সাম্প্রতিক সময়ে মালাউন শব্দ নিয়ে চারদিকে এত বেশি হৈ-চৈ, এত বেশি সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন ও আন্দোলন-সংগ্রাম দেখা যাচ্ছে; তা একদিকে যেমন ভালো লাগছে আবার অন্যদিকে ভয়-সংঙ্কা কাজ করছে। কারণ মালাউন শব্দ ব্যবহার করে কোনও জাতিগোষ্ঠিকে গালি দেওয়া হয় বা অভিশপ্তজাতি হিসেবে অখ্যায়িত করা হয় তা নতুন প্রজন্মের সামনে নতুন করে উপস্থাপিত হচ্ছে।
সনাতন ধর্মের ছোট্ট শিশুটিও যখন জানবে এই মালাউন শব্দটা দিয়ে তাকে অভিশপ্ত করা হচ্ছে বা অভিশপ্ত জাতিতে তাঁকে অন্তভূক্তি করা হচ্ছে তখন তাঁর মানসিকতার অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা হয়তো আমি-আপনি-আমরা ভুলেও চিন্তা করিনি। চিন্তা করিনি স্কুলের বন্ধু-বান্ধব তাঁকে কীভাবে মুল্যায়ন করবে, তাঁর সাথে আগেরকার মতন প্রিয়বন্ধু হয়ে মাঠে-ঘাটে কাঁদে-কাঁদ মিলিয়ে খেলতে যাবে কীনা, পড়ার টেবিলে হাতে-হাত রেখে বসবে কীনা!
নারায়ণগঞ্জে সেলিম ওসমান কর্তৃক শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠ-বস করানোর প্রতিবাদে দেশের সচেতন সমাজ তার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল। সেই একই কায়দায় সবাই নিজ-নিজ কান ধরার ছবি তুলে প্রতীকি প্রতিবাদও করেছে। কলম সৈনিকরাও চালিয়েছে তার লেখনির মাধ্যমে প্রতিবাদ। মাঠে-ময়দানে নামতে না পারলেও অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের কান ধরার ছবি আপলোড করে অপসংস্কৃতি ও নোংরা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে হিন্দুপল্লিতে হামলা, নির্যাতন, প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পাদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক মালাউনের বাচ্চারা বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে বলে মন্তব্য করার অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রচার প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হক বলেন, ‘আমি হিন্দুদের কখনোই মালাউন বলিনি। এটা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার। যারা বলেছেন আমি বলেছি, তারা বিষয়টির প্রমাণ দিক। কে শুনেছে, আমি চ্যালেঞ্জ করছি।’
‘কে শুনেছে, আমি চ্যালেঞ্জ করছি’- মন্ত্রীর এই মন্তব্যের দৃঢ়তা বা চ্যালেঞ্জ কেউ গ্রহণ করবে কি না আমি জানি না। হয়তো হবে না, কারণ এই ধরনের নোংরা মন্তব্যের কোনও ভিডিও ফুটেজ এই পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আবার অন্যদিকে পাওয়া গেলও আমাদের তদন্ত প্রতিবেদক হয়তো নারায়ণগঞ্জের মতই সংশ্লিষ্টতার কোনও প্রমাণ খুজে পাবে না।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উত্তম বড়ুয়া নামে এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননার ছবি ট্যাগ করার অভিযোগ নিয়ে রামুতে ভয়াবহ সহিংসতা ঘটে যায়। ওই দিন কক্সবাজারের রামুতে একে-একে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বৌদ্ধ ধর্মের ১২টি বিহার ও শতাধিক বসত বাড়ি। একইভাবে উখিয়া ও টেকনাফে আরও ৭টি বৌদ্ধ বিহারে হামলা হয়।
২০১৩ সালের ৪ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়ায় ফেসবুকে মহানবী (সা.)-এর নামে আপত্তিকর মন্তব্য ও কার্টুন প্রকাশের গুজব রটিয়ে একদল প্রতিক্রিয়াশীল মানুষকে উত্তেজিত করে আরেক দল মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করা হয়। সেখানেও পরিকল্পনা করে সকাল ১০টায় গুজব রটল আর সেই ফেসবুক পেজের ছবির ফটোকপি ১১টায় বিলি করলো। তারও এক ঘন্টা পর সনাতন ধর্মালম্বীদের বাড়িতে, মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, গুরুত্বপূর্ণ বাজার ও মহাসড়কে যেখানে সার্বক্ষনিক পুলিশ থাকার কথা, সেখানেও তিন ঘন্টারও বেশি সময় পর পুলিশের উপস্থিতি।
একই কায়দায়, একই পরিকল্পনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রসরাজ দাস নামক এক যুবকের ফেসবুকে ফটোশপ ছবির পোস্টে মুসলমানদের পবিত্র স্থান কাবাঘরের উপরে শিবের মূর্তির ছবিকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের অশাস্তি সৃষ্টি। রসরাজ দাস ফেসবুকে ক্ষমাপ্রার্থনামূলক এক পোস্ট দিয়ে দাবিও করেন, তাঁর এই ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক করা হয়েছে। তিনি নিজে নয়, অন্য কেউ এই ধরনের ছবি পোস্ট করেছে। রসরাজের অ্যাকাউন্টে ওই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয় শুক্রবার, এবং ওইদিনই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। শেষ পর্যন্ত ওই ছবিটি ডিলেটও করা হয়।
এখানেই যদি সমাপ্তি হতো তাহলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হয় না। কিন্তু না করে বরং উল্টো হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নামের দুই সংগঠনের ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করার সুযোগ দেওয়া হয়। সেখানে নাসিরনগরের ইউএনও, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওই সমাবেশে বক্তব্য রেখেছিলো এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতাও মিছিল নিয়ে এসেছিল।
পরে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গেল। ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, দত্তপাড়া, ঘোষপাড়া, গাংকুলপাড়া, মহাকালপাড়া, কাশিপাড়া, নমশুদ্রপাড়া, মালিপাড়া ও শীলপাড়ায় ৩০ অক্টোবর কমপক্ষে ১৫টি মন্দির ভাঙা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কমপক্ষে দেড়শ বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। একই ধর্মানুভূতি নিয়ে একই দিন হবিগঞ্জের মাধবপুরে একাধিক মন্দির ভাঙচুর, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর লুট হয়েছে।
ধর্মভিত্তিক দুই সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের নামে হিংসা প্রচারের আয়োজন করলেও ওখানে দল-নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও প্রশাসনের অনেকেই সমবেত হয়েছিল এবং উস্কানি ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে যার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।
মালাউন শব্দ ব্যবহারের কারনেই যে মন্ত্রী সমালোচিত তা নয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রী ছায়েদুল হককে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কারেরও দাবি জানিয়েছিলেন তাঁরা।
এখন দেখার বিষয়, অভিযুক্ত রসরাজকে গ্রেপ্তারের পরও কাদের ইন্ধনে হেফাজতে ইসলাম, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এবং নাসিরনগরের ইউএনও, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেছিল। তাঁরা কী মন্ত্রী ছায়েদুল হককে বিতর্কিত করার উদ্দেশ্যে এই ধরনের পরিকল্পনা করেছিলেন, নাকি এক ঢিলে উভয় পক্ষের ধ্বংস চেয়েছিলেন এই ধরনের প্রশ্নও আসতে পারে।
মুক্ত বিশবকোষ থেকে জানা যায়, মালাউন শব্দটি আরবী শব্দ “ملعون” থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ অভিশপ্ত বা আল্লাহর অভিশাপ প্রাপ্ত। মালাউন শব্দটি ব্যবহার করা হয় জাতি বিদ্বেষমূলক গালি হিসেবে। হিন্দুদের উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহৃত হয় বাংলাদেশে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই শব্দটির বহুল ব্যবহার করেছিল। পরে শব্দটি স্বাধীনতাবিরোধী ‘রাজাকারদের’ জন্য গালির বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে যা আজও চলমান।
মুক্তবিশ্বকোষ ইউকিপিডিয়া মতে, ১৯৪৬ সালে নোয়াাখালীতে সেবা কাজ করতে এসে নির্মল কুমার বসু ও মোহনদাস গান্ধী লক্ষ্য করেন যে, এখানে হিন্দুদের মালাউন বলে গালি দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ গণহত্যা চলাকালীন পাকিস্তানি সেনারা আলোচিত বাঙালি হিন্দু অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবকে হত্যা করে। হত্যা করার পূর্বে গোবিন্দচন্দ্রকে মালাউন বলে গালি দেন সেনারা।
গণজাগরন মঞ্চের আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নানান ধরনের অপপ্রচার চালাতে একটি মহল দেরি করেনি। নাস্তিক, মুরতাদ, কাফেরসহ নানান শব্দমালার গালি তখন সংযোজন করে বিতর্কিত করার চেষ্ঠা করেছে। তখনও আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ষড়যন্ত্র করেছে। এখনও তার ব্যতিক্রম নয়।
আর মালাউন বললেই কোনও ব্যক্তি বা জাতিগোষ্ঠি অর্থানুসারে অভিশপ্ত হয়ে যায় না। বরং এই ধরনের শব্দ বা গালি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবাদ দমানোর ষড়যন্ত্র করা হয়। আর সনাতন ধর্মের লোকেরা তাঁদের স্রষ্টাকে বিশ্বাস করেন, স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা করেন। স্রষ্টার করুণা থেকে বঞ্চিত ব্যক্তিদ্বয় হতে পারে, কিন্তু হিন্দুসম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা কখনই মালাউন বা অভিশপ্ত হতে পারে না।
মূলতঃ এই ধরনের গালি ব্যবহার করে স্বাধীন চেতনাকে থামানোর চেষ্ঠা করে থাকে। কোনো আন্দোলনকে অন্য দিকে ধাবিত করার কৌশল গ্রহণ করে। তাই এই ধরনের অপসংস্কৃতি, অপশব্দ থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। মানুষ, মানবতাবোধ নিশ্চিত করতে হবে। মনুষ্যত্ব জাগ্রত রেখে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে আমাদের কাজ করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)