বারো বছর আগে বাবাকে হারিয়েছেন। বারোটা বছর নিজের সব কষ্টকে তুচ্ছ করে সংসার ও সন্তানের সব দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন সাহসী মা। আজ সেই মাকেও হারানোর ভয়ে কাতর ছেলে। মা-বাবার বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে তাদের অতীত, বর্তমান আর মৃত্যুর সঙ্গে মায়ের লড়াই নিয়ে লিখেছেন হুমায়ুন আজাদের ছেলে ব্লগার ও লেখক অনন্য আজাদ।
ফেসবুকে এক মর্মস্পর্শী স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন:
‘আজ আমাদের মা বাবার ৩৬তম বিবাহবার্ষিকী। আজ থেকে ১২ বছর পূর্বে আমাদের বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। অর্থাৎ তাদের ২৪তম বিবাহবার্ষিকীর পূর্বে তিনি নির্বাসনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। গত ১২ বছর যাবত আমাদের মা একাকী জীবন কাটাচ্ছেন। মাঝে মাঝে তাঁকে দেখতাম, বারান্দার কোণায় দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে। রাতবিরাতে মা’কে অন্ধকার রুমে বাবার বিশাল আকৃতির ছবির নিচে বসে থাকতে দেখতাম।
তিনি কেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কান্না করছেন কিংবা অন্ধকারে কেনো ছবির নিচে বসে আছেন এমন প্রশ্নের উত্তর কোন দিন পাইনি। নিশ্চুপ থাকতেন। বাঙলার মায়েরা সাধারণত দুর্বল, আক্রান্ত। তিনি আক্রান্ত হয়েছেন ঠিকই; কিন্তু কখনো দুর্বল হতে দেখিনি। তিনি চোখ দিয়ে পানি ফেলতেন ঠিকই; কিন্তু দায়িত্ব পালনে কখনো পিছুপা হননি।
আমাদের মা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। তিনি সৃষ্টিশীল ও মননশীল ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনিন্দ্য সুন্দরী ছিলেন। আমাদের মায়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক পুরুষেরই জীবন অস্থির হয়ে গিয়েছিল। প্রতিনিয়ত প্রেম নিবেদন, এবং প্রত্যাখ্যান করা নিত্যদিনের ঘটনা ছিল। যুগটাই ছিল তখন চিঠির, প্রতিনিয়ত চিঠি পাওয়া সহজলভ্যে পরিণত হয়েছিল। ডজনখানিক নিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তিনি পাহাড়ের চূড়োয় অবস্থান করতেন।
সে-সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীরা শাড়ি পরে শ্রেণিকক্ষে আসতেন। শাড়ি হচ্ছে অসাধারণ নান্দনিক একটি পোশাক। তখনকার নারীরা হাফহাতা ব্লাউজ পরতেন। তখনকার পুরুষদের মধ্যে এতটা উগ্রতা ছিল না, যতটা এখন ধর্মের কারণে। তখনকার পুরুষেরা শাড়িতে নারীকে সৌন্দর্য হিসেবে চিহ্নিত করত কিন্তু এখনকার পুরুষেরা যেহেতু ধর্ম দ্বারা আক্রান্ত তাই শাড়িকে অশ্লীল পোশাক হিসেবে চিহ্নিত করে। আমাদের মায়ের বাঙলা উচ্চারণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাড়া জাগানো, আবৃত্তি মুগ্ধতায় মাখানো, ঘন কালো দীর্ঘ কেশের আকর্ষণ ব্যাপী, শারীরিক গঠনে নান্দনিক ছিল।
তারপর আরও অনেক ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে দীর্ঘ সাত বছর আমাদের বাবার সাথে প্রেম করেন আমাদের মা। একদিন কাউকে কিছু না বলে মা গ্রামের বাড়ি চলে যান। আমাদের বাবা তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাঁর প্রেয়সীকে অর্থাৎ আমাদের মাকে পাননি। বাবা খুব চিন্তিত ছিলেন। কীভাবে খুঁজে বের করবেন মাকে? সে সময় তো ফেসবুক ছিল না। ছিল না মুঠোফোন কিংবা আধুনিক যোগাযোগের মাধ্যম। চিঠি ছিল একমাত্র পন্থা। কিন্তু কোথায় লিখবেন চিঠি? ঠিকানা কী?
দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পর, অনেক কষ্ট করে আমাদের বাবা খুঁজে বের করেন আমাদের মায়ের গ্রামের ঠিকানা। এবং আমাদের বাবা ছিল মারাত্মক সাহসী। তিনি সরাসরি আমাদের মায়ের গ্রামের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হন। সেই কালে হঠাৎ করে একটা পুরুষমানুষ একটা মেয়ের বাড়ি উপস্থিত হবে তা কল্পনাই করা যায় না। আমাদের বাবা সেখানে উপস্থিত হয়েই জানান দিলেন, তিনি আমাদের মাকে বিয়ে করতে চান।
বাড়ির মধ্যে ততক্ষণে হট্টগোল। ইতোমধ্যে পাড়া প্রতিবেশীর কানাকানি শুরু হয়ে গেছে যে ঢাকা থেকে এক ছেলে হেড মাস্টারের বাড়ি এসেছে। আমাদের বাবা ছিলেন তখন বেকার। বেকার ছেলের হাতে হেড মাস্টার নিজ মেয়েকে তুলে দেবে কি দেবে না এই নিয়ে পাড়া মহল্লায় জল্পনাকল্পনা। অতঃপর, হাজারো নাটকীয়তা শেষে আমাদের বাবা তাঁর প্রেয়সীর পরিবারের মন জয় করতে সক্ষম হন।
অনেক বছর আগেই, আমাদের বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন । আমাদের মা এখনো জীবিত আছেন; কিন্তু কতদিন থাকবেন তা জানা নেই। আমাদের মা ক্যান্সারে আক্রান্ত। দীর্ঘদিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করেই যাচ্ছেন। তিন ভাইবোনের উপার্জিত অর্থ দিয়েই মাকে টিকিয়ে রেখেছি। যদিও আমার যা করণীয় ছিল, সম্পূর্ণ ব্যর্থ পুত্র। যে শক্তিশালী মাকে দেখে অভ্যস্ত ছিলাম; সে মা, এখন আর শক্তিশালী নেই।
তবে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পুরাতন সেই আগের রূপে ফিরে যেতে। তিনি এখন আর স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে পারেন না। আমাদের মায়ের মাথার সব চুল পড়ে গেছে। মা আজ আক্রান্ত; পুত্র ভারাক্রান্ত। দীর্ঘ ১৬ মাস পর, আগামী সপ্তাহে আমাদের মাকে সামনে পাবো।
আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো!
কী চোখে তোমায় দেখি বোঝাতে পারিনি আজো হয়তো।।’