ছোটবেলা যখন বড়দের কদমবুচি করতাম অনেকেই বলতেন- দোয়া করি বড় হয়ে মানুষ হও। একটু অবাক হতাম। কিন্তু কখনো কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি, এই কথার মানেটা কি? আমি তো মানুষই আছি, তাহলে মানুষ হওয়ার কথা কেন?
একটু বড় হয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। বুঝলাম মানুষ হওয়া শেষ হয়নি। কারণ কলেজের প্রথমদিন প্রিন্সিপাল স্যার তার লেকচারে অনেক কিছুর সঙ্গে বললেন- তোমরা ভালো ছাত্র বলে এই কলেজে ভর্তি হতে পেরেছো। আমি চাই তোমরা এইচএসসিতে আরো ভালো রেজাল্ট করো। তবে আমি তারচেয়েও বেশি চাই তোমরা ভালো মানুষ হও। মনে রেখো ভালোভাবে লেখাপড়া করলে ভালো ছাত্র হওয়া যায় কিন্তু ভালো মানুষ হওয়াটা সারাজীবনের সাধনা।
কলেজ পাস করেছি ২৮ বছর হয়ে গেলো। এই বয়সে এসে বুঝতে পারি মানুষ হওয়াটা কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষা নয় যে একবার পাস করে গেলাম, সার্টিফিকেট পেলাম আর চিরজীবনের জন্য মানুষ হয়ে গেলাম। এখন বুঝতে পারি কেন ছোটবেলায় বড়দের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলে মাথায় হাত রেখে বলতেন- দোয়া করি বড় হয়ে মানুষ হও। কারণ মানুষ হতে পারলে অন্য কিছু হওয়ার আর দরকার হয় না।
ইদানীংকালে মানুষ হওয়ার জন্য দোয়া করাটা যেন কমে গেছে। যা চিন্তার বিষয়। কারণ মানুষ না হলে লেখাপড়া করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পার হলেও কোনো লাভ নেই। লেখাপড়া করার মূল উদ্দেশ্য হওয়া দরকার মানুষ হওয়া।
আমাদের কারো কারো ধারণা শিক্ষা মানে পরীক্ষার সার্টিফিকেট পাওয়া। তাদের সারাক্ষণের ধ্যান জ্ঞান থাকে কি করে পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করা যাবে ও সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। শিশু কি শিখল না শিখল তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। সারাক্ষণের টেনশন পরীক্ষায় এ+ কিংবা এ পেলো কি না? এই ধরনের একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শিশুর স্বাভাবিক ও সঠিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তার মানুষ হওয়াটা কঠিন হয়ে যায়।
কেউ কেউ মনে করেন স্কুলে আর কোচিং সেন্টারে পাঠালেই শিক্ষা দেওয়া হয়। আর সকল শিক্ষা যেন পাঠ্যপুস্তক আর গাইড বইয়ের মধ্যে। এটি ভুল ধারণা। স্কুলের কাজ হলো শিশুকে গাইড করা। তার মধ্যে যে গুণাবলী আছে সেগুলোকে বিকশিত হতে সাহায্য করা। একটি শিশুকে মানুষ হওয়ার পথে এগিয়ে দিতে শিশু ও শিশুর পরিবারকে সহায়তা করা। শুধুই লেখাপড়া করে কিংবা পরীক্ষার সার্টিফিকেট পেয়ে মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হওয়ার জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি অনেক কিছুই শিখতে হয়।
আমাদের ছেলেবেলায় স্কুলে যাওয়ার আগেই বাড়িতে একটা বই পড়তাম। বইটার নাম ছিল আদর্শলিপি। এই বই পড়েই বর্ণমালা শিখেছি। তবে বর্ণমালা ছাড়াও এই বইয়ে ছড়ায় ছড়ায় মানুষ হওয়ার জন্য দরকারি নীতিকথা শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। যেমন: আমার পণ বলে একটা কবিতা ছিল-
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,
আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।
ভাইবোন সকলেরে যেন ভালোবাসি,
এক সাথে থাকি যেন সবে মিলেমিশি।
ভালো ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা,
পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা।
সুখী যেন নাহি হই আর কারো দুখে,
মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।
সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি,
কিছুতে কাহারে যেন নাহি দেই ফাঁকি।
ঝগড়া না করি যেন কভু কারো সনে,
সকালে উঠিয়া এই বলি মনে মনে।
শিক্ষার শক্তি মানুষের হাতে থাকলে সবার লাভ।
শিক্ষা শেষে আমরা যে যাই করি না কেন সেটা যেন মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে সেটা সবসময় দেখা দরকার। শিক্ষা তখনই পূর্ণতা পায় যখন শিক্ষা মানুষের কাজে লাগে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)