‘মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ নামে একটি বই চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রকাশ হয়েছে। মারমাসহ পার্বত্য আদিবাসী সমাজের দুই জীবন্ত নক্ষত্র দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার বছর গবেষণা করে গ্রন্থটি রচনা করেছেন। লেখকদ্বয় ব্যক্তিজীবনে একজন অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী আর অন্যজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রাক্তন যুগ্ম সচিব উ ক্য জেন।
বইটি প্রকাশের আগে থেকে ছাত্র ও যুব সমাজের মাঝে আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারীকে নিজ উদ্যোগে বইটির মোড়ক উম্মোচনের খবর প্রচার করতে দেখেছি। বইটি প্রকাশের সপ্তাহ খানিকের মধ্যে অনেক আগ্রহী পাঠক সংগ্রহ করে পড়তে শুরু করেছেন, আবার অনেকে বইটি পড়ার আগে সংগ্রহের আনন্দ সংবাদটি দিয়ে ফেসবুকে পোষ্ট করেছেন। ভেবে রেখেছিলাম বইটি হাতে এলে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের উপর ভর করে একটি ছোট লেখা প্রকাশ করবো। তাই আগ্রহ নিয়ে ফেসবুকে পরিচিত বন্ধুদের পোষ্টের দিকে লক্ষ্য রাখছিলাম। কিন্তু পরিচিত, অপরিচিত বিশেষ করে মারমা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন মন্তব্য দেখে বইটি হাতে আসার আগেই এই লেখাটি লিখতে বাধ্য হয়েছি।
জনসংখ্যার বিচারে মারমারা পাহাড়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হলেও লেখালেখি আর গবেষণায় উল্লেখ করার মতো অবদান রাখছেন তেমনটি বলতে পারি না। বই মেলায় কোন বইপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে বলে শোনা যায় না। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে (নাচ, গান-বাজনা) কিছু দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখা গেলেও জ্ঞান সৃষ্টির ন্যায় সৃষ্টিশীল কাজে দেখা পাওয়া যায় না। তবে চর্চা যে ছিল না তেমনটি নয়। আমরা ছোট বেলায় দাদা দাদীদের দেখেছি রঙ করা কাগজে লেখালেখি করতেন। চর্চাগুলোর ধারাবাহিকতা থাকেনি। যে জনগোষ্ঠী পূর্ব পুরুষদের সৃষ্টি করা কৃষি জমি সহজে বিক্রি করতে পারেন সেই জনগোষ্ঠীর কাছে রঙ করা পাতায় (কাগজে) লেখালেখির ধারাবাহিকতা হিসেবে জ্ঞানগুলোকে লিপিবদ্ধ করার চর্চা খুব বেশি আশা করতে পারি না।
তাই প্রকাশিত গ্রন্থটি না পড়ে শুধু প্রচ্ছদ দেখে মন্তব্য করাকে আমি পূর্বের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই দেখছি। মন্তব্যসব দেখলে মনে হবে (আমরা) এক একজন বুদ্ধিজীবী, গবেষক। অনেকে প্রচ্ছদে মারমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস প্রতিফলিত হয়নি বলেও মন্তব্য করেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন প্রচ্ছদটির শিল্পী মারমা নন বলে মারমাদের চিত্র উপস্থাপিত হয়নি। অনেকে আরো মজার মজার তথ্য দিয়েছেন, প্রচ্ছদে থাকা ‘য়াক্সে’ মারমা ‘য়াক্সে’ নয় (বাঁশের তৈরি মাছ ধরার প্রযুক্তি)। জাদীও দেখতে মারমা জাদীর মতো হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার প্রশ্ন জাগে, মারমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ক বলে প্রচ্ছদ শিল্পীকেও কেন মারমা হতে হবে? মাছ ধরার স্থানীয় একটি প্রযুক্তি য়াক্সে। অনেকে এই য়াক্সেকে নিয়েও মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন ত্রিপুরা য়াক্সে (য়াক্সেতেও মারমা চাকমা ত্রিপুরা আছে প্রথম জানলাম!)। মন্তব্যগুলো দেখে আরো প্রশ্ন জাগে, মারমা ইতিহাসও সংস্কৃতি লিখতে হলে মারমা ভাষায় লিখতে হতো কিনা? গবেষক যে ভাষায় লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন তাকে সেই ভাষায় রচনা করতে দিলে সমস্যা কোথায়? ইত্যাদি।
আমরা আরো প্রশ্ন করতে পারি, পাঠক হিসেবে প্রচ্ছদ দেখেই যদি এত মন্তব্য করতে পারেন, কেন এতদিনে কাজটি শুরু করেননি? কেন এতদিন লিখতে শুরু করেননি? পাহাড়ে জনগোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস পাহাড়ের পথে ঘাটে লিখে প্রচারণা একটি অনেকদিনের পুরনো সংস্কৃতি। যদিও আমরা সমতলে কোথাও বেড়াতে গেলে কোন জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা কত, তারা কোথা হতে এসেছেন ইত্যাদি ইতিহাস প্রচারণার দেখা পাওয়া যায় না।
প্রচ্ছদ দেখে দুই এক লাইন না লিখে বইটি পড়ে কোথায় কী ভুল রয়েছে, দ্বিমত থাকলে কোথায়, কেন ইত্যাদি সব লিখতে শুরু করে দেয়া উচিত। জ্ঞানগুলোকে শুধু ফেসবুকে দুই লাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ইতিহাস লেখার যে চর্চা শুরু হয়েছে তাতে আমাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আরো সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করি। যদি আজ এই কাজটি শুরু না করি ভাবতে হবে আমাদের মন মানসিকতা এখনো সেকেলের। এখনো সেই ‘মংপ্রু সাইন রাজা’র যুগের। তিনি নাকি কোন মারমা পড়ালেখা করুক চাননি। তার জলজ্যান্ত প্রমাণ আমার বাবা। বাবা মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর আর পড়তে দেননি। বিয়ে করিয়ে বসিয়ে রেখেছিলেন। নিজ সমাজের জন্য কিছু করেননি। যিনি প্রজাদের কাউকে টিনের ঘর নির্মাণ করতে দেননি তাকে মনে রাখে কে? তাই তাকে কেউ মনে রাখেননি।
এখন সেই রাজা নেই। কিন্তু মন্তব্য, সমালোচনাসব দেখে আমরা এখনো রাজার বংশধর কিনা ভাবছি। নিজেরা কিছু করতে না পারি অন্যদের প্রচেষ্টাকেও বাঁকা চোখে দেখার চেষ্টা করি। সমালোচনা থাকবে তবে সেই সমালোচনা হওয়া চাই গঠনমূলক, সুন্দর। লেখকদ্বয়ের ব্যক্তিজীবনকে নিয়েও অনেকে আক্রমণাত্বক মন্তব্য করেছেন। আমার জানা মতে, তারা দু’জনই কেউ ফেসবুক ব্যবহার করেন না। এটি একটি সুবিধা। তারা যদি ফেসবুক ব্যবহার করতেন কেউ আর কোনদিন কিছু লিখতেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
লেখকদ্বয় কি পরিমাণ শ্রম দিয়ে বইটি রচনা করেছেন পাঠকদের বললে বিশ্বাস নাও হতে পারে। বইটি লিখতে গিয়ে কোন পারিশ্রমিক নেননি। তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে যা যা করা দরকার সেই সব কাজের খরচটুকু মারমা উন্নয়ন সংসদ থেকে সহযোগিতা নিয়েছিলেন মাত্র। যেটুকু সহায়তা পেয়েছিলেন তাতেই তারা মারমা উন্নয়ন সংসদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। গবেষণার পূর্বে আপনার আমার পরিচিত বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়েছিলেন কেউ গুরুত্ব দেননি বলে জানি। তারা যে সব বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়েছিলেন সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান হিসেবে কিন্তু অনেকেই ছিলেন জনগোষ্ঠীর পরিচয়ে মারমা।
লেখকদ্বয় চাইলে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাধীন উন্নয়ন পরামর্শক হিসেবে অনেক অর্থ উপার্জন করতে পারতেন। তারা যে সময়ে কাজটি শুরু করেছিলেন সেই সময়েও এনজিওর বেশ কর্মব্যস্ততা ছিল। সবকিছুকে পিছনে ফেলে এই অবসরপ্রাপ্ত দুইজন বিজ্ঞ গ্রন্থটির রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের মাসিক অবসর ভাতা খরচ করে গ্রন্থটির কাজে সময় দিয়েছিলেন। শেষের দিকে, প্রতি মাসে ভাতার অপেক্ষায় থাকতেন যা পেলে খাগড়াছড়িতে গিয়ে সহ-গবেষকের সাথে বসে কাজ করতেন। অন্যজন বইটি লেখার আগে বাগান বাড়ি নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকতে ভালবাসতেন। কিন্তু বইটির কাজে হাত দেয়ার পর নিজের শখের বাগানের বারোটা বাজিয়েছেন। কম্পিউটারে টাইপ করার অভ্যাস না থাকলেও নিজেই শিখে নিয়েছিলেন। দীর্ঘ সময় লিখতে গিয়ে অতি দ্রুত নিজের চোখ নষ্ট করে ফেলেছেন। চাশমার ফাঁকে চোখের জল পড়তে থাকলেও থেমে থাকেননি। বইটির কাজে নিজেদের পরিবার, আত্মীয় স্বজনদের দূরে রেখেছিলেন বহুদিন সেই সব গল্প আমরা কতজনে জানি?
অনেকে মন্তব্য করেছেন বইটির ব্যয়ের তুলনায় দাম কম/বেশি ইত্যাদি। আমি আগেই বলেছি বইটি রচনা করতে তারা কোন টাকা গ্রহণ করেননি এবং বই থেকে আয়ের অংশও তারা নেবেন না বলে জানি। তাই আয় ব্যয় নিয়ে কিছু বলার আগে নিজেদের প্রশ্ন করা যেতে পারে, দীর্ঘ সাড়ে চার বছর গবেষণা করতে তাদের যত টাকা প্রয়োজন ছিল তা কি আমরা যোগান দিতে পেরেছি? খোঁজ খবর রাখার বদলে বরং ‘অর্থনীতির প্রফেসর আর আমলা মিলে ইতিহাসের গবেষক’ বলে নানা তুচ্ছতাচ্ছিল্য মন্তব্য করতে ভুল করিনি।
বইটি পড়ার আগে সমালোচনা যদি করতেই হয় প্রকাশনা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সমালোচনা করতে পারি। যেমন বইটি রচনা করতে গিয়ে যে সময় আর শ্রম এই দুই লেখক ব্যয় করেছেন তার কোনটিই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি উপলব্ধি করতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানটির হাজারো ‘এজেন্ডা’র ভিড়ে এই দুই পন্ডিতকে শুধু উম্মোচন করিয়েছেন। শুধু প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিজ্ঞ পন্ডিতদের দিয়ে উম্মোচন করার চিন্তা করতে পারেননি। সমালোচনা, মন্তব্য করতে গিয়ে আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার যাতে তারা সমাজের জন্য কাজ করতে আগ্রহ হারিয়ে না ফেলেন। আমরা তাদের কাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করতে পারি তাদের প্রচেষ্টাকে ধন্যবাদ জানাতে পারি। আমাদের মন্তব্যসব দেখে তরুণরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়তে পারে। আমাদের কারোর কাম্য হবে না আগের দিনের রাজাদের চিন্তাচেতনা, মানসিকাতার দিকে ফিরে যাওয়া। মারমা রাজাদের সৃষ্টিশীল কাজের ভূমিকা ছিলনা বলে পাহাড়ে মারমাদের ইতিহাস লিখতে এতদিন লেগেছে। পুরনো রাজাগণ আমাদের মাঝে না থাকলেও তাদের চিন্তা চেতনা ধারণা, বিশ্বাসগুলোকে আমরা অজান্তে লালন পালন করছি কিনা ভাবতে হবে।
ডিজিটাল যুগে এসে ‘ডিজিটাল চশমা’ দিয়ে তাদের (লেখকদ্বয়ের) কাজগুলোকে মূল্যায়ন করা দরকার। ‘এনালগ যুগের এনালগ চিন্তা চেতনা বিশ্বাসগু’লোকে পরিহার করা উচিত। তবেই আগামীতে আরো নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির পথ সুগম হবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)