গ্রামীণফোনের কাছে পাওনা বিটিআরসি’র প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে আদালত নির্দেশ দিয়েছে। গ্রামীণফোন, রবি ও বিটিআরসি এর মধ্যে তীব্র এই দ্বন্দ্বের এখানেই সমাপ্তি নয়। আইনি মারপ্যাঁচের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সুরাহা হবে জনগণের টাকার। কিন্তু তার জন্যে আরও অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে। গ্রামীণফোনকে সবোর্চ্চ আদালতের ২ হাজার কোটি টাকার নির্দেশ দেওয়ার পরে জাহিদ নেওয়াজ খানের পরিকল্পনা, রাজু আলীমের প্রযোজনা ও সোমা ইসলামের উপস্থাপনায় চ্যানেল আই এর টু দ্য পয়েন্ট অনুষ্ঠানে মুখোমুখি হন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
প্রশ্ন: গ্রামীণফোন বলছে- তাদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে? রবি’র অভিযোগও একই। আপনি কি বলবেন?
মোস্তাফা জব্বার: টাকা জোর করে যদি আদায় করতে হয় তাহলে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ কিংবা লুটেরা- কিছু না কিছু একটা হতে হয়। জিপি এবং রবি বাংলাদেশে বিধিবদ্ধভাবে আইনের আওতায় লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এই লাইসেন্সের আওতায় তাদের যে দায়বদ্ধতা আছে- সেই দায়বদ্ধতা অনুসারে তাদের কাছে আমরা আমাদের রাষ্ট্রের পাওনা টাকা দাবি করেছি। আর সেই দাবিটা যদি ধারাবাহিকভাবে দেখেন তাহলে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে এটি প্রতীয়মান করা সম্ভব হবে- এক দিনে তাদেরকে বলা হয়নি যে, তোমাদের যে ভুলগুলো হয়েছে যে টাকাগুলো তোমাদের পরিশোধ করার কথা ছিল সেই টাকাগুলো তোমরা যথা সময়ে পরিশোধ করো নাই। আমরা তোমাদের ভুলগুলো সনাক্ত করে দিচ্ছি এবং সেই অনুপাতে রাষ্ট্রের টাকা তোমরা পরিশোধ করো। অতএব এখানে আমি মনে করি- কোন আইন সংগত প্রতিষ্ঠান আইনের আওতায় বিধিবদ্ধ কোন প্রতিষ্ঠান এই ধরণের শব্দ যদি প্রয়োগ করে তাহলে আমার মনে হয়- আইন সম্পর্কে তাদের ধারণা নাই। অথবা রাষ্ট্র কাকে বলে এবং তার আইন কানুন কি সে সম্পর্কেও তাদের ধারণা নাই। আমরা খুব ষ্পষ্ট করে বলেছি- জিপি’র পরিচালনা যখন ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত তারা যে লাইন্সেসিংয়ের শর্তাবলী অনুসারে যে টাকা পরিশোধ করার কথা সেই টাকা পরিশোধ করে আসছে। তার মধ্য থেকে আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে, কোন একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও যদি পরিচালিত হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানও যদি পরিচালিত হয়- তখন অডিট নামক একটা জিনিস হয় অর্থ্যাৎ হিসাবটাকে পরিক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হয়।
সরকারি অফিসগুলোতেও অডিট অবজেকশন হয়। সেই অবজেকশনগুলো সরকারি অফিসও মোকাবিলা করে। ব্যবসায়ি প্রতিষ্ঠান যারা নিয়মের আওতায় বিধিবদ্ধ থাকে তাদের অডিট করতে হয় এবং অডিট করে সাধারণ সভায় অনুমোদন করে তারপরে করতে হয়। আমরা ঠিক তাদের কাছে একটা অডিট করা জিনিস- সেই জিনিসটি তাদের সম্মতি এবং তাদের সাথে আলোচনা ও সাথে সকল বিষয়ে নিয়ে একবারে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দাবিটা পেশ করেছি এবং তা যথেষ্ট সময় নিয়ে করা হয়েছে। এই সময় নিয়ে করার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে- যাতে আমরা আইনগত দিক থেকে যতোটা ন্যায় সংগত সেই পথ ধরে যেনো যেতে পারি।
প্রশ্ন: বিটিআরসি’র মত একটি প্রতিষ্ঠান থাকতে এতোটা সময় কি করে লাগলো এবং এই ফাঁকিটা কি করে ঘটলো?
মোস্তাফা জব্বার: ফাঁকিটা যেটা সেটা হলো- আমি এইভাবে বলতে চাই যে, এই অপারেটরা কিন্তু বিটিআরসি’র পাওনা দিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। অর্থ্যাৎ যেই সব ক্ষেত্রে তাদের টাকা দেওয়ার কথা। যেমন ধরেন, তাদের রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের প্রশ্ন আছে। এসওআর ফান্ডের টাকা আছে। তাদের ট্যাক্স ভ্যাট পরিশোধের ব্যাপার আছে। এইগুলো কিন্তু তারা নিয়মিতভাবে দিয়েই এসেছে। অডিট করার উদ্দেশ্য হচ্ছে- এই দেওয়ার মধ্যে কোথাও কোন ত্রুটি থেকে গেছে কিনা অথবা কোন বিষয় তারা ইগনোর করে গেছে কিনা অথবা কোন বিষয় তারা চেপে গেছে কিনা? আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন, ইভেন অতি সাধারণ বিষয়-আপনি একটা ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন দিয়েছেন। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়- ঠিক আছে, আপনি যখন স্ব:প্রণোদিত হয়ে রিটার্ন দেন- এটা হয়তো সঠিক। কিন্তু মাঝে মধ্যেই খুঁজে বের করে দেখা হয় যে, এই মধ্যে কি ত্রু টি বিচ্যুতি আছে? যদি ত্রু টি বিচ্যুতি থাকে তাহলে কিন্তু বাড়তি দাবি নামা পেশ করা হয়। আমাদের দিক থেকে যেটা হয়েছে- তার মধ্যে প্রথম হলো- ৯৭ সাল থেকে আমাদের দেশে তারা অপারেট করে আসছে। আমরা তাদের পরিচালনাগুলো দেখে আসছি এবং আমরা ১১ সাল পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে অপেক্ষা করেছি এই যে, হয়তো যদি কোন ভুল ত্রু টি থাকে তাহলে তারা নিজেরাই খুঁজে বের করবে এবং তারপরে সেই ভুল অনুসারে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
প্রশ্ন: বিটিআরসি যে অডিট করলো না। তার কারণে ২০ বছরের যে বিলম্ব ফি জমলো- তার দায় কে নেবে?
মোস্তাফা জব্বার: যদি আমাকে বলা হতো যে, অডিট করা পর্যন্ত সময়কাল। এই সময়কালের মধ্যে কোন বিলম্ব ফিস হয়নি। বিলম্ব ফিস হয়েছে- অডিট করার পরে দাবি নামা পেশ করার পরে যখন কেউ টাকা পেশ করে না। তখন সেই বিলম্ব ফিস তো তাকে দিতেই হবে। কারণ দাবি নামা পেশ করার প্রেক্ষিতে- অডিট বিলম্ব হয়েছে বলে তার জন্যে আমি টাকা দাবি করি নাই। আমি টাকা দাবি করেছি- অডিট করার পরে যখন টাকা স্থিরকৃত হয়ে গেছে। সেই টাকাটা যখন আপনি না দেবেন- তখন নিয়ম মাফিক আমি জরিমানা করেছি। বিটিআরসি কিন্তু বাংলাদেশে সংসদে পাশ করা আইন অনুসারে পরিচালিত হয়। বিটিআরসি’র সমস্ত কর্মকাণ্ড সেই আইনের আওতায় পরিচালিত হয়ে থাকে। অতএব আইনের বাইরে একচুল যাওয়ার ক্ষমতা কিন্তু বিটিআরসি’র নাই। সেই ক্ষেত্রে তারা আমাদের কাছে কখনোই এই কথাটা বলে নাই যে, আপনি যে কথাটা বললেন- এই আমি প্রথম শুনলাম, পত্রিকায় রিপোর্ট দেখেছি যে, আমরা চাঁদাবাজি করছি। টাকা দাবি করে এই রকম করছি। এটি তাদের জঘন্য অপরাধ। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ উত্থাপন করাটা সত্যি সত্যি খুব খারাপ।
প্রশ্ন: এর জন্যে কি কোন মামলা বা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে?
মোস্তাফা জব্বার: আমরা একচুয়ালি- ওই পরিমাণ এগ্রেসিভ না যে, একটা শব্দের জন্যে আমরা মামলা করতে যাবো। কিন্তু আমি মনে করি তারা বাংলাদেশে বিধিবিধান অনুযায়ী লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়ে ব্যবসা করছে এবং বাংলাদেশের আইন অনুযায়ীই তাদেরকে ব্যবসা করতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নাই। ল অব দ্যা ল্যান্ডকে ইগনোর করার ক্ষমতা কারো নাই। এই দেশের আইন তাদের জন্যে প্রযোজ্য সেই আইন অনুযায়ী তাদেরকে ব্যবসা করতেই হবে।
প্রশ্ন: তারা আইন অনুযায়ী ব্যবসা করছিল না। কিন্তু এতোদিন পার পেয়ে গেলো কিভাবে?
মোস্তাফা জব্বার: এটা কিন্তু ওইভাবে হয়নি। আমরা ২০১১ সালে যখন অডিট করি। অডিট করার পরে জিপি মামলা করে। মামলা করার প্রেক্ষিতে আদালত আমাদেরকে পুনরায় অডিট করার নির্দেশ দেন। ফলে আমরা ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৯৯৭- ২০১৪ এই সময় পর্যন্ত এক সাথে করে তারপরে দ্বিতীয়বার অডিট করেছি এবং এটি তাদের সন্তুষ্টির জন্যে প্রক্রিয়া যতোটা অনুসরণ করা হয়েছে- তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। ত্রিপক্ষীয় আলোচনা করা হয়েছে। তাদের অবজেকশনগুলো যাচাই বাছাই করা হয়েছে এবং এই অডিট ফার্ম নিয়োগ করার ক্ষেত্রে পিপিআর অনুযায়ী ওপেন টেন্ডার করে তারপরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: তার মানে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়েছে?
মোস্তাফা জব্বার: হ্যাঁ। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে- স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে কিন্তু পুরো কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে। খুব সংগত কারণে আমরা এটা প্রত্যাশা করেছিলাম। যখন অডিটটা স্থিরকৃত হয়ে গেছে। তাদের দেনা পাওনার অন্যান্য বিষয়গুলো যখন নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তারপরেও তাদের এই বারেও যে ঘটনাটি ঘটেছে- আমাদের কাছে খুবই বিষ্ময়কর। এটি তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে- চট করে আদালতে গেলো এবং আদালতে গিয়ে এমন একটা অবস্থার তৈরী করলো যে, পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। এই যে লম্বা হয়ে আসছে তার মধ্যে কিন্তু? হ্যাঁ- আপনি যদি বলেন ৯৭ থেকে ১১ পর্যন্ত ওই সময়টায় অডিট হয়নি কেন? এটা আমি স্বীকার করবো- আমরা ওই পরিমাণ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ছিলাম না। আমরা বুঝি নাই যে, এইখানে ফাঁকি দেওয়ার বিষয় থাকবে। অথবা এইখানে অডিট করার বিষয় থাকবে।আমরা তো ১১ সালে অডিট করে দিয়েছি। তারপরে যে সময়টা গিয়েছে তা আমাদের জন্যে যায়নি। সেই সময় পুরোটা তাদের জন্যে গিয়েছে।
প্রশ্ন: গ্রামীণ ফোনের কাছে বিটিআরসি’র মূল দাবি ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রকৃত পাওনা ২ হাজার ৩ শত কোটি টাকা। তাহলে ১০ হাজার কোটি টাকা কি?
মোস্তাফা জব্বার: এর মধ্যে দুটো অংশ আছে- একটা আছে ৬ হাজার কোটি টাকার মতো। যেটা হলো- জরিমানা ও সুদ। আর বাকী যেটা আছে তা হলো- ট্যাক্স ও ভ্যাট। ফলে বিটিআরসি’কে এই দায়িত্বও পালন করতে হচ্ছে। সে কিন্তু এই যে মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে যে ট্যাক্স এবং ভ্যাট প্রাপ্ত হয়- এই টাকা কিন্তু আদায় করে বিটিআরসি’কে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। অতএব সেটাও এর ভেতরে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।
প্রশ্ন: এই ১০ হাজার কোটি টাকার হিসাব হচ্ছে এটা- ভ্যাট ও ট্যাক্স।
মোস্তাফা জব্বার: এগজ্যাক্টলি। ওইটা সহ বিলম্ব, জরিমানা ও অন্যান্য বিষয়গুলোও আছে। আমরা একটা বিষয় ষ্পষ্ট করে বলতে চাই। আজ আদালতের রায়ের পরে- আদালত নির্দেশনা দিয়েছে। আদালত সবার উর্দ্ধে। আমাদের কাছে আদালতের রায় একেবারে বেদবাক্য। সুতরাং আমরা সেই নির্দেশ পালন করবো। আমি আশা করি যে, এই দেশে যারা ব্যবসা করবে তারা অথবা এই দেশের যারা নাগরিক প্রত্যেকের কাছে আদালতের রায় মেনে চলা বাধ্যতামূলক। এর বিকল্প কোন কিছু নেই। আদালতে কিন্তু বিটিআরসি যায়নি? আদালতে গিয়েছে গ্রামীণফোন এবং আদালতে গিয়ে- একবার নিম্ন আদালতে ওরা হেরেছে। আদালত বলে দিয়েছে যে, না- তোমাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার যে প্রক্রিয়া তা বন্ধ করা যাবে না। তারপরে তারা হাইকোর্টে গিয়েছে এবং সেখানে গিয়ে তারা একটা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এসেছে যে, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যাবে না। তো- অবভিয়াসলি আমাদের সামনে রাস্তা একটাই খোলা আছে যে, এই নিষেধাজ্ঞার উপরে আমরা আপিল বিভাগে গিয়েছি এবং আপিল বিভাগ এই রায় দিয়েছে।
প্রশ্ন: কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী এর ফলে আপনারা তাদের ব্র্যান্ডউইথ কমিয়ে দিয়েছেন । এতে গ্রাহকদের ভোগান্তি হচ্ছে। এই বিষয় কি আপনারা মাথায় রেখেছেন?
মোস্তাফা জব্বার: আমি শুধু মাথায় রাখি না। আমি তাদেরকে বলবো- প্রাকটিক্যালি আমাদের না হয় ৫ মাসের জন্যে বলছেন যে, তারা যন্ত্রপাতি আনতে পারছেন না। ৯৭ সাল থেকে যে ব্যবসা করে এসেছে এবং ব্যবসা করার ক্ষেত্রে জনগণের যে ভোগান্তি তৈরী করেছে গ্রামীণফোন তার জবাবদিহি করতে হবে। আমি খুব ষ্পস্ট করে বলতে পারি- একদম ওদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন- গ্রামীণের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত কোটি। এই সাড়ে ৭ কোটি গ্রাহকের জন্যে পর্যাপ্ত ষ্প্রেকট্রাম কি তারা কিনেছে? এটা তো আমরা এখন বন্ধ করিনি। আমরা তাদেরকে হাতে পায়ে ধরে বলেছি যে, তোমরা প্রয়োজনীয় ষ্প্রেকট্রাম কেনো। গত ৫ মাসে হয়তো তোমরা তোমাদের যন্ত্রপাতি ছাড় করাতে পারছো না। কিন্তু তার আগে তোমরা কোথায় ছিলে? তার আগে কেন এমন পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছে? আমি আমার অফিস থেকে নিজের বাড়ী যাবো দুই তিন কিলোমিটার রাস্তা তার মধ্যে আমার ৮ বার কলড্রপ হয়। আমার ধারণা গ্রামীণ যারা ব্যবহার করেন তাদের প্রত্যেকেরই এই অভিজ্ঞতা আছে- কলড্রপ হচ্ছে, নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। এইগুলো তো অজুহাত হিসেবে দাঁড় করালে চলবে না। তার পাশাপাশি একইভাবে আমরা বলবো। এর মানে এই না আপনি জনগণের টাকা দেবেন না?
প্রশ্ন: পাশের দেশেও এতো তো ফোনের বিল, নেটওয়ার্ক চার্জ- এতো কিছু তো নেই। কিন্তু আমাদের দেশে এতো কেন কলরেট? ইন্টারনেট জিবি’র দাম কেন কমানো হয় না? বিটিআরসি’র ভুমিকা এখানে কি?
মোস্তাফা জব্বার: বিটিআরসি তার ভূমিকার ক্ষেত্রে যে রোলটা প্লে করার দরকার সেটা ডেফিনেটলি করে। কারণ বিটিআরসি যেটি করে- যেমন, মোবাইল ফোন। মোবাইল কলের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন একটা রেট ফিক্সড আপ করে দিয়েছে এবং সর্বোচ্চ একটা রেট ফিক্সড আপ করে দিয়েছে। আপনি যখনি কোন অপারেটরের উপরে দায়িত্ব দেবেন। তখন আমরা শুধু দেখবো- নীচেরটার নীচে চলে গেলেন কিনা ? আর উপরেরটার উপরে উঠে গেলেন কিনা? সেই কারণেই অপারেটরা তাদের ব্যবসায়ী স্বার্থ অনুসারে দাম নির্ধারণ করে থাকে এবং এটির ক্ষেত্রে বিটিআরসি এগজ্যাক্টলি এতো পয়সার রেট হবে এই ফিক্সড না করে দিয়ে একটা রেঞ্জ তেরী করে দিয়েছে। এই রেঞ্জের ভেতরে যদি থাকে? কেউ কেউ এই রেঞ্জের ভেতরে থেকে ব্যবসা করছে এবং এই অবস্থা হচ্ছে। আমি যেটা মনে করি- জিপি এই জায়গার ক্ষেত্রে আমাদের সাড়ে সাত কোটি গ্রাহককে জিম্মি করে প্রকৃতপক্ষে তারা কলরেট বাড়িয়ে চলে। একইভাবে তারা কোয়ালিটি অব সার্ভিস। আমরা তাদেরকে নোটিশ দিয়েছি । কিন্তু এগেইন তারা তাদের অভ্যাসের বশে আবার গিয়ে আদালতের কাছে হাজির হয়েছে। কিন্তু আমি যখন দেশে থাকি। আমি যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা- আমাকে তো দেশের আদালত মেনে চলতে হবে।
প্রশ্ন: কিন্তু সমালোচনা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান টেলিটককে প্রমোট করার জন্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গলা চেপে ধরছেন? কিংবা প্রশাসক বসানোর চেষ্টা করছেন?
মোস্তাফা জব্বার: প্রথমত হচ্ছে- এদের এনওসি বন্ধের কাহিনী ৫ মাসের। এই ৫ মাসে টেলিটককে আমরা এমন কোন সুবিধা দেই নাই যে, তারা এগিয়ে যাবে?
প্রশ্ন : ৫ মাস নয়- অনেকের ধারণা, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করেই আপনারা এটা করছেন?
মোস্তাফা জব্বার: ভবিষ্যতের পরিকল্পনা- তারা যদি ব্যবসায় টিকে থাকার জন্যে প্রতিযোগিতা করার মত সক্ষমতা অর্জন করতে না পারে তাহলে এটি টেলিটক না হোক, অন্য কোন টক হোক বা কেউ না কেউ এসে তাদের বাজার দখল করবে এটা মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়ম। আপনি কোনভাবেই কাউকে কুক্ষিগত করে রেখে দেবেন অথবা জিম্মি করে রেখে দেবেন এই অবস্থা চলমান থাকে না।
প্রশ্ন: জিপি রবি মার্কেটটা মনোপলি করে রেখেছে তা হলে এখানে কি নতুন কোন বিদেশী বন্ধু এসে হাজির হবে?
মোস্তাফা জব্বার: যে কেউ এসে যদি মনে করে- তার ব্যবসার জন্যে পরিবেশ পায়- সব কিছু পায় যেটা আমরা দিতে রাজী আছি তাহলে যেকোন অপারেটরকে আমি স্বাগত জানাবো যে, যদি আমার জনগণকে সেবা দিতে পারে।
প্রশ্ন: এই ব্যাপারে কারো সাথে আলাপ হয়েছে?
মোস্তাফা জব্বার: এক সময় বাংলাদেশে এমন একটা ধারণা তৈরী হয়েছিল যে, যখন আমি টেলিকম নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করি। একটু বলে রাখি- কেন টেলিটক জিপি বা রবি হতে পারেনি? প্রথমত হলো- ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের রেলওয়ে ফাইবার থেকে আরম্ভ করে গ্রামীণ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিং পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে জিপি সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়ে আসছে। আপনি যদি তুলনা করেন- তাহলে জিপি’র ইনভেস্টমেন্টের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা আর আমি ২০১৮ সালে এসে পেয়েছি টেলিটকের ইনভেস্টমেন্ট ছিল ৩ হাজার ৬ শত কোটি টাকা। দশ ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম। আমি কেমন করে আশা করবো যে, টেলিটকের মত একটা প্রতিষ্ঠান জিপি’র সাথে প্রতিযোগিতা করবে? বরং আমরা দেখতে পেয়েছি যে, জিপি যেহেতু একটা মার্কেট শেয়ার দখল করে ফেলেছে সেহেতু তারা সে স্বেচ্ছাচারিভাবে যা তার পছন্দ হয়েছে- যা তার করতে ইচ্ছে হয়েছে। যে কোন কলরেট দিতে চেয়েছে এবং যে কোন ইন্টারনেট দিতে চেয়েছে। আমরা যখনই নিঃয়ন্ত্রণের দিকে যেতে চাই জিপি তখনই আদালতে যাওয়ার চেষ্টা করে। আপনি ভাল করেই জানেন, আদালত একটি লম্বা প্রক্রিয়া হয়ে থাকে এবং সেই প্রক্রিয়া থেকে সুফল বের করে আনতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। আজকে আমরা যে রায়ের দিকে যেতে পারলাম-এটি কিন্তু ২০১৪ সালের ঘটনা। ১৪ সালের পরে ধারাবাহিকভাবে আমরা আজকে পর্যন্ত আসতে হয়েছে আদালত থেকে এই রায় পেতে।
প্রশ্ন: টেলিনর ৮টি দেশে ব্যবসা করছে। এই আইন আদালতের মারপ্যাচে তারা যদি বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায়। তা কি বাংলাদেশের জন্যে ভাল হবে?
মোস্তাফা জব্বার: একটু ইতিহাস বলি- আদালতে যাওয়ার আগে কি আচরণ করেছি তাদের প্রতি তাও তাদেরকে বলে দেই। আমি মন্ত্রী হিসেবে উভয়পক্ষকে নিজে ডেকে এনে তাদেরকে বলেছি- দেখো, তোমাদের একটা অডিট আছে। এটা জটিল বিষয়। এইটার ব্যাপারে একটা মীমাংসায় পৌছানো দরকার।আমরা কোন ধরণের জটিলতা সৃষ্টি হোক তা চাই না। তোমরা একটা কাজ করো তা হলো যে, আলোচনায় বসো। আলোচনায় বসার জন্যে কি বিষয়? একটা হলো- তোমাদের কাছে আমাদের পাওনা হচ্ছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। তুমি অন্তত এই সদিচ্ছাটুকু প্রকাশ করো যে, এখান থেকে একটা টোকেন অ্যামাউন্ট দিয়ে যাত্রা শুরু করবো এবং সেই অ্যামাউন্টটা যা চেয়েছিলাম তা হলো- জিপি’র কাছে ২০০ কোটি টাকা আর রবি’র কাছে ৫০ কোটি টাকা। এটাও বলেছিলাম কিস্তিতে দিবে। আরও বলেছিলাম যদি তোমাদের কাছে আমাদের প্রাপ্য না হয় তাহলে তোমরা ভবিষ্যতে যে পেমেন্ট করবে সেখান থেকে আমরা অ্যাডজাস্ট করে নেবো।তারা কিন্তু একটি পয়সাও পরিশোধ না করে আলোচনার টেবিলে না বসে তারা মনে করেছে আদালতে যাবে এবং আদালতে তারা গেছে। আদালত রায় দিয়েছে। এখন আমাদের কাছে আদালতের রায় মানা ছাড়া কোন উপায় নাই।
প্রশ্ন: এখন এই যে ৭ কোটি গ্রাহক জিপি’র। এখানে নমনীয় হওয়ার বা সহজ হওয়ার আর কোন রাস্তা কি খোলা আছে?
মোস্তাফা জব্বার: আমি আদালতের নির্দেশ মেনে চলবো। আদালতের নির্দেশে বলা হয়েছে তাদেরকে তিন মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধের। তারপরে আদালত নির্ধারণ করে দিবেন পরবর্তী অ্যাকশন কি হবে? আমি তো আদালতের নির্দেশের বাইরে যেতে পারবো না। আমার কাছ থেকে যদি জানতে চান- আমি কোন মতেই চাইবো না যে, জিপি অথবা রবি অথবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান যারা সচল এবং গ্রাহকদেরকে সেবা যারা দেয় তারা বাংলাদেশ থেকে গুটিয়ে যাক। কিংবা কোন জায়গাতে তারা বাধাগ্রস্ত হবে এটি আমি চাই না। আমরা বরং এই পর্যন্ত তাদেরকে ফ্যাসিলেটেড করে এসেছি- সহায়তা করে এসেছি এবং সুযোগ সুবিধা দিয়ে এসেছি।
প্রশ্ন: আপনারা গ্রামীণ ফোন ও রবি’র লাইসেন্স বাতিলের নোটিশ দিয়েছেন। এদের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া আদৌ কি সম্ভব?
মোস্তাফা জব্বার: লাইসেন্স বাতিলের নোটিশ দেওয়া আর বাতিল করে ফেলা দুটো এক জিনিস না? নোটিশ আমি দিতেই পারি। কারণ আমার জন্যে বিষয়টা হচ্ছে এই- আমি যখন দেখলাম আমার সমস্ত আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। আমি তাদের কাছ থেকে সামান্য একটা টোকেন অ্যামাউন্ট যখন চাইলাম এবং আমি কমিটি পর্যন্ত রেডি করে দিলাম এবং সেটার প্রতি তারা সামান্যতম সম্মানবোধ তারা দেখালো না। নিম্ন আদালতে চলে গেলো। তখন আমার সামনে বেসিক্যালি সতর্ক করা ছাড়া তো বিকল্প কিছু নাই? আমার লাইসেন্স বাতিলের চিঠি দেওয়ার আগের দিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত অফিস খোলা রেখে জিপি’র জন্যে অপেক্ষা করেছি যে, জিপি ১০০ কোটি টাকার একটা পে অর্ডার নিয়ে আসবে।
প্রশ্ন: আপনি বলতে চাচ্ছেন- তারাই দরজা বন্ধ করেছে। এখনো কি তাদের জন্যে দরজা খোলা আছে?
মোস্তাফা জব্বার: আমার দরজা বন্ধ না। সরকারের দরজা বন্ধ না।বিটিআরসি’র দরজা বন্ধ না। আমরা তাদেরকে বলতে চাই- এই টাকা ব্যক্তি মোস্তাফা জব্বারের না, বিটিআরসি’র চেয়ারম্যানেরও না-এটা জনগণের টাকা। এই টাকা জনগন নেবেই যেখান থেকেই হোক যে উপায়েই হোক।