বাংলাদেশে ‘ক্ষেত মজুর ইউনিয়ন’ ও ‘খেত মজুর ইউনিয়ন’ নামে দুটি সংগঠন ছিল, যাদের অঙ্গীকার কৃষক ও কৃষি মজুরদের নিয়ে কাজ করার। আদপে তারা একটি সংগঠনে ছিল, কিন্তু মূল রাজনৈতিক দল বিভক্ত হওয়ার পর অঙ্গ সংগঠন ‘ক্ষেত মজুর ইউনিয়ন’-এ বিভাজন আসে। ভাগাভাগির পরও তাদের গঠনতন্ত্র এবং ঘোষণাপত্র হুবহু এক। তাহলে পার্থক্য কী? অনেক খুঁজে পাওয়া গেল পার্থক্য বড় ধরনের সংগঠনের নামের শুরুর শব্দ ‘খেত’ আর ‘ক্ষেত’।
গ্রামের প্রবাদ ‘কাজ নেই তো ধান-চালে মিশিয়ে বাছ’। এ ক্ষেত্রে হয়ত তেমনটিই ঘটে থাকবে। অথচ কৃষক ও কৃষি মজুরদের নিয়ে বাংলাদেশে কত কিছুই করার আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছাত্রীদের ব্যবসায় সাংবাদিকতা পড়াতে হয়। নতুন শিক্ষার্থীদের প্রথম ক্লাসেই প্রশ্ন রাখি পেঁয়াজের ঝাঁজ ও লঙ্কার তেজ, এ ধরনের প্রতিবেদন কতটা যৌক্তিক। আরও প্রশ্ন রাখি, এক কেজি কাঁচা লঙ্কা উৎপাদনে কতটা শ্রম-ঘাম ঝরাতে হয় কৃষককে। অর্থ ব্যয়ইবা কত? তাদের ‘ক্ষেতের মূলার’ গল্পও বলি। আমার এক বন্ধুর পোশাক কারখানায় গিয়েছিলাম কিশোর পুত্রকে নিয়ে। কিছু পোশাক কিনব, সেটাও আগেভাগেই জানিয়ে রাখি। ফেরার সময় দেখি, দুটি প্যাকেট। কত দিতে হবে, জানতে চাইলে উত্তর মেলে ‘ক্ষেতের মূলার দাম দিতে নেই।’ এ প্রবাদের অর্থ জানতে চাইলে উত্তর মেলে, আপনি কৃষকের মূলা ক্ষেতে গেলে ফেরার পথে কয়েকটি তরতাজা মূলা উপহার দেবেই। আমার কারখানায় এসেছেন, ধরে নেন ক্ষেতের মূলা পেয়েছেন।
এমন সরস মন্তব্যে খুশি-হাসি, সবই ছিল। কিন্তু কৃষককে যদি মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদেরও নামমাত্র দামে ক্ষেতের মূলার জোগান দিয়ে যেতে হয়? আমাদের লক্ষ টাকায় মোবাইল ফোন সেট কিনতে আপত্তি নেই। দামি সোফা সেট বা বড় পর্দার টিভি সেট গর্বের কারণ হয়। কিন্তু চালের দাম সামান্য বাড়লেই হাহাকার ওঠে।
এবারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের এক সেমিস্টার সমাপনী পরীক্ষার দুটি প্রশ্নের কথা বলি। একটি প্রশ্ন ছিল জিডিপিতে হিস্যা কমলেও কৃষি-ই বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত, আলোচনা কর। আরেকটি প্রশ্ন ছিল প্যাকেজ তৈরি সংক্রান্ত। বিষয় দেওয়া হয় চলতি বোরো মৌসুমে চাষীদের পাকা ধানের ক্ষেতে আগুন। টাঙ্গাইলে ৪০ কেজি ধান বিক্রি হয় পাঁচশ’ টাকা। এক মণ ধান উৎপাদনের খরচ কমপক্ষে পাঁচশ’ টাকা। ৪০ কেজি ধান কাটার জন্য মজুরকে দিতে হয় ৮০০-৯০০ টাকা। এ ধান কেটে কৃষকের কী লাভ?
এ সব নিয়ে আলোচনার সময় শ্র্রেণিকক্ষে সমস্যার সমাধান জানার জন্য শাইখ সিরাজের কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখার পরামর্শ দেই। ‘শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর’ মধ্যে ‘ক্ষেত’ শব্দটি কখনও কখনও বিদ্রুপ বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য-হেয় করার জন্য ব্যবহার হয়। তবে শাইখ সিরাজ ‘ক্ষেত’-এর সঙ্গে সরাসরি যুক্তদের নিয়ে দশকের পর দশক অনুষ্ঠান করলেও শিক্ষিত প্রজন্মের মধ্যে বরাবর জনপ্রিয় থাকতে পারছেন, এটা নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। মাঠের কৃষকদের মধ্যেও তিনি যেতে পেরেছেন। তারা প্যান্ট-শার্ট পরা এক শহুরে‘ সতেজ মানুষকে’ আপন জন মনে করে। আবার মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদেরও কৃষির গুরুত্ব বোঝাতে সফল তিনি।
অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব বোঝাতে ছাত্রছাত্রীরা উত্তর দেয় কৃষি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা দেয়, ১৬-১৭ কোটি লোকের খাদ্য জোগায়। অনেক শিল্পের কাঁচামাল মেলে কৃষি থেকে। মোট শ্রম শক্তির অন্তত ৪০ শতাংশ জড়িত কৃষির সঙ্গে। তাহলে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে কৃষি কেন এত অবহেলিত? এ বছরের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ৯ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর মাত্র ৪.৬৩ শতাংশ পেয়েছে কৃষিখাত। কেন এ অবহেলা? শাইখ সিরাজ এক সময় কৃষি বিষয়ে সাধারণ আগ্রহ তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন। এখন গুরুত্ব পড়ছে কৃষি পণ্যের বাজার, কৃষি বাজেট, কৃষি ও বিজ্ঞান এবং কৃষিতে নানা দেশের অভিজ্ঞতা প্রভৃতি বিষয়ে। বিনিয়োগও নজরে।
বাঙালিরা বিশ্বের যেখানে যাচ্ছে, নিজের দক্ষতা-যোগ্যতার সাক্ষর রাখছে। ধনধান্য পুষ্পভরা প্রিয় বাংলাদেশকে কৃষি কাজের মাধ্যমেও উষর মরু এলাকায় পরিচিত করানোর কাজ করে চলেছেন একদল নিবেদিত প্রাণ মানুষ, সেটা জানাতেও তিনি উৎসাহী। ইতালির বিখ্যাত ভেনিস শহরের একটি কৃষি বাজারে দেখা হয়েছিল একদল বাঙালির সঙ্গে। তারা সেখানে জমি ইজারা নিয়ে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিপণন করছে। শাইখ সিরাজের অনুষ্ঠান তাদের কাছেও জনপ্রিয়।
ষাটের দশকে ঢাকা রেডিওতে ‘মজিদের মার আসর’ নামে একটি অনুষ্ঠান জন প্রিয় ছিল। হাসি-কৌতুক মিশ্রিত অনুষ্ঠানে মূলত দেওয়া হতো কৃষি বিষয়ে টিপস। একদিন মজিদের মায়ের সময় মতো আসরে হাজির হতে কেন দেরি হচ্ছে, এমন প্রশ্নে কেউ বলেন মজিদের বাপের সঙ্গে গল্পে মেতে আছে। কেউ ভাবলেন, ভাত-ঘুমে বিভোর। মজিদের মা হাজির হয়ে জানালেন, শীতের লালশাক বড় হতে শুরু করেছে। ক্ষেতে পানি দিতে হলো। এ কথার সূত্র ধরেই উপস্থাপক আলোচনা নিয়ে গেলেন শীতের সবজি চাষে করণীয় বিষয়ে।
এখনকার মজিদের মায়েদের কাজের ধরণ বদলেছে। কৃষির আধুনিকায়ন হচ্ছে। যন্ত্রের প্রবেশ ঘটছে। অনেক ‘মজিদের মা’ গ্রামে বসবাস করেও ল্যাপটপ ব্যবহার শিখেছেন। বাড়ির আঙ্গিনায় এখন দেশী মুরগি চড়ে বেড়ায় না। বরং আধুনিক হাঁস-মুরগির খামার খুব পরিচিত দৃশ্য। ‘হাকিম আলীর মাছ চাষ’ পদ্ধতি এখন গ্রামে গ্রামে শিক্ষিত তরুণদের আকৃষ্ট করছে। কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। কিন্তু বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কম জমিতে বেশি ফলন মেলার পরামর্শের পাশাপাশি তুলে ধরা হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ বাঁচিয়ে রাখার গুরুত্ব। ছাদ কৃষির পরামর্শের সঙ্গে জানা যাচ্ছে ডেঙ্গু মশার দাপট-দৌরাত্ম্য থেকে রক্ষার উপায়। শহরের বাজার কী ভাবে ধরতে হবে, বিদেশে কৃষিপণ্য পাঠাতে হলে উৎপাদন-সংরক্ষণের জন্য কী করণীয় এসব টিপসও মিলছে কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন কৃষি পাঠ গ্রহণে শিক্ষার্থীদের প্রচুর আগ্রহ। কৃষকের হাতে বাড়তি অর্থ গেলে সার্বিকভাবে অর্থনীতিরই লাভ। তবে শাইখ সিরাজ তাদের এটাও শেখাচ্ছেন, কৃষকের রক্ত জল করা পরিশ্রমের ফল যদি মাঝের কিছু লোক খেয়ে নেয় তাহলে কৃষি ও কৃষকের ক্ষতি এবং দেশের ও ক্ষতি।
কৃষির বিকাশে শাইখ সিরাজের ‘মাটি ও মানুষ’ এবং ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষের’ অবদান সকলে স্বীকার করেন। শহুরে পরিবেশে থেকেও প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া বাংলার গ্রামকে তিনি কেবল ধারণ করছেন না, আরও উন্নত হতে কার্যকর অবদান রাখতে পারছেন এ যে মস্ত গুণ। আমাদের কৃষকদের বলা হয়ে থাকে ‘মস্ত অর্থনীতিবিদ’। কৃষির জন্য কোনটি ভাল বা মন্দ, কোন ফসল চাষে নজর দিতে হবে, কোন ফসলের চাষ ছেড়ে নতুন কিছু আকড়ে ধরতে হবে এসব তারা সহজেই ধরে উঠতে পারে। দেশের জন্য তাদের যা অবদান, তাতে তাদের আরও ভাল থাকা উচিত, এমন উচ্চারণে সর্বদা সোচ্চার মানুষটি কৃষকের খাঁটি বন্ধু বটে।
জন্মদিনে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালবাসা।
ছবি: তানভীর আশিক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)