নিজের মামার বিয়ে খেতে পারেনি বলে আমাকে আফসোস করে বলেছিল, ‘শাদু মামার বিয়েতো খেতে পারিনি। এখনতো আপনারা অনেকগুলো মামা। আপনাদের কারও বিয়েতে মজা করা বাদ দেবো না।’ আমার চেয়ে বয়সে মাত্র দুই বছরের ছোট। তাই সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মতো। অনেক মজা করতাম দেখা হলেই। তবে সম্মান জানাতে কখনো কার্পণ্য করতো না।
তাহমিদ রুম্মান। আমার দুলাভাইয়ের ভাগ্নে। সে সূত্রে আমারও ভাগ্নে। তবে ছিলো আপন ভাগ্নের মতোই। অনেক মেধাবী ছিলো ছেলেটি। ২০০৮ সালে নটরডেম কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশের পর যোগ দেয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে। লম্বা, সুন্দর, স্মার্ট। তাই পাইলট পেশাটি খুব মানিয়ে যেত ছেলেটির সঙ্গে। সেই পেশাটিই সম্ভবত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর জন্য।
বাংলাদেশ বিমানের যুদ্ধ বিমান এফ-৭ প্রশিক্ষণের সময় আজ সকালে বিধ্বস্ত হয় বঙ্গোপসাগরে। সাগর থেকে বিমানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হলেও এখনও নিখোঁজ আছে রুম্মান।
রুম্মানের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল গত ঈদে। সে ফোন দিয়েছিলো। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে খোঁজ খবর নিলো। তাঁর নানা, নানি মানে আমার আব্বা-আম্মার খবর নিলো। বলেছিলো ঢাকায় আসলে দেখা হবে। তবে ঢাকায় আসার পর আর দেখা করা হয়নি। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম আর সেও চাকরির কারণে কখনো যশোর, কখনো চট্টগ্রামে ছিলো বলে।
রুম্মানের ছোট ভাই সালমান আর্মিতে চান্স পাওয়ার পর মজা করে দুলাভাইকে বলেছিলাম, ‘ছোট ছেলে আদনানকে নৌবাহিনীতে পাঠানো হোক। এরপর তিনভাই তিনবাহিনীর প্রধান হয়ে আসবে বাবাকে সালাম করতে। তখন তাঁদের বাবার ক্ষমতা হবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির চেয়েও বেশি।’ সেদিন আমার এ কথা শুনে রুম্মানের বাবার পাশাপাশি রুম্মানও হাসছিলো শুধু। কিছু বলেনি। হয়তো মনে সুপ্ত একটা বাসনা ছিলো এমনটাই হবে।
আজ দুপুরে যখন খবরটা শুনলাম তখন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমরা বইতে পড়ি আদর্শ ছেলে। কেমন হতে পারে একজন আদর্শ ছেলে? রুম্মানকে যারা সামনে থেকে দেখেছেন, তাঁর সাথে কথা বলেছেন বলতে পারি তাঁরা জীবনে আদর্শ ছেলেকে দেখেছেন। আমাকে যদি বলতে বলা হয় রুম্মানের সবচেয়ে খারাপ দিক কোনটি? আমি বলবে ছেলেটি অতি ভদ্র, অতি বিনয়ী। এটিই ছেলেটির সবচেয়ে খারাপ দিক। হয়তো এটিই প্রকৃতির নিয়ম, ভালো মানুষগুলো বেশিদিন আমাদের কাছে থাকে না। আর আমরা খারাপরা বেঁচে থেকে পৃথিবীকে আরও খারাপ করে তুলি।
সিনেমাতে মাঝে মধ্যে দেখি বিমান, জাহাজ, গাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার পরও নায়ক অলৌকিক ভাবে বেঁচে যায়। ফিরে আসে সবার মাঝে। সৃষ্টিকর্তারতো ক্ষমতার কোনো শেষ নেই। তিনি আমাদেরকে তো অলৌকিক কতকিছুই করে দেখান। এমনিভাবে অলৌকিকভাবে কি রুম্মান আমাদের মাঝে ফিরে আসতে পারে না? হতে পারে না বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে সাগরে পড়ার সময় রুম্মান নিরাপদেই সাগরে অবতরণ করে অন্য কোনো জাহাজে উঠে নিরাপদ আশ্রয়ে আছে? হতে পারে না হঠাৎ আমার মুঠোফোনে একটা কল আসবে, রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলবে, ‘মামা, আমি রুম্মান বলছি। আমি ভালো আছি।’
সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা, একটাই অনুরোধ। যদি জীবনে একটাও ভালো কাজ করে থাকি, অন্তত সেটির বিনিময়েও যেনো রুম্মানকে আমাদের মাঝে জীবিত ফিরিয়ে দেন তিনি।
আদিব একরাম: সাংবাদিক।