‘মানিকদা খুব অসুস্থ। ৯২ সালই হবে। শেষ দেখা হবে তা ভাবিনি। হাসপাতালে গেলাম, কথা বলতে পারতেন কম। বৌদি বললেন, এসেছিস। কিন্তু কথা খুব একটা বলতে পারবেনা। আমি চেয়েছিলাম ফ্যালফ্যাল করে আমার সেই মানিকদার দিকে। সেটাই পরে শেষ দেখা হল।’ চ্যানেল আই অনলাইনকে ফোনের ওপার থেকে বুধবার সকালে বলছিলেন অনঙ্গ বউ ববিতা।
সত্যজিৎ রায় এর ১৯৭৩ সালের ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্র। তার চরিত্র ‘অনঙ্গ বউ’। সত্যজিৎ রায় বা কাছের মানুষের প্রিয় মানিকদার জন্মদিনে স্মৃতির আগল খুলে বলে চলেন ববিতা।
‘খুব মিস করি মানিকদাকে। তার পাঠানো চিঠিগুলো সযতনে রেখে দিয়েছি। বাবার কাছে ইংরেজিতে লেখা চিঠিগুলো। সব আছে। আমার বেডরুমের বড় অংশ জুড়ে মানিকদার বড় বড় ছবি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মানিকদার ছবি। এগুলো যতবার দেখি ততবার মনে হয়। তিনি আছেন। পাশেই আছেন। স্নেহের ছায়া হয়ে। তিনি না ডাকলে, ‘অশনি সংকেত’ না করলে বিশ্বজুড়ে যে সামান্য হলেও পরিচিতি তা আমার এক জীবনেও হতোনা। টাইমস পত্রিকা, ফ্রান্সের লা মন্ডে, মস্কো তাসখন্দ এগুলোতে কে সংবাদ করত আর কে দাওয়াত দিত। সবইতো ‘অশনি সংকেত’ এর কল্যাণে। নির্দিষ্ট করে বললে গ্রেট সত্যজিৎ রায়ের জন্য আজকের ববিতা।’
‘খুব বড় না তখন। বীরভূম, শান্তিনিকেতনে শুটিং করার সে দিনগুলো এখনও ভাস্বর মনের মাঝে। মনে আছে, শুটিংয়ের মাঝে ঈদ পড়ল। বাড়ির বাইরে ঈদ। মন খারাপ। মানিকদা সন্দ্বীপদাকে বললেন, দেখোতো ওর জন্য কি করা যায়! ওরা ঈদে যা করে তার ব্যবস্থা কর। তারপর সেমাই রান্না হল, ঝাড়বাতি জ্বালানো হল। হইচই। সে কি আন্তরিকতা।’
‘চিঠিগুলো এখনও পড়ি। অবাক হই কত ভালোবাসা মাখানো সেসব চিঠি। বোম্বে থেকে প্রোডিউসাররা আমার খোঁজে মানিকদার কাছে চিঠি পাঠাচ্ছে। তিনি সেগুলো পাঠিয়ে আমাকে লিখছেন, তুই কাজ করবি কি না নিজে সিদ্ধান্ত নিবি। ভালো মন্দ যাচাই করে। আমি শুধু যোগাযোগ করিয়ে দিলাম। শর্মিলা ঠাকুর, জয়া ভাদুড়ি, অপর্ণা সেন এরা সবাই মানিকদার মাধ্যমে এসেছেন। পরে সবাই বোম্বেতে শাইন করেছেন। আমিও হয়ত করতাম। কিন্তু যাইনি। দুটো কারণে, একা একা বোম্বে গিয়ে দীর্ঘদিন থাকা সম্ভব ছিলনা। কারণ আমি নিজে খুব বড় যে ছিলাম তাতো নয়। জহির ভাইয়া নেই। আপাও তখন অনেকটা টালমাটাল। আর দ্বিতীয়ত নিজের দেশ। সত্যিকার অর্থে নিজের ইন্ডাস্ট্রি আমি ছাড়তে চাইনি।’
‘যখনই কলকাতায় যেতাম লেফ্রয় রোডের বাড়িতে আমার যাওয়া অনিবার্য ছিল। কারণ যাওয়ার সময় ইলিশ মাছ, বড় চিংড়ি বা অন্য মাছ নিয়ে কোলকাতা পৌঁছে ফোন দিতাম। বলতাম, দাদা মাছ নিয়ে এসেছি ইলিশ। তিনি খুব আনন্দঘন কণ্ঠে বলতেন, বাসায় চলে আয়।’
‘আজ ২৬ বছর হল মানিকদা নেই। কিন্তু তিনি আমার মধ্যে আছেন সবসময়। আমার এক জীবনের সৌভাগ্য যে একজন সত্যজিৎ রায় এর নির্দেশনায় কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।’
আজ এই মহান নির্মাতার ৯৭ তম জন্মদিন। তার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। মানিকদার মত নির্মাতা পৃথিবীতে আর আসবেনা।