ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য উত্তর কেরালার মালাপ্পুরম জেলায় একটি অন্তঃসত্ত্বা হাতিকে বিস্ফোরক ভরা আনারস খাইয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
এমন মর্মান্তিক হাতির মৃত্যুর ঘটনায় সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা তৈরি হয়েছে। হাতি খুনের ঘটনায় মামলা করা হয়েছে এবং জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
মোহন কৃষ্ণান নামে বন বিভাগের র্যাপিড রেসপন্স টিমের একজন ফরেস্ট অফিসার ঘটনাটি নিয়ে ফেসবুকে একটি আবেগঘন পোস্ট দেয়ার পর এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারে মানুষ।
তিন দিন ধরে পানিতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করা অন্তঃসত্ত্বা হাতিটি গত ২৭শে মে নদীতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই মারা যায়। তার মরদেহ ময়নাতদন্তের পর জানা যায় যে হাতিটি অন্তঃসত্ত্বা ছিল।
এই বীভৎস ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। হাজারে হাজারে মানুষ দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। টুইটারে পশুর বিরুদ্ধে এমন নিষ্ঠুর জঘন্য কাজের প্রতিবাদে একের পর এক স্কেচ এবং ছবি শেয়ার করেছেন মানুষ।
ছবি শেয়ার করে একজন টুইটার ব্যবহারকারী লিখেছেন, “স্বাক্ষরতার হার শিক্ষার প্রতিফলন ঘটায় না।”
বাচ্চার সঙ্গে মা হাতির কল্পিত একটি ছবি শেয়ার করে একজন লিখেছেন, “ঈশ্বরের নিজস্ব দেশেই কোথাও…. তবে কেরালায় নয়।”
সমস্ত মানুষের হয়ে ক্ষমা চেয়ে একজন লিখেছেন, “মানুষ হিসেবে আমি লজ্জিত।”
বন বিভাগ জানিয়েছে, হাতিটি এপ্রিলের শেষ দিকে বা মে মাসের শুরুর দিকে আনারস খেয়েছিল। বন আধিকারিক আশিক আলি ইউ এনডিটিভিকে বলেন, “ঘটনাটি কখন ঘটেছিল তা আমরা জানি না। তবে হাতিটি অনাহারে ছিল আর শুকিয়ে আসছিল, সেই কারণে আমাদের সন্দেহ যে ঘটনাটি প্রায় ২০ দিন আগে ঘটেছিল।”
বনবিভাগের কর্মীরা বলছে, হাতিটি বন থেকে লোকালয়ে চলে এলেও সে মানুষকে অত্যন্ত বিশ্বাস করত। তাই মানুষের দেওয়া সেই বিস্ফোরকপূর্ণ আনারস খেয়েও সে লোকালয়ে ছুটে বেড়িয়েছে টানা, কিন্তু কোনও বাড়ি বা মানুষের ছিটেফোঁটাও ক্ষতি করেনি হাতিটি।
হাতিটির মুখে আনারাস বিস্ফোরণের পর তার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মুখ ও জিভ। অসহ্য যন্ত্রণা এবং খিদে নিয়ে সারা গ্রাম হেঁটে বেড়ায় সে।এই অবস্থায় হাতিটি পানি খুঁজছিল।
নিজের চেষ্টাতেই খুঁজতে-খুঁজতে হাতিটি পৌঁছে যায় ভেলিয়ার নদী পর্যন্ত। পানির খোঁজ পেয়েই সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে নদীর মাঝে। আর সেই দাঁড়িয়ে থেকেই মৃত্যু হয় তার।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হাতিটি নদীর পানিতে শুঁড় এবং মুখ ডুবিয়ে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। যদি মুখ ফেটে যাওয়ার অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে কিছুটা মুক্তি মেলে, যদি পেটের বাচ্চাটা বাঁচে।
বনবিভাগের ফরেস্ট অফিসার মোহন কৃষ্ণন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মানুষকে বিশ্বাস করাই হাতিটির কাল হল। খাবার খাওয়ার সময় সে হয়ত ভেবেছিল, মানুষ দিচ্ছে যখন নিশ্চয় ভালো হবে। ভাবছিল নিজের আসন্ন সন্তানের কথাও। প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর কষ্টেও হাতিটি কারও ক্ষতি করেনি। আসলে ওর ভিতরে ভালো ছাড়া আর কিছু ছিল না।’
তিনি লিখেছেন, ‘হাতিটি সবাইকে ভরসা করেছিল। যখন সে আনারসটি খায়, তখনও। সে হয়ত নিজের কথা ভাবেনি, ভাবেনি শরীরের ভিতর থাকা বাচ্চাটির কথাও। আর ১৮ থেকে ২০ মাসের মধ্যে একটি নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আনতে চলেছিল সে। ‘
কৃষ্ণন জানিয়েছেন, বনবিভাগের কর্মীরা নীলকন্থন ও সুরেন্দ্রন নামে দুটি হাতিকে এনে তাকে উদ্ধার করে। আমার মনে হয় ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করছিল। মৃত্যু আসন্ন ভেবেই সে আমাদের কিছু করতে দেয়নি। নদীতে দাঁড়িয়েই শেষ নিঃশ্বাস নেয় সে। মৃত্যুর পর তার দেহ ট্রাকে করে জঙ্গলে নিয়ে যান বনবিভাগের কর্মীরা, সেখানেই দাহ করেন তাকে।
কৃষ্ণনের ভাষ্য, ‘ডাক্তার ময়নাতদন্ত করে জানান, খুব তাড়াতাড়ি এক সন্তানের জন্ম দিত ও। মরার সময় কী যে কষ্ট হচ্ছিল ওর। মাথা নত করে ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম আমরা।’
বনবিভাগ জানায়, আহত হওয়ার পর হাতিটি এতটাই শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিল যে সে টানা তিনদিন ভেলিয়ার নদীতে দাঁড়িয়ে ছিল। এই সময়ের মধ্যে হাতিটিকে মেডিকেল সেবা দেয়ার চেষ্টা করা হলেও হাতিটিকে পানি থেকে সরানো সম্ভব হয়নি।
‘তিনদিন ধরে হাতিটির মুখ এবং শুঁড় পানির নীচেই ছিল। হাতিটির চোয়ালের দুই পাশই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তার দাঁতও ভেঙে গেছে।’
পুলিশ বলছে এই নৃশংস ঘটনার তদন্ত তারা শুরু করেছে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।তবে এখনও কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি।