীপাড়া), প্রয়াত চেয়ারম্যান ইয়ার উদ্দিন মোল্লা ( নাড়–য়া, রাজবাড়ি), প্রয়াত ডা. হায়াত (পাংশা)। বেঁচে থাকাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মোল্লা নবুয়ত আলী (বরিশাল), মাস্টার কাজী ফয়জুর রহমান (তখলপুর), শাহাবুদ্দিন খাঁ (দাইরপোল), আফম আবুল ফাত্তাহ (বেলনগর), আলী হোসেন মিয়া (খামারপাড়া), আবুল হোসেন (বড়তলা) সহ অন্যান্যরা।

শ্রীপুরবাহিনীর যুদ্ধ:
একাত্তরে পাকবাহিনীর সামনে দ্রুতই শ্রীপুরবাহিনী এক মহা আতঙ্ক হিসেবে পরিগণিত হয়। একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে পাকহানাদারদের দুর্গ তছনছ করে ফেলে এই বাহিনীর সাহসী যোদ্ধারা। বিশেষ করে শ্রীপুর থানা দখল, শৈলকূপা থানা আক্রমণ, রাজবাড়ির বালিয়াকান্দির রামদিয়াতে পাক সহযোগী চাঁদ খাঁর বাড়ি আক্রমণ, ইছাখাদা ও মাগুরা আনসার ক্যাম্পে হামলা, আলফাপুরের যুদ্ধ এবং বিনোদপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ-এ সবই অধিনায়ক আকবর হোসেনের সুদক্ষ দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। অক্টোবরে বিনোদপুরের যুদ্ধে এই বাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা জহরুল আলম মুকুল গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ৫ জুন শ্রীপুরের নিকটবর্তী রাজবাড়ি মহকুমার বালিয়াকান্দি থানার রামদিয়াতে পাকবাহিনীর অন্যতম সহযোগী চাঁদ খাঁর বাড়িতে এই অভিযান ছিল সর্বপ্রথম। শ্রীপুর থেকে এই বাহিনীর বড় একটি যোদ্ধা দল এই অভিযান চালাতে শ্রীপুর থেকে পায়ে হেঁটে বালিয়াকান্দি থানার রামদিয়াতে আসে। অতঃপর আকবরবাহিনীর সাহসী যোদ্ধারা সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে বিহারী চাঁদ খাঁ ও তার সহযোগীদেরকে খতম করতে সক্ষম হন। পরের দিন ৭ জুন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই বাহিনীর সফল অভিযানের খবরটি গুরুত্ব সহকারে প্রচার হয় এবং এত করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা দারুণভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে সমর্থ হন। এরপর একের পর এই বাহিনী শৈলকূপা থানা, শ্রীপুর থানা আক্রমণ করে দখলে নেন। আলফাপুরের যুদ্ধে অংশ নিয়ে পাক হানাদারদের পরাস্ত করেন। এছাড়াও ইছাখাদা রাজাকার ক্যাম্প, মাগুরা আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে পাকসেনাদের পরাস্ত করেন। তবে অক্টোবরে মাগুরার মহম্মদপুর থানার বিনোপুরে রাজাকার ক্যাম্প উড়িয়ে দিতে গিয়ে এই বাহিনীর চৌকস এবং সাহসী মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল আলম মুকুল শহীদ হন।

প্রতিটি যুদ্ধেই এই বাহিনীর নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করতো। বিশেষ করে পাকিস্তানের আধুনিক সমরাস্ত্রের সামনে লোকায়ত সব কৌশল প্রয়োগ করে এই বাহিনীর যোদ্ধারা একের পর এক বিজয় ছিনিয়ে আনতো। এই কারণেই এই বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল একেবারেই কম। এই বাহিনী পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আলফাপুর, মাশালিয়া, খামারপাড়া, কাজলী, গোয়ালপাড়া রণাঙ্গনে মুখোমুখি যুদ্ধ করে পাক হানাদারদের জানমালের বহু ক্ষয়ক্ষতি করে। অনেক পাকসেনার লাশ নদী দিয়ে ভেসে গেছে। অনেকে আহত হয়েছে। বহু পাক অফিসারও এসব যুদ্ধে মারা যায়। একজনের লাশ তারা লাঙ্গলবন্ধে কবরস্থ করে যায়। শ্রীপুরের নাকোলের যুদ্ধে একজন পাক কর্নেলসহ কয়েকজন পাক সেনা নিহত হয়। আকবরবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আঘাতে আধুনিক পাক সাঁজোয়া গাড়ি পাঙচার হয়ে যায় যা তারা ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। সাঁজোয়া গাড়িটি সাহসী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা ঠেলে প্রায় দু’মাইল দূরে নিয়ে যায়। বিনোদপুর, বরিশাল, মাগুরার ইছাখাদা, মাগুরার আনসার ক্যাম্প, রাজাকার ও পাকসেনাদের আস্তানাতেও এই বাহিনী তীব্র আঘাত হানে। মহম্মদপুর ও বিনোদপুর যুদ্ধে অনেক রাজাকার ও দোসররা আহত হয়। শ্রীপুর থানা তিন তিনবার আক্রমণ করে থানার সমস্ত অস্ত্র পুলিশদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। টুপিপাড়াতে এ বাহিনী স্থায়ীভাবে ক্যাম্প গড়ে তুলেছিল। শ্রীপুর থানার ওসি (অফিসার ইনচার্জ) হিসাবে বীরমুক্তিযোদ্ধা আকরাম হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা একটি বিরল দৃষ্টান্ত হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।

খামারপাড়াতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে পাঁচশ যুবককে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছিল। শ্রীপুর থানার চারপাশে যাতে আরও মুক্তিযোদ্ধার দল গড়ে ওঠে সে লক্ষ্যে শৈলকূপা থানা থেকে উদ্ধারকৃত ৫৭টি রাইফেলের বড় একটি অংশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান, বিশারত, উজির, মন্টু, আলম ও আকামতদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয় যাতে তারাও বাহিনী গড়ে তুলতে পারে। এভাবে ঝিনাইদহের পানামির আফজাল ইপিআরকে অস্ত্রপাতি ও গোলাবারুদ দিয়ে একটি দল গঠন করে দেওয়া হয়। মাগুরার হাজীপুরেও একটি বড় মুক্তিযোদ্ধা দল খাড়া করে দেওয়া হয়। একইভাবে ফরিদপুর-রাজবাড়ীর জামালপুর, বহরপুর, ডুমাইন এলাকায় হাবিলদার জালাল (বেঙ্গল রেজিমেন্ট) কে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করে দেওয়া হয়।

বালিয়াকান্দি থানার সিরাজুল ইসলাম ইপিআর (সিগন্যাল) কে দিয়ে ঐ অঞ্চলেও একটি দল দাঁড় করিয়ে দেন অধিনায়ক আকবর হোসেন। পাংশাতে মতিন সাহেবকেও একটি দলের অনুমতি দিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেন। এছাড়া ইপিআর মান্নানকে দিয়েও মাগুরার পূর্বাঞ্চলে আরও একটি দল করার স্বীকৃতি দেন। মাগুরা মহকুমার ও আশেপাশে ভারতে থেকে আগত কমান্ডার ও তাদের দলের মুক্তি এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) এবং সেনারা এবং মুজিববাহিনীর মুক্তিসেনারা মিলে একটা বড় দল হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে শ্রীপুর থানার চারপাশে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করা হয়েছিল, যেন পাক সেনারা যে কোনো দিক থেকে আক্রমণ করলে এই বাহিনী যেন তাদেরকে দ্রুত সহযোগিতা করতে পরে।

বাহিনীর স্বীকৃতি:
মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর যুদ্ধ পরিচালনা এবং কৌশলের প্রতি আস্থা দেখিয়ে সেক্টর আট-এর সেনানায়ক মেজর আবুল মঞ্জুর সনদের মাধ্যমে এই বাহিনীকে ‘শ্রীপুরবাহিনী’ এবং মিয়া আকবর হোসেনকে বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন। শ্রীপুরের আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন ক্যাপ্টেন এটিএম আব্দুল ওয়াহাব এই স্বীকৃতি দানে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। মুজিবনগর সরকার এই বাহিনীকে যুদ্ধকালীন সময়েই স্বীকৃতি দেয়। শুধু এই নয়, সেক্টর আট-এর সেক্টর কমান্ডার মো. আবুল মঞ্জুর এবং এবং মেজর এমএন হুদা ব্যক্তিগত ভাবে চিঠি প্রেরণ করে আকবর হাসেনের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

একাত্তরের ২৭ অক্টোবর মেজর এমএন হুদা চিঠিতে লেখেন- মি. আকবর. আপনাকে লিখতে পেরে আমি যারপরনাই আনন্দিত। কারণ আপনার দুঃসাহসিক বীরত্বে যে আঞ্চলিক বাহিনী সংগঠিত করেছেন এবং আমাদের উভয়ের চির শক্রর  সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় আপনাকে উষ্ণ অভিনন্দন। আপনার গোলাবারুদের চাহিদা যথাসময়ে জেনেছি। মেজর মঞ্জুর এবং আমি উভয়েই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি। ইনশাল্লাহ্ অতি সত্বর আপনি আপনার চাহিদা ছাড়াও অধিক পাইবেন। গোপনীয়তার কারণে উপস্থিত এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারছি না। ইতোমধ্যে কিছু জরুরি প্রয়োজন মিটানোর মত গোলাবারুদ ও মাইন পাঠাচ্ছি, যাতে বিশেষ করে আমাদের ছেলেরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। আমাদের ছেলেরা যে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছে তা গত রাতে আমি জেনেছি। যেসব ছেলেরা এমন দুঃসাহসিক যুদ্ধ করেছে তাদের সবাইকে মোবারকবাদ জানাই। মেহেরবানি করে এর আগে যতগুলো প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে তার বিস্তারিত প্রতিবেদনও পাঠাবেন।

আরও খেয়াল রাখবেন, য সমস্ত ঘটনার বিবরণ আমারে কাছে পাঠানো হয় তা যেন বিশ্বাসযোগ্য হয়। বিশেষ করে শক্রু সৈন্য হতাহতের ব্যাপারে। গণবাহিনীতে যেসব ছেলেদের পাঠানো হয়েছে তারা খুবই তরুণ ও অপরিপক্ব। তাদেরকে কোন বড় ধরনের তৎপরতায় সম্পৃক্ত করা উচিত নয়, আমাদের মুক্তিফৌজ হিসেবে সুনামের ওপর খুবই মন্দ প্রভাব ফেলবে। এব্যাপারে আপনি বিশেষভাবে বোঝাবেন যে, তারা যেন অপারেশনের মিলিটারিদের ওপর নজর রাখে। বেসামরিক ব্যাপার তাদের সম্পৃক্ত করবেন না। আমাদের ছেলেরা যে মিলিটারি অপারেশনের ব্যাপারে ক্ষিপ্র গুরুত্বসম্পন্ন হয়। আক্রমণ করে এবং বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে শক্রু নাজেহাল করে। তারা যেন সম্মুখ যুদ্ধে না যায়। তারা এ ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়, এছাড়া তারা উপযুক্ত অস্ত্রেও সজ্জিত নয়। তাদেরকে কেবল শক্রুর ওপর রেইড করার কাজে নিয়োগ করবেন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, যদি গণবাহিনীর ছেলেরা এবং সৈনিকগণ দেশের অভ্যন্তরে তাদের কর্মতৎপরতা হাসিল করতে পারে তাহলে অতিসত্বর দেশ স্বাধীন হবে। মি. আকবর, সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা আমাদের ঘৃণ্য শক্রুদের নিপাত করতে ও অন্যায়-অবিচারের প্রতিশোধ গ্রহণে সমর্থ হব ইনশাল্লাহ। আপনার বিশ্বস্ত, এমনএন হুদা মেজর। যুদ্ধকালীন সময়ে আওয়ামী লগি নেতা তোফায়েল আহমেদসহ আরও অনেকে আকবর হোসেন সাথে যোগাযোগ করে তাঁকে সমস্ত ধরনের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন।
এদিকে আকবরবাহিনী এতোটাই সংগঠিত ছিল যে পাকবাহিনীর সমস্ত রণকৌশলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ৭ ডিসেম্বর তারা গোটা মাগুরা মহকুমাকে স্বাধীন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। ঐদিন আকবরবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে এসে মাগুরা নিজেদের দখলে নেয়।

একটি ইতিহাসের মৃত্যু:
মুক্তিযুদ্ধে আকবর হোসেন এবং তাঁর বাহিনীর অবদান অসামান্য। যুদ্ধের নয় মাস আকবর হোসেন যেভাবে যোগ্য, দক্ষ, সাহসী নেতৃত্ব দিয়ে একটি সুশৃঙ্খল আঞ্চলিক বাহিনী পরিচালনা করেন তা দৃশ্যত বিরল এবং অভাবনীয়। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি একবারের জন্যেও ভারতে যাননি। নিজ দেশের মাটিতে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। শুধু পাকবাহিনী আর তার সহযোগীদের প্রতিরোধ বা পরাস্ত নয়, দস্যু ডাকাতদেরও এই বাহিনী শক্ত হাতে দমন করে এলাকার সাধারণ মানুষের জান মাল রক্ষা করেন। বিশেষ করে হিন্দুদের জানমাল রক্ষায় তিনি অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। শুধু এই নয়, যুদ্ধের পরে হিন্দুরা বাড়ি ঘরে ফেরত এসে নিজেদের জমিতে চাষবাস করার সাহস না পেলে তিনি সম্প্রীতি বাড়ানোর লক্ষ্যে হিন্দু মুসলমানদের যৌথভাবে জমিতে চাষ করার উদ্যোগ নেন। এই প্রক্রিয়ায় একদিন শত শত হিন্দু মুসলমান একসাথে জমিতে চাষ করার জন্য লাঙল নিয়ে বিলে নামেন।
একাত্তরে এই বাহিনীর জন্ম না হলে মাগুরা মহকুমাতে পাকবাহিনী কর্তৃক আরো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতো। এই বাহিনীর বীরযোদ্ধাদের কারণেই শ্রীপুর থানা ছিল মুক্তাঞ্চল এবং জনগণের জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। শ্রীপুরে রাজাকারদের কোনো প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল না। উল্টো শ্রীপুরে প্রবেশ করতেই রাজাকার ভয় পেত। নিরাপদ অঞ্চল হওয়ার কারণে বিভিন্ন জায়গা থেকে ভয়ার্ত মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিল শ্রীপুর থানার বিভিন্ন গ্রামে, পাড়া-মহল্লাতে।

২০১৫ সালের ২ মে না ফেরার দেশে চলে যান শ্রীপুরবাহিনীর জন্মদাতা, মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী, স্পর্ধিত ইতিহাস অধিনায়ক আকবর হোসেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। আমৃত্যু তিনি ছিলেন মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। প্রকৃতার্থেই তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের স্পর্ধিত জীবন্ত এক ইতিহাস। একাত্তরে যে দর্শন আর চেতনাকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর আহবানে বীর বাঙালি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আজীবন তিনি সেই চেতনাই লালন করে গেছেন। সমাজ জীবনে তাঁর প্রয়োগ করেছেন। সেই চেতনা আর বিশ্বাস থেকে তিনি কখনই বিচ্যুত হননি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)