বাংলাদেশের মুজাহিদরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহে তাদের ঘাঁটি গাড়ছে জানিয়ে বুধবার একটি
প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশটির প্রভাবশালী আনন্দবাজার পত্রিকা।
প্রতিবেদনে পত্রিকাটি দাবি করেছে, প্রশিক্ষিত এসব জঙ্গিরা আফগানিস্তানের তালেবান সদস্যদের কাছে থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ থেকে একটা সময়ে তারা আফগানিস্তানে গিয়েছিল আল কায়দার কাছে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় বছর কুড়ি আগে থেকেই ধীরে ধীরে তাদের ‘ঘর ওয়াপসি’ শুরু হয়েছিল। ওসামা বিন লাদেনের হাতে গড়া সেই বাংলাদেশি মুজাহিদদেরই এখন ভারতের নিরাপত্তার পক্ষেও বড়সড় ঝুঁকি বলে চিহ্নিত করছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।
বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সম্প্রতি জানিয়েছেন, আফগানিস্তানে বেশ কয়েক হাজার বাংলাদেশিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ওসামা বিন লাদেন।
আনন্দবাজারকে ইনু বলেন, ‘পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইএর ব্যবস্থাপনায় তিন থেকে পাঁচ হাজার বাংলাদেশি মাদ্রাসা-ছাত্র সাবেক সোভিয়েত সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আফগানিস্তানে গিয়েছিল। তারাই বাংলাদেশে ফিরে যাবতীয় জঙ্গি কার্যকলাপ শুরু করে।’
বাংলাদেশের গোয়েন্দা-কর্তাদের একাংশও মানছেন, এই মুজাহিদদের থেকে বিপদের ঝুঁকি শুধু বাংলাদেশের নয়, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতেরও।
ঢাকায় ডিআইজি পদমর্যাদার এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘জেএমবি-র অনেক নেতাই এখন তাদের সংগঠনের নাম বলে- জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ। জিজ্ঞাসাবাদে নেতারা জানিয়েছে, দুই বাংলা মিলেই খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা।’
ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএর আইজি সঞ্জীব সিংহ বলেন, ‘আল কায়দার প্রশিক্ষিত এত জঙ্গি বাংলাদেশে থাকলে, পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে তো দুশ্চিন্তা থাকবেই!’
বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, আশির দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে কয়েক হাজার ছাত্র আফগানিস্তানে লড়াই করতে যায়। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে আফগান-পাকিস্তান সীমান্তের বিভিন্ন শিবিরে প্রশিক্ষণের পরে তাদের যুদ্ধে পাঠানো হয়। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পরে পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় তারা দেশে ফেরা শুরু করে। তাদের নেতৃত্বেই বাংলাদেশে গড়ে ওঠে ‘হুজি-বি’ (হরকতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) ও ‘জেএমবি’ (জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ)। দুটি নামেরই অর্থ- ‘বাংলাদেশের মুজাহিদদের সংগঠন’।
দুদশক ধরে নানা ওঠাপড়ার পরে হুজি এখন কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেও দুই বাংলা জুড়ে সংগঠন বাড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে জেএমবি। শেখ হাসিনা সরকার এই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে অভিযান চালানোয় এই সব মুজাহিদরা এখন মালদহকে ঘাঁটি করে এগোতে চাইছে বলে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) সূত্রে দাবি করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, বাংলাদেশি জঙ্গিরা বিশেষ করে কালিয়াচক, বৈষ্ণবনগর এলাকাকেই ঘাঁটি হিসেবে পছন্দ করছে।
কিন্তু মালদহই বা কেন? কারণ হিসেবে সম্প্রতি হাতে আসা কয়েকটি তথ্য পেশ করেছেন গোয়েন্দারা।
এক, সম্প্রতি কালিয়াচকের সীমান্ত ঘেঁষা একটি আমবাগানে জিহাদি প্রশিক্ষণ দিয়ে গিয়েছে জেএমবির নেতারা। এনআইএ জেনেছে, ডজন খানেক স্থানীয় যুবক সেখানে অন্তত চার দিন প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তারপর আর তাদের খোঁজ নেই। রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেখানে, সঙ্গে ছিল শারীরিক কসরত ও জিহাদি পাঠ। প্রশিক্ষকদের মধ্যে অন্তত একজন মুজাহিদ ছিল বলে খবর।
দুই, এ বছর জানুয়ারি মাসে কালিয়াচকে যে অশান্তি, হিংসা ও আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে, তাতে শুধু স্থানীয় দুষ্কৃতীরাই নয়, এনআইএর কাছে নির্দিষ্ট খবর— বাংলাদেশ থেকে ৫৪ জন জঙ্গি চোরাপথে সীমান্ত পেরিয়ে কালিয়াচকে ঢুকেছিল। পদ্মাপারের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় জেএমবির একটি আস্তনায় বসে মুজাহিদরাই এই পরিকল্পনাটি সাজিয়েছিল।
তিন, বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে (ইউএপিএ) অভিযুক্ত এক ব্যক্তিকে বৈষ্ণবনগরের একটি গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে আনার সময়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েন। বোমা ছুড়ে, সড়ক অবরোধ করে এবং গাড়ি ভাঙচুর করে আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়। গোয়েন্দারা জেনেছে, এই কাজের অভিযুক্তদের মধ্যে দুজন সেই সময়ে বাংলাদেশের দুটি মোবাইল নম্বরে ফোন করে যোগাযোগ রাখছিল এবং সেখান থেকেই নির্দেশ পাচ্ছিল।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের মতে, বেআইনিভাবে ভারতে ঢোকার সব চেয়ে সহজ পথ মালদহ সীমান্ত। এই জেলার সীমান্তবর্তী এলাকার পরিবেশ-পরিস্থিতি সব দিক দিয়ে জঙ্গিদের মদত দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে। আইএসআই-এর পাঠানো কোটি কোটি টাকার জাল নোটের অধিকাংশটা এই পথেই ভারতে ঢোকে। মাদক, সোনা ও গরু চোরাচালানের সঙ্গে এই জাল নোট পাচারের বিষয়টিও নিয়ন্ত্রণ করে জঙ্গিরাই। মালদহের ঠিক ওপারে বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা।
এছাড়া গোটা রাজশাহী জুড়েই জেএমবির ঘাঁটি ছাড়ানো। এনআইএর এক কর্মকর্তা বলেন, চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ জাল নোটের কারবারিদের প্রধান আড্ডা। গত বছর নভেম্বরে সেই শিবগঞ্জ থানায় গিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দারা জানতে পারেন, আগের এগারো মাসে জাল নোট সংক্রান্ত মাত্র তিনটি মামলা পুলিশের কাছে দায়ের হয়েছে। যা শুনে হতবাক হয়ে যান তারা।
সব দেখে ভারতীয় গোয়েন্দাদের মনে হয়েছে, কোনো এক অজানা কারণে বাংলাদেশের প্রশাসনের একটা অংশও রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের চোরাচালান ও জাল নোটের কারবার রুখতে ততটা তৎপর নয়। পুলিশের বদলে র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন) বা গোয়েন্দা সংস্থা এই এলাকায় বাড়তি নজরদারি চালালে জঙ্গিদের কাজকর্ম হয়তো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।’