অফিসে যাওয়ার সময় প্রতিদিন দেখি বিভিন্ন স্কুলের সামনে চাদর বিছিয়ে, বিভিন্ন শপিং কমপ্লেক্সের সিঁড়িতে বা বারান্দায় কিংবা অপরিস্কার ফুটপাতে মায়েরা দলবেঁধে বসে আছেন। বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এরা এখানে অপেক্ষা করেন বাচ্চাদের ছুটি হওয়া অব্দি। শুধু কি স্কুলের সামনে? বাচ্চাদের কোচিং সেন্টার, গান-নাচ বা আর্ট স্কুলের বাইরেও মায়েরা সন্তানের জন্য অপেক্ষা করেন। কখনো বৃষ্টিতে ভিজে, কখনোবা রোদে পুড়ে, শব্দ, ধুলা-ধোঁয়ার মধ্যে বসে এবং কনকনে ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে মায়েরা বসে থাকেন। অনেকেই অপেক্ষারত এই মায়েদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেন। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলেন, বাসায় কাজ ফাঁকি দেয়ার জন্য, গল্প করার জন্য মায়েরা দলবেঁধে এখানে বসে থাকেন।
আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করছি। কারণ এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। একদিন বা দুদিন মানুষের রাস্তার ফুটপাতে বসে গল্প করতে ভালো লাগবে, তাই বলে দিনের পর দিন নয়। এরা বসে থাকেন সংসারের টাকা বাঁচানোর জন্য, নিজের সময় বাঁচানোর জন্য। কারণ ঢাকায় এখন রিকশাভাড়াসহ সবধরনের যানবাহনের ভাড়া অনেক বেশি। সবসময় যানবাহন পাওয়াও যায় না, সব রাস্তায় সব বাহন চলেও না। ট্র্যাফিক জ্যাম ও পথের নানান ঝক্কির এবং সর্বোপরি সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে এই মায়েরা বাধ্য হন এভাবে বসে থাকতে। দিনের পর দিন একসাথে বসে থাকতে থাকতে তাদের মধ্যে বন্ধন বা সম্পর্ক গড়ে ওঠাইতো স্বাভাবিক। যাদের বাসা কাছে বা যাদের গাড়ি আছে, তারা কিন্তু কেউ বসে থাকেন না।
দু’জন মায়ের সাথে কথা হলো এ প্রসঙ্গে। একজন বললেন বাচ্চাকে যদি আমি রিকশায় আসা-যাওয়া করে আনা নেয়া করি, তাহলে প্রতিদিন ২৫০ টাকা ভাড়া লাগবে কমপক্ষে। তাও যদি রিকশা পাই তবে। এর চেয়ে বসে থাকি, ছুটির পর ছেলেকে নিয়ে ফিরি, সংসার খরচের টাকা বাঁচে। অন্যজনও একই কারণ দেখালেন। তবে এরা দু’জনেই বলেছেন স্কুলে আসার আগে এবং ফিরে গিয়ে সংসারের সব বড় কাজগুলো তাদেরই করতে হয়। কোন মাফ নেই। বরং অনেক বেশি চাপ পড়ে।
একজন মা বা পরিবারের কর্ত্রী বা একজন গৃহিনী, যিনি অফিসে গিয়ে কোন চাকরি বা ব্যবসা করেন না, তিনি আসলে ঠিক কতটা কাজ করেন, তা কি কখনো ভেবে দেখেছি আমরা? দেখিনি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউ একে কোন কাজ বলে মনে করেনা। আসলে যে কাজের কোন আর্থিক মূল্য নেই, তাকেতো অর্থনীতির ভাষায় ও সমাজে কাজের মর্যাদা দেয়া হয়না। তাইতো একজন স্বামী অফিস থেকে ফিরে, ঘরে তৈরি নাস্তা ও চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গৃহিনী স্ত্রীকে অবলীলায় বলতে পারেন ‘সারাদিন করোটা কী ?’ একটি ছোট বাচ্চাকেও যদি জিজ্ঞাসা করা যায় তার গৃহিনী মা কী করেন? বাচ্চাটিও কোনকিছু না ভেবে বলে দেবে ‘আমার মা কিছু করেনা।’
অথচ আমরা যদি একবার আমাদের অ-চাকরিজীবী মায়েদের ভূমিকার কথা বা মজুরিবিহীন কাজের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখবো একজন মা বা স্ত্রী সংসারের সবকাজই করেন বা করছেন। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর তার দেহঘড়ি চলতে শুরু করে- বাচ্চাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তৈরি করা, বাচ্চার ও স্বামীর টিফিন, সকালের নাস্তা তৈরি করে গুছিয়ে দেয়া, কাপড় ইস্ত্রি করা, বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা, রান্না করা, ঘর গুছানো, পরিবারের বয়স্ক মানুষের দেখাশোনা করা, অসুস্থ সদস্যের সেবা করা, বাচ্চাদের দেখাশোনা করা, সেবা-যত্ন করা, বাচ্চাকে পড়ানো, দুপুর-রাতের খাবার তৈরি ও পরিবেশন করা। এরমধ্যে কারো কারো সহযোগিতার মানুষ থাকে, আবার কাউকে কাউকে নিজেকেই করতে হয়। এ ফিরিস্তি আরো বড় করা সম্ভব। একবার শুধু ভাবুন এত কিছুর পরও তার এই কাজটা কোন কাজ নয়। তাকে শুনতে হয় ‘সারাদিন করোটা কী।’ কারণ টাকার অংকে তার এই কাজকে বিচার করা হয়না। জাতীয় আয়েও এই কাজকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়না।
সবচেয়ে দু:খজনক ও বিপদজনক বিষয়টা হচ্ছে যে এই কথা শুনতে শুনতে একজন গৃহিণীর মনেও ধারণার সৃষ্টি হয় যে উনি কোন কাজ করেন না, সংসারে তার কোন অবদান নেই । তাই ‘আপনি কী কাজ করেন ?’ জিজ্ঞাসা করলে উনি নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন, ‘আমিতো কিছুই করিনা।’ তার মনেও সফলভাবে অমর্যাদাকর এই ধারণাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে সমাজ। অথচ একবার ভাবি, সংসারের এই কাজগুলো যখন আমরা মজুরি দিয়ে লোক রেখে করাই বা করাতে চাই, তখন আমাদের এর পেছনে কত টাকা গুণতে হয়। আমারতো ধারণা তাহলে সংসারে আয়ের চেয়ে ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যেতো। আর কাজের গুণগত মানও এরকম থাকতো না।
এটাতো গেল শহরের চিত্র । গ্রামের এবং পাহাড়ের নারীর ক্ষেত্রে বিনা মজুরির শ্রম আরো অনেক বেশি ও কঠিন। সেখানেও নারীর এই ‘মজুরিবিহীন সেবামূলক কাজ’ এর আওতায় রয়েছে পরিবারের সন্তান, বয়স্ক, অসুস্থ মানুষের সেবাযত্ন, রান্নার কাজ, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার ও পানি সংগ্রহের কাজ। এর বাইরে গ্রামীণ নারীর কৃষিকাজের আওতায় রয়েছে ঘরের অঙিনায় তরি-তরকারির চাষ করা, বীজ সংরক্ষণ, ধান ঝাড়াই-মাড়াই, ধান শুকানো, গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগী পালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নারীর এই কাজগুলো বরাবরই গণনার বাইরে বা স্বীকৃতিহীন থেকে গেছে বা যাচ্ছে।
এই আলোচনা আসলে নীতি পরিবর্তনের দাবি রাখে। নারীর প্রতিদিনের কাজের অধিকাংশ কাজই মূল্যায়ন বা গণণার বাইরে থেকে যাচ্ছে এবং জাতীয় পরিসংখ্যান বা জিডিপিতে অর্ন্তভুক্ত হচ্ছেনা। অর্থনীতিবিদরাও এখন পর্যন্ত কোন বিকল্প পদ্ধতি বের করতে পারেন নাই, যার মাধ্যমে নারীর এই অমূল্যায়িত কাজকে সিস্টেম অব ন্যাশনাল একাউন্টস ( এসএনএ ) এ যোগ করা যেতে পারে।
এর ফলে বিশ্বে নারীদের কাজের একটা বড় অংশের মূল্যায়ন করা ও মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না। এত কিছু করার পরও মনে করা হচ্ছে নারী কোন কাজ করেনা। আর এরই প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে নারীকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। মর্যাদাহীনতার কারণে বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন নারী। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে নারীর ভূমিকা এবং বিশেষ করে গৃহস্থালি কাজসহ তাদের অন্যান্য মজুরিবিহীন কাজের মাধ্যমে নারী যে অবদান রেখে চলেছেন সেই চিত্র তুলে ধরতেই মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন শুরু করেছে ‘মর্যাদায় গড়ি সমতা’ প্রচারাভিযান।
শুধু অর্থনৈতিক মূল্য না থাকার কারণে বা মজুরিবিহীন হওয়ায়, নারীর প্রজনন ভূমিকা ও দায়িত্বকে কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। নারীর সারাদিনের বা সারাজীবনের কাজ মূল্যায়ন করা হবেনা বা তাদের এই অবদানকে স্বীকার করা হবেনা, সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন খুব জরুরি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও সিপিডি’র গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে নারীরা কতভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখছে এবং পুরুষের তুলনায় কত বেশি মজুরিবিহীন কাজে সময় দিচ্ছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের একজন নারী সমবয়সী একজন পুরুষের তুলনায় প্রায় তিনগুণ সময় এমন কাজ করে, যা জাতীয় আয়ের হিসাবে যোগ হয় না একজন নারী মজুরি ছাড়া কাজে প্রতিদিন গড়ে ৮ ঘন্টা এবং একই কাজে একজন পুরুষ মাত্র ২.৫ ঘন্টা সময় খরচ করে। আর একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২.১ টি কাজ করে, যা মজুরিবিহীন এবং জাতীয় আয়ের হিসাবে ( জিডিপি) তে যোগ হয়না। পুরুষের ক্ষেত্রে এধরণের কাজের সংখ্যা মাত্র ২.৭টি । এই যে ধান উৎপাদন, এর শুরু থেকে শেষপর্যন্ত ২৩টি ধাপ রয়েছে। এরমধ্যে ১৭টি ধাপের সাথেই নারী সরাসরি যুক্ত। কিন্তু কোথাও নারীর এই অবদানের কথা স্বীকার করা হয়নি।
আমরা শুধু চাইছি একজন নারীকে, নারীর মজুরিবিহীন কাজকে মূল্যায়ন করা হোক, সংসারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে সম্মান জানানো হোক তার অবদানকে। শুধু একবার ভাবুন সংসারের সার্বিক দায়িত্বপালনরত মা, স্ত্রী অথবা বোনটি যদি একদিন তার কাজ থেকে ধর্মঘট করেন বা ছুটি নেন- তাহলে সংসারে কী দুর্দশাইনা নেমে আসবে।
আমরা যারা মায়ের হাতের রান্না খেয়ে, মায়ের আঁচলে মুখ মুছে, মায়ের সেবা নিয়ে, মায়ের হাতে তৈরি কাপড় পরে, মায়ের বকুনি খেয়ে পড়াশোনা করে, মায়ের হাতে হাতেখড়ি নিয়ে, অসুখ-বিসুখে মাকে পাশে পেয়ে, কৈশোর-যৌবনে মায়ের শাসনে এবং মায়ের মুখে ছড়া বা গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি- তারা কীভাবে মায়ের এই অবদানকে ভুলে যাবো বা অমর্যাদা করবো? আমাদের সকাল হয় মা কে দিয়ে, রাতে ঘুমোতে যাই মাকে নিয়ে । মা-ই একজন সন্তানের কাছে সূর্য, মা-ই একজন সন্তানের কাছে চাঁদ, এককথায় সারা পৃথিবী । কাজেই মাকে, মায়ের কাজকে মর্যাদা দিতে শিখলে সেই মানুষ নিজেকেই মর্যাদা দিচ্ছে বলে ধরে নিতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)