৯০ কি ৯১ সাল। তখনকার বলাকা সিনেমা হল। নিউমার্কেট সংলগ্ন। চাঁদনী চকের সামনে দিয়ে রাত ৮টা বা ৯টার সময় হেঁটে গেলেই শব্দ আসতো আশপাশ থেকে- মামা লাগবো? গরম মসল্লা টু-থ্রি সব আছে। এক সিডিতে ৪টা ছবি। কোনটা লাগবো? কারটা লাগবো? তখনকার সিনেমা-টেলিভিশনের নায়িকাদের নাম বলে দিত।
কান গরম হয়ে যেত। কাছে এসে কানের কাছে যখন কথাগুলো বলতো। সেইদিন আর এখন নাই। এখন হাতের মুঠোয় মুঠোফোন, ইউটিউব আর কি লাগে? নেই সেই বেগম বাজার, নাজিরাবাজারের অলিগলিতে খুপরি ঘরে হোগলা পাতা আসর। এক টিকিটে দুই তিনটা ক্যাসেট দেখার দিন শেষ।
অনেকদিন পর সেই রকম একটা আওয়াজ কানে এল ২৭/২৮ বছর পর। মিরপুর ১০ নম্বরে। তবে উদ্দেশ্য এক তরুণ। ফুটপাত দিয়ে তরুণ হাঁটছিল ডানের বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। কিছু খুঁজছিল সে। একটা গলি থেকে আরেক তরুণ বলল হন্টনরত তরুণকে, মামা লাগবো?
মুহূর্তেই ঘুরে দাড়ালাম। সেই একইরকম হাঁকডাক।
তবে এই লাগবো আর সেই লাগবো’র মধ্যে ফারাক হচ্ছে সেই সময় সন্ধ্যার পর ওই সিনেমা হলের সামনে তরুণদের দেখলেই সিডি বিক্রেতারা হাঁক দিত। আর এখন হাঁক দেয় মাদক বিক্রেতারা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মাদক পেতে পেরেশান হতে হয় না। ঢাকা শহরের অলিগলিতে একটু খেয়াল করলেই টের পাওয়া যায় সন্ধ্যার পর ভাসমান বিক্রেতারা ওঁৎ পেতে থাকে খদ্দের ধরার জন্য। শুধু কি তরুণ? না, অনেক কিশোরী ও তরুণীকেও দেখা যায়।
কি চাই? ফেন্সিডিল, গাঁজা, ইয়াবা? সব মিলে যাবে। শুধু চোখ কান খোলা রাখতে হবে একটু। পুলিশের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। ব্যস্ত ফুটপাথ থেকে শুরু করে নির্জন পথ, কোথায় নেই ওরা? সবখানেই তরুণদের সর্বনাশ করার জন্য পুলিশকে ম্যানেজ করে বিক্রি করছে মরণনেশা।
খুবই অবাক হবার পালা, যখন দেখা গেল, একজন পুলিশ সদস্য একটাকে পাকড়াও করে একটু অন্ধকার গলিতে ঢুকে গেল, আর পেছন থেকে চার-পাঁচটা তরুণ চিৎকার করে বলছিল, মামা ধরেন ধরেন অনেক কামাইছে ও। পুলিশ সদস্যর সাথে যেন ওই মাদকবিক্রেতার সম্পর্ক বন্ধুর মতো, পুলিশও মাদকবিক্রেতার গলায় ধরে কতক্ষণ পরে বেরিয়ে এল। যেন কিছুই হয়নি, এমনভাব করে একসময় পুলিশের চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখলাম।
কদিন আগেই একটি পত্রিকার শিরোনাম দেখলাম। শিরোনাম ছিল- ‘ছাত্রলীগের নেতাদের মাদক ব্যবসা’। সেই প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ছাত্রলীগের ২০ নেতা-কর্মী। এদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতা ১০ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন, ধানমন্ডি থানা শাখার ২ জন। সম্প্রতি রাজধানীর পল্টনের নাইটিঙ্গেল মোড়ে পুলিশ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নূরে মোজাচ্ছেম ওরফে রঙ্গনসহ তিনজনকে। মামলার এজাহারে বলা হয়, ওই তিনজন দীর্ঘদিন ধরে পল্টনসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা বিক্রি করে আসছে।
এই যখন অবস্থা, তখন ঢাকা শহরের যেকোনো এলাকায় সন্ধ্যার পরে ও রকম ‘মামা লাগবো’ হাঁক কি খুবই অবাক হবার মতো কিছু? মোটেই না, বরং এখন থেকে প্রত্যেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে প্রকাশ্যে ওই মরণনেশা বিক্রি হলেও অবাক হবার কিছু নেই।
কারা এদের নিয়ন্ত্রণ করবে? আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা যখন এসবকে প্রশ্রয় দিচ্ছে অর্থের বিনিময়ে, তখন আর ঠেকায় কে? দিনরাত কিছু তরুণকে দেখা যায় সাঁই সাঁই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। বিভিন্ন ঝুপড়ি ঘরের পাশে এদের দাঁড়িয়ে থেকে কিছু কেনাবেচা করার দৃশ্য একটু খেয়াল করলেই টের পাওয়া যায়। যেন খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে এরা, জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য, এ রকমই ভাবভঙ্গি তাদের।
কেউ এদের টিকিটিও ধরার ক্ষমতা রাখে না, প্রশাসন থেকে শুরু করে সবখানে এদের লোক রয়েছে। ঘাটে ঘাটে এরা অর্থ দিয়েই এই ব্যবসা নিরবে নিভৃতে করে যাচ্ছে।
তাই দিন কি বা রাত। সন্ধ্যা কি বা অন্য কোনো সময় পেছন থেকে কেউ যদি ডেকেই বসে, মায়ের আপন ভাই মনে করে আপনাকে, মামা লাগবো? আপনি কিছু মনে করবেন না। প্রয়োজন হলে নিবেন, না প্রয়োজন হলে মাথা নিচু করে সামনে দিকে বা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাবেন। ভুল করেও স্থানীয় থানায় গিয়ে কিছু বলবেন না। কারণ ওরা সবার ভাগনে। ওদের মামারা অনেক ক্ষমতাধর।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)