চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা তাড়ানোর পেছনে শুধু কি ধর্মই কারণ?

অধিকাংশ মানুষই মনে করছেন ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্যের কারণেই মূলত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে নিপীড়ন-সহিংসতার শিকার হচ্ছে। সেখানকার পরিস্থিতি দেখেশুনে এতদিন মনেও হয়েছে তাই।

কিন্তু সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে ততই এটা বিশ্বাসে স্থির থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ছে যে, রোহিঙ্গা সঙ্কটের পেছনে আর কোনো কারণ বা উদ্দেশ্য কাজ করছে না। বিশেষ করে যেখানে মিয়ানমারে সরকারিভাবে স্বীকৃত নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে ১৩৫টি (১৯৮২ সালে এই তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে দেয়া হয়)।

গত আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নতুন করে শুরু হওয়া সহিংসতা ও হত্যাযজ্ঞের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পশ্চিমাসহ মোটামুটি পুরো বিশ্ব গণমাধ্যমই দেশটির সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা অং সান সু চি’র ভূমিকার ওপর দৃষ্টিপাতা করেছে। এর ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মহল থেকে সু চি’র নোবেল শান্তি পুরস্কার কেড়ে নেয়ারও দাবি জানানো হয়।

কিন্তু এতকিছুর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশ্লেষণের আলোয় না এসে অনেকটা আড়ালেই রয়ে গেছে, যেগুলো নিয়ে ভাবা প্রয়োজন।

ভূমি দখল
মিয়ানমারে ভূমি দখল কোনো নতুন বিষয় নয়। এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হিসেবে দেশজুড়ে চলছে। সেই ১৯৯০-এর দশক থেকে সামরিক জান্তারা ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে ছোট ছোট জমির মালিকদের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জমি দখল করে আসছে।rohingya-রোহিঙ্গা-মিয়ানমার

সামরিক ঘাঁটি সম্প্রসারণ, প্রাকৃতিক সম্পদ সন্ধান ও উত্তোলন, বৃহদাকার কৃষি প্রকল্প, অবকাঠামো এবং পর্যটনের মতো নানা ‘উন্নয়নমূলক’ প্রকল্পের নামে এসব ভূমি দখল করা হয়ে থাকে। দখলের কারণে ভূমিহারা হাজার হাজার থেকে লাখ লাখ মানুষ হয় বাংলাদেশ, ভারত ও থাইল্যান্ডের সীমান্তের এপারে-ওপারে বসতি স্থাপন করে, নয়তো ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে সাগরপথে পাড়ি জমায়।

২০১১ সালে মিয়ানমার বৈদেশিক বিনিয়োগের দ্বার খুলে দেয়ার পর একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার প্রকল্প চালু করে যার নাম দেয়া হয় ‘এশিয়া’স ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার’। এর অল্প কিছু সময় পরই ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর বড় মাত্রায় এবং মুসলিম কারেন জনগোষ্ঠীর ওপর তুলনামূলক ছোট মাত্রায় ভয়াবহ হামলা শুরু হয়। সংখ্যালঘুদের ভূমি দখলের জন্য এসব সরকারি নির্যাতন চালানো হচ্ছে দাবি করে ওই সময় এর ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দা হয়।

আঞ্চলিক স্বার্থ
মিয়ানমার চীন ও ভারতের মাঝে অবস্থিত; এমন দু’টি দেশ, যারা তার প্রাকৃতিক সম্পদের দিকে লম্বা একটা সময় ধরেই লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই ৯০-এর দশক থেকেই চীনা কোম্পানিগুলো মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের শান রাজ্যের কাঠ, নদী এবং খনিজ সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার করে আসছে। সরকারও ব্যবসায়িক লাভের আশায় তাদের সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বেশ কয়েকবার সামরিক সরকারের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলীয় কাচিন ও উত্তরের শান রাজ্যের স্থানীয় সশস্ত্র দলগুলোর সংঘর্ষ হয়েছে।রোহিঙ্গা-জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ

এখন প্রসঙ্গ রাখাইন রাজ্য। বৃহত্তর চীন-ভারত সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ এই রাখাইন। কেননা চীন এবং ভারতের আঞ্চলিক স্বার্থসিদ্ধির মৌলিক একটি বিষয় হলো রাখাইন অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ ও আন্তঃদেশীয় পাইপলাইন বসানো। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পুরো মিয়ানমারের বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। একই সঙ্গে চীন ও ভারতের কাছ থেকে দেশটি একদিকে ট্রানজিট ফি পাবে, অন্যদিকে তেল-গ্যাসের রাজস্বও আসবে।

এর মধ্যে রাখাইনের রাজধানী সিত্তে ও চীনের কুনমিংকে সংযোগকারী চীনের একটি আন্তঃদেশীয় পাইপলাইন প্রকল্পের কাজ ২০১৩ সাল থেকে চলছে। এর মাধ্যমে মিয়ানমারের তেল-গ্যাস গুয়াংজুতে নেয়া হবে। তবে মিয়ানমারের নিরপেক্ষ একটি উপদেষ্টা কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেয়ে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ক্ষতিই হবে বেশি।

এছাড়াই রাখাইনের উপকূলীয় অঞ্চল চীন-ভারত দু’দেশের জন্যই কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশ দু’টির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত করার জন্য পুরো অঞ্চলটা খালি করতে মিয়ানমার সরকার খুব বেশি আগ্রহী।