২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের আগে ও পরে বিএনপি নেতাদের প্রতিক্রিয়া যতটা না মন দিয়ে শুনেছি তার চেয়ে বেশি খেয়াল করেছি তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, মুখয়াবয়বের ভয়ার্ত ফ্যাকাশে চেহারা। এই দলটির ভবিষ্যত কি হবে না হবে সেটা নিয়ে অবশ্যই এইসব ফরমায়েশী দোকানদারদের ভাবতে হচ্ছে। তবে দেশের এক শ্রেণির ছাপোষা সাধারণ মানুষ হিসেবে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে আমাদের ভাবনার কিছু নেই। এইজন্য যে, আমরা ছোট বেলায় শুনতাম যেমন কর্ম তেমন ফল… অতঃএব তাদের ফল তারা ভোগ করবে বা করতে হবে।
‘আওয়ামীলীগ কে চিরতরে রাজনীতি থেকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যই ২০০৪ সালের ২১আগস্ট গ্রেনেড হামলা’…২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণের এই লাইনটি ধরে বাংলাদেশের এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষের উচিত আগামী দিনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিরোধী পক্ষকে ধ্বংস করে দেয়ার মানসিকতা সম্পন্ন দল না খুনিদের সাথে রাজনীতি করবে নাকি নিজেরা এইসব খুনিদের বর্জন করে আলাদাভাবে রাজনীতি করবে।
যদিও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের আগে ও পরে বিএনপির নেতাদের ফরমায়েশি প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। কারণ শুধু এই দেশে কেন? পৃথিবীর কোন দেশেই অপরাধী কিংবা অপরাধীর পক্ষের কোন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে পাবলিকের সামনে বক্তব্য দেয় না। কাজেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রিজভীরাও এখন সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে এতে কারো কোন সন্দেহ রাখা উচিত নহে।
একটা বিষয় লক্ষ্য করেন সাধারণত টক শো গুলোতে দেখা যায়, দুর্নীতি বলেন, মানি লন্ডারিং বলেন কিংবা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা বলেন, যখনই বিএনপি নেতাদের দিকে কেউ আঙ্গুল তুলে অভিযোগ করে, তখন বিএনপির পক্ষে থাকা আলোচকেরা খুব উত্তেজিতভাবে একটা কথা বলে যে, আজ পর্যন্ত তো কোন আদালতে প্রমাণ হল না যে তারেক রহমান অপরাধী, তাহলে কেন তারেক রহমানকে জড়িয়ে জিয়া পরিবারকে নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছেন?
অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগে কাউকে অপরাধী বলা ঠিক না। উদাহরণ হিসেবে সূক্ষ্মভাবে বিএনপিপন্থী বক্তা বা বুদ্ধিজীবীরা আরো একটা কথা বলেন যে, ভুলে যাবেন না সরকার অনেক চেষ্টা করেছিল তারপরেও তারেক জিয়া মামলায় খালাস পেয়েছে। তখন যদি সাথে থাকা আলোচক প্রশ্ন তুলেন যে জিয়া এতিম খানার মামলায় তারেক জিয়ার অপরাধ তো প্রমাণিত হল, ১০ বছরের সাজা হল, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক জিয়ার যাবজ্জীবন হলো এখন কি বলবেন? তখন কিন্তু উত্তরে বলে দিবে, এটা জিয়া পরিবারকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বা চক্রান্ত, সাথে আরো নানান কথা।
সত্যি বলছি, মাঝে মধ্যে খুব জানতে ইচ্ছা করে, আসলে জিয়া পরিবার মানে কী? জিয়া পরিবার কারা? বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে জিয়া পরিবারের অবদান কি? জিয়া পরিবার থাকলে বাংলাদেশের লাভ কি? জিয়া পরিবার না থাকলে বাংলাদেশের ক্ষতি কি? এই জিয়া পরিবারের কী এমন রাজনৈতিক মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে, যে এই জিয়া নামের পরিবার ধ্বংসের চক্রান্ত করা ছাড়া এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কোন কাজ নেই।
গত কয়েক বছরে কিছু মুখস্থবিদ্যায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি, সেটা হলো ঢাক ঢোল পিটিয়ে নির্বাচনে যাবো না, যাবো না, আরেকবার সাধিলে যাবো… নির্বাচনে অংশ নেয়া, শুরুর দিন থেকে শেষের দিন পর্যন্ত একের পর এক অভিযোগ, প্রমাণ থাকুক বা না থাকুক, বিএনপি নেতারা মনে করছে এটাই কুরআনের আয়াত উপস্থাপন হয়ে গেল। অতঃপর নির্বাচনী ফলাফলে পরাজিত হলে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, নতুন ফর্মুলার কারচুপির নির্বাচন হয়েছে, এই ফলাফল মানি না ইত্যাদি বলে মিডিয়া ফাটিয়ে ফেলা, আর নির্বাচনে জয়ী হলে জনগণ এই সরকারকে প্রত্যাখান করেছে। এখন শুধু সময়ের ব্যাপার সামনে জাতীয় নির্বাচন জনগণ বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিবে ইত্যাদি বলে ঢেকুর তোলা।
অপরদিকে লম্বা সময় ধরে ইনিয়ে বিনিয়ে নানান অভিযোগ এটা সেটা টালবাহানা আদালত বর্জনসহ সকল আইনি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে মামলার রায়ের সময় ঘনিয়ে এলে আগাম ফাঁসি লেখা হয়ে গেছে মার্কা বিবৃতি দিয়ে আদালতকে বিতর্কিত করা, রায়ে আসামী খালাস পেলে আদালত ভালো ছিল কোনভাবেই প্রমাণ হয়নি তারেক জিয়া বা খালেদা জিয়া অপরাধী ছিলেন, আদালত ও আইনের শাসন কে ধন্যবাদ দেওয়া। আর রায়ে সাজা হলে দেশে আইনের শাসন নাই, আদালত খারাপ এই আদালত ফরমায়েসি রায় দিয়েছে ইত্যাদি নানান কথা বলা।
প্রশ্ন হচ্ছে, জিয়া পরিবারের নিরপেক্ষ বিচার করতে চাইলে বিচারটা হবে কোন আদালতে? যেই আদালতে শুধু জিয়া পরিবারকে নির্দোষ খুরমা বানিয়ে রায় দিবে এমন আদালত আছে নাকি এই গ্রহে?
উত্তর হচ্ছে, না। এই গ্রহে এই আদালত নাই, তবে এই টাইপের আদালত কেবল সম্ভব বিএনপি ক্ষমতায় এসে যদি জিয়া পরিবারের বিচার কার্যটুকু সম্পূর্ণ করতে পারত। তাহলেই ঐ আদালত থেকে বের হয়ে আসতে পারত তারেক, পিন্টু, বাবররা ‘নিষ্পাপ দুধের বাচ্চারাই’। তাহলেই কেবল বিএনপির চোখে আদালত হত নিরপেক্ষ নির্ভরতার প্রতীক আস্থাশীল ইত্যাদি টাইপের।
বিএনপির বর্তমান মহাসচিব জনাব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ২০০১-২০০৬ বিএনপি-জামাত ৪ দলীয় জোট সরকারের মফস্বল কোটায় প্রথমে কৃষি প্রতিমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সজ্জন ব্যক্তি নাকি দুর্জন ব্যক্তি সেই সার্টিফিকেট দেয়া যাচ্ছে না, তবে এই ভদ্রলোক রায়ের আগের দিন সাংবাদিক সম্মেলনে তারেক রহমানকে ডিফেন্ড করে যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে আজব বা তাজ্জব কিছুই হইনি, কারণ বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলের এটাই হলো বিউটিনেস। যেই দলে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে চোর ডাকাত খুনিকে দলীয় রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছে, সেই দলের মহাসচিবের বক্তব্য এটাই সঠিক।
তবে প্রশ্ন অন্যখানে, তৎকালীন সময়ে উপমন্ত্রী পিন্টু যেভাবে হাওয়া ভবনে হাওয়া খেয়ে তারেকের কোলে উঠতে পেরেছিলেন, তার সিকিভাগ সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব তারেক রহমানের সাথে দেখা করতে পেরেছিলেন কি না? উত্তর যদি হয় পারেননি, তাহলে ২০১৮ সালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিভাবে জানে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার সাথে তারেক জিয়া জড়িত ছিল না।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরেরা রাজনৈতিকভাবে সিনিয়র হতে পারে, কিন্তু রাজনীতির গতি প্রকৃতি তো তখন থেকেই জানি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষায় হলফ করে বলতে পারি, আজকের ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা রুহুল কবির রিজভীরা ২০০১-২০০৬ সময়ে বিএনপির চতুর্থ শ্রেণির নেতা ছিল এবং ঐ সময়ে বিএনপির নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত বা ষড়যন্ত্র যা-ই বলেন, কোন জায়গাতেই এরা এলাউ ছিল না। যদি থাকতেন তাহলে আজকে ২০১৮ সালে এই রকম ডাহা মিথ্যা বলে সত্য কে বালি চাপা দেয়ার চেষ্টা করত না। হতে পারে তাদের মনের ভিতরে একটা বিশ্বাস আছে, তারা যা বলে এটাই কথা, আর বাকী সব ধইঞ্চা।
তাই মাথায় রাখতে হবে ন্যাচারাল জাস্টিস নামের একটা ভাষা আছে। আপনি কর্ম করবেন, কর্মের ফল আপনি ভোগ করবেন সেটা ভালো বা মন্দ। একবার হিসেব করুন, বিএনপির বর্তমান দুরবস্থা দেখুন। এই বিএনপি ২০০১-২০০৬ সময়ের মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া কিংবা ধর্ষিত প্রতিবন্ধী, নাবালিকা মেয়ে কিংবা ২১ আগস্ট নিহতদের পরিবার অথবা বেঁচে থাকা অন্তত ৪০০ জনের শরীরের গ্রেনেডের স্প্রিন্টার বহনকারীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল, আশা ন্যাচারাল জাস্টিস আশায়?
আবার ২০১২-২০১৫ তে পেট্রোল বোমার আগুনে পোড়া মানুষের অভিশাপ… আজকে বিএনপির রাজনীতি কোথায়? মোটাতাজা হচ্ছে নাকি চিকন রুগ্ন হচ্ছে? মির্জা ফখরুল বা রুহুল কবির রিজভীরা কী ভেবে দেখেছে? হয়তো সরকারের দমন নিপীড়ণের কথা বলবেন। কার্যত বিএনপি জামাতের করা পাপের তুলনায় সরকারের দমন নিপীড়ণ একদম যে নেই, সেটা অন্তত খুব স্পষ্ট। যদি থাকত তাহলে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারের জন্য সরকারের অপেক্ষা করতে হত না ১৪ বছর। তাছাড়া ঐ সময় অর্থাৎ ২০০১-২০০৬ সময়ের আরো নানান ঘটনা সমৃদ্ধ অনেক গুরত্বপূর্ণ মামলা চলমান আছে যার রায় কবে বের হবে তা কেউ জানে না। খোদ সরকারও জানে বলে মনে হয় না। তার সাথে ২০১২-২০১৫ সময়ের বিএনপি জামাতের পাপের গল্পের কথা না হয় উঠিয়েই রাখলাম। জানি না বিএনপি এইসব নিয়ে কি ভাবছে বা ভাববে।
শেষ করছি ২০০১-২০০৬ সময়ের বিচারগুলো দ্রুত শেষ করতে তদারকি করে অন্তত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)