টেস্ট সিরিজে পাত্তাই পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পোশাক বদলেও বাংলাদেশের সঙ্গে পেরে উঠল না সফরকারীরা। মিরপুরে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ৫ উইকেটের দাপুটে জয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে লিড(১-০) নিয়েছে মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার দল।
মঙ্গলবার দ্বিতীয় ওয়ানডে একই মাঠে। শুরু দুপুর ১টায়।
উইন্ডিজের দেয়া ১৯৬ রানের লক্ষ্য বাংলাদেশ টপকে গেছে ৫ উইকেট হারিয়ে, ৮৯ বল হাতে রেখে। মুশফিকুর রহিমের অপরাজিত ৫৫, লিটন দাসের ৪১, সাকিব আল হাসানের ৩০ রানে উইন্ডিজের করা দুইশর কাছাকাছি সংগ্রহ টপকাতে বেগ পেতে হয়নি স্বাগতিকদের।
ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে এটি টাইগারদের দশম ওয়ানডে জয়। দু’দল খেলেছে ৩৩ ম্যাচ।
‘ফরম্যাট যত ছোট ওয়েস্ট ইন্ডিজ তত ভয়ঙ্কর’ সিরিজ শুরুর আগে প্রতিপক্ষ নিয়ে মাশরাফী এভাবেই জানান ভাবনার কথা। কঠিন বলেই হয়তো ব্যাটসম্যানদের লক্ষ্যটা নাগালে রাখার দায়িত্ব নিজেই নিলেন অধিনায়ক।
গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মাশরাফী তিন উইকেট নিয়ে বশে রাখেন উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের। শেষে মোস্তাফিজ জ্বলে উঠলে দুইশর আগেই থামে ক্যারিবীয়দের ইনিংস।
ডানহাতি-বাঁহাতির বৈচিত্র্য রাখতে ওপেনিংয়ে তামিম ইকবালের সঙ্গী হন লিটন দাস। চোট কাটিয়ে প্রায় তিন মাস পর আন্তর্জাতিক ম্যাচে নামা তামিম ১২ রান করে ফেরেন সাজঘরে। অফস্পিনার রোস্টন চেজের বলে ক্যাচ দেন দেবেন্দ্র বিশুর হাতে। ৩৭ রানে প্রথম উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
তিনে নেমে ইমরুল কায়েস প্রথম বলেই মারেন বাউন্ডারি। দ্বিতীয় বলে বোল্ড হয়ে ফেরেন সাজঘরে। দ্রুতগতির পেসার ওশানে টমাসের অফস্টাম্পের বাইরে সিমে ফেলা বল পা না নিয়েই ড্রাইভ করতে যান এ বাঁহাতি। ইনসুইং হয়ে ভাঙে স্টাম্প।
দ্রুত ফিরে যেতে পারতেন লিটনও। ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ দিয়েও ওভারস্টেপিংয়ে ‘নো বল’ হওয়ায় বেঁচে যান এ ডানহাতি ব্যাটসম্যান। মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে তৃতীয় উইকেট জুটি যখন পঞ্চাশের কাছে তখন আত্মঘাতী শটে বোল্ড হন শেষঅবধি।
কিমো পলের স্টাম্পে করা সোজা বলটি লংঅনে তুলে মারতে চেয়েছিলেন লিটন। লাইন মিস করায় উপড়ে যায় মিডলস্টাম্প। ৫৭ বলে ৫টি চারের সাহায্যে ৪১ রানে থামে তার ইনিংস। দলের রান তখন ৮৯।
পাঁচে নামেন সাকিব। মুশফিকের সঙ্গে খেলতে থাকেন সাবলীল। তারাই শেষ করে আসতে পারতেন। দলীয় দেড়শ থেকে যখন হাত ছোঁয়া দূরত্ব (১৪৬) তখন রোভম্যান পাওয়েলের বলে শাই হোপের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। এ বাঁহাতির ২৬ বলে ৩০ রানের ইনিংসে চারের মার ছিল চারটি।
সৌম্য সরকার নেমেই ব্যাট চালান প্রস্তুতি ম্যাচে সেঞ্চুরির ছন্দে। গতিদানব টমাসকে পেরিস্কুপ খেলে চার-ছক্কা মেরে দ্রুত শেষ করার আভাস দেন। জয়ে নোঙর ফেলতে যখন ২১ রান দূরে বাংলাদেশ, এ বাঁহাতি চেজের দ্বিতীয় শিকার হন স্লিপে ক্যাচ দিয়ে। ১৩ বলে ১৯ রানের ইনিংসটি ছিল দুটি চার একটি ছক্কা।
পরে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের ভরসার নাম মুশফিকের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ জুটি গড়ে জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন। ৭০ বলে ৫ চারে ৫৫ রানের ইনিংসটি সাজান মুশফিক। মাহমুদউল্লাহ অপরাজিত থাকেন ১৪ রানে।
দিবা-রাত্রির ম্যাচে টস জিতে আগে ব্যাট করা উইন্ডিজ সতর্ক শুরুর পর হঠাৎ এলোমেলো হয়ে পড়ে। রানের চাকা ঘোরাতে গিয়ে তাদের উইকেট পড়েছে নিয়মিত বিরতিতে। বাংলাদেশের স্পিনারদের পর পেসারদের দাপটে টস জিতে আগে ব্যাট করে ১৯৫ রানের বেশি করতে পারেনি ক্যারিবীয়রা।
মিরপুরে নিজের ২০০তম ওয়ানডে ম্যাচে দ্যুতি ছড়িয়েছেন মাশরাফী। ১০ ওভার বোলিং করে ৩০ রান দিয়ে ফিরিয়েছেন প্রতিপক্ষের টপ ও মিডলঅর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানকে। ৬০টি ডেলিভারির মধ্যে ডট বল ছিল ৪১টি। মাশরাফীর দশ ওভারে বাউন্ডারি এসেছে মাত্র দুটি। নিজেরে প্রথম ওভারের প্রথম বলে একটি চার ও শেষ ওভারের শেষ বলে একটি ছক্কা। রান আটকে আটকে বোলিং করে যাওয়াতেই এসেছে সফলতা।
ডট বল করে উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের ওপর চাপ বাড়ায় বাংলাদেশ। শুরুতে সতর্ক হয়ে খেললেও রান বাড়ানোর তাড়নাতেই উইকেট বিলিয়ে আসেন ক্যারিবীয় ওপেনার কাইরেন পাওয়েল। ইনিংসের অষ্টম ওভারে সাকিব আল হাসানের অফস্টাম্পের বাইরের বল মিডঅফের ওপর দিয়ে উড়িয়ে মারতে গেলে টাইমিং হেরফের হয়। বল চলে যায় পয়েন্টে। পেছন দিকে দৌড়ে তালুবন্দী করেন রুবেল হোসেন। দুই অঙ্ক স্পর্শ করেই সাজঘরে ফেরেন পাওয়েল (১০)। স্পিনারদের হাতে নতুন বল তুলে দিয়ে যে ভুল করেননি মাশরাফী তার নজির দেখান সাকিব।
উইন্ডিজ শিবিরে দ্বিতীয় আঘাত হানেন মাশরাফী। ড্যারেন ব্রাভোকে (১৯) বিভ্রান্তিতে ফেলে উইকেট আদায় করেন এ পেসার। ডট বলের বেড়াজাল থেকে বের হতে তুলে মারা ছাড়া উপায় ছিল না এ বাঁহাতির। মাশরাফীর ছোড়া ডেলিভারিটি স্লোয়ার ছিল, সেটি বোঝার আগেই তার ব্যাট চলে আসে বলের কাছে। বল আকাশে ভাসে কিছুক্ষণ। লং-অফ থেকে দৌড়ে আসেন তামিম ইকবাল। অসাধারণ ডাইভে বাজপাখির মতো উড়ে বল হাতে জমিয়ে অধিনায়কের ২০০তম ম্যাচে উপহার দেন প্রথম উইকেট।
দুই অঙ্ক পেরিয়ে যাওয়ার পর দুবার জীবন পাওয়া ব্রাভো সাজঘরে ফেরেন ৫১ বলে ১৯ রান করে। ব্যক্তিগত ১৩ রানে মোস্তাফিজুর রহমানের বলে প্রথমবার জীবন পান এ ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান। তখন অফস্টাম্পের বাইরে করা দ্রুতগতির বলে কাট করলে ব্যাকপয়েন্টে ক্যাচ ছাড়েন অতিরিক্ত ফিল্ডার হয়ে নামা আরিফুল হক। দলের রান তখন ৫৪।
পরে ১৯ রানের মাথায় আবারও জীবন পান ব্রাভো। রুবেল হোসেনের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন। বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে পড়েও গ্লাভসবন্দী করতে পারেননি মুশফিকুর রহিম। পরে অবশ্য আর রান যোগ করতে পারেননি ব্রাভো।
মোস্তাফিজ-রুবেল সম্ভাবনা জাগালেও তামিমের দুর্দান্ত ক্যাচের মাধ্যমে অধিনায়কের ঝুলিতে গেছে ব্রাভোর উইকেট। জায়ান্টস্ক্রিনে তাকিয়ে পুরো দল আরেকবার যখন দেখছিলেন তামিমের ক্যাচটি, দর্শকগ্যালারিতে তখনও উৎসবের ঢেউ।
দর্শকের আনন্দ-উচ্ছ্বাস চলেছে পুরো ইনিংসজুড়েই। পরে আরও দুই শিকার করেন মাশরাফী। উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া শাই হোপ মেহেদী হাসান মিরাজের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে দ্বিতীয় সাফল্যের দেখা পান মাশরাফী। এ ডানহাতি ব্যাটসম্যান করেন ৪৩ রান।
দলীয় রান তিন অঙ্ক পৌঁছানোর আগে শিমরন হেটমায়ারকে (৬) ফেরান মিরাজ। টেস্ট সিরিজের চার ইনিংসেই অফস্পিনার মিরাজের বলে সাজঘরে ফেরেন এ বাঁহাতি। বাংলাদেশ সফরে পঞ্চমবারের মতো এক বোলারের বলেই আউট হন হেটমায়ার।
ক্যারিবীয়দের রান যখন ১১৯; মাশরাফী আনেন ব্রেক-থ্রু। উইন্ডিজ অধিনায়ক রোভম্যান পাওয়েলকে (১৪) মিডঅফে দাঁড়ানো লিটন দাসের ক্যাচ বানান অধিনায়ক। ২০০তম ওয়ানডে ম্যাচ স্মরণীয় করেন তিন উইকেট নিয়ে।
দলের আর ৯ রান যোগ হতেই সাজঘরে ফিরে যান মারলন স্যামুয়েলস। ৪৮ বলে ২৫ রান করে লিটনের হাতে ক্যাচ দেন। প্রথম উইকেটের মুখ দেখেন রুবেল।
ভয়ঙ্কর হতে থাকা সপ্তম উইকেট জুটি ভেঙে ম্যাচের প্রথম শিকারের দেখা পান মোস্তাফিজ। ৩৮ বলে ৩২ রানের ইনিংস খেলা রোস্টন চেজকে মিরাজের হাতে ক্যাচ বানান কাটার মাস্টার। ৫১ রানের জুটিটি ভাঙে ইনিংসের ৪৮তম ওভারে।
শেষদিকে কেমার রোচ ও কিমো পলের মারমুখী ব্যাটিংয়ে দুইশ পেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা জাগে। ২৯ বলে ৩৭ করে আউট হন পল আউট হলে হওয়ার পর আরও একটি উইকেট হারালে দুইশর আগেই থামে উইন্ডিজ।
ইনিংসের শেষ ওভারে মোস্তাফিজের কাটারের মুখে আড়াআড়ি ব্যাট চালান পল। ব্যাটের কানায় লেগে উইকেটের পেছন দিকে হাওয়ায় ভাসে বল। পয়েন্ট থেকে পেছনে দৌড়ে দুর্দান্ত ক্যাচ নেন মিরাজ। এক বল পরই দেবেন্দ্র বিশুর ফিরতি ক্যাচ নিয়ে নিজের তিন নম্বর শিকার বানান ফিজ। এ বাঁহাতি পেসার ১০ ওভারে দেন ৩৫ রান। ডট করেন ৩৩টি।