রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রশ্নের অন্ত নেই। কবে যাবে রোহিঙ্গারা – এর সঠিক উত্তর বলা মুশকিল। কারণ মায়নমার যেমন এদের ফিরিয়ে নিতে সদিচ্ছা প্রকাশ করে না, তেমনি এরাও যেতে অনাগ্রহী। কিন্তু রোহিঙ্গারা মানবিকতার বির্পযয়ের নামান্তর এখন। প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা যে কেবলমাত্র টেকনাফ উখিয়াতে ১০ ফিট বাই ৮ ফিট পলিথনে মোড়া ঘরে বাস করছে তা কিন্তু নয়। বরং তাদের ঘিরে ছোট শহর কক্সবাজারের অধিবাসীরা হিমশিম খাচ্ছে নানাভাবে।
২৪৯২.৮৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছোট শহর কক্সবাজারের সুদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত আর নান্দনিক পরিবেশ শুধু বাংলাদেশ নয়,সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় স্থান। অবকাশ যাপনের জন্য দেশ বিদেশের মানুষ ছুটে আসে এখানে। আর এ শহরের মানুষ পর্যটকদের ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু পর্যটনের শহর হিসাবে খ্যাত কক্সবাজারের চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে এখন।
সরকারের বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প সাধুবাদযোগ্য হলেও অপরিকল্পিতভাবে হোটেল নির্মাণ শহরের সৌন্দর্যকে কিছুটা ম্লান করে দিচ্ছে।
অন্য দিকে রোহিঙ্গাদের ঘিরে প্রচুর এনজিও কাজ করছে এ শহরে। যার ফলে এনজিও কর্মীদের অবস্থানগত কারণে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জনজীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। যেমন বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে,বাড়ি ভাড়া বেড়েছে কয়েকগুন। এসব কারণে মানুষের কাছে রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতা দেখানোকে অভিশাপ বলে প্রতীয়মান হয়। শীতের মৌসুমে যে পরিমাণ পর্যটক থাকার কথা তেমন পরিমাণ না থাকার কারণে হোটেল ব্যবসা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই।
আবার রোহিঙ্গাদের নিয়ে বলা হয়ে থাকে, তারা নিদিষ্ট গন্ডির বাইরে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে৷ এমনকি রোহিঙ্গাদের কিছু আক্রমণত্মক ক্রিয়াকলাপের জন্য পর্যটকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে। যদিও সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে সচেতন রয়েছে। তথাপি মূল জনস্রোতে তাদের মিশে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। তারা বাংলাদেশের ভাষা সহ অন্যান্য বিষয়াদি অনেকটাই রপ্ত করছে ক্রমশ। তাদের সন্তানরা বাংলাদেশে বড় হচ্ছে বলে, এখানকার পরিবেশে, শিক্ষা দীক্ষা আরও সহজে গ্রহণ করবে। এতে করে আগামীতে রোহিঙ্গাদের আলাদা করে চিহ্নিত করার সুযোগ কমে যাবে।
টেকনাফে রয়েছে রোহিঙ্গা আর কক্সবাজারের মূল শহরের ছোট বড় হোটেলগুলোতে আছে এনজিওদের অফিস, বাসস্থান। যা পর্যটকদের থাকার পরিবেশকে ব্যাহত করে। যদিও বা এতে করে হোটেল ব্যবসায়ীরা বছরব্যাপী ভাড়া দিয়ে তাদের ব্যবসা চাঙ্গা রাখতে পারে এনজিওদের বদৌলতে। কিন্তু যেখানে দেশের পর্যটন শিল্পকে বিকাশ করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে ; সেখানে রোহিঙ্গাদের স্বার্থে কক্সবাজারের পরিবেশ,জনজীবন বিনষ্ট করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা প্রশ্নবিদ্ধ।
রোহিঙ্গাদের ফিরে নেয়ার ঢিমেতাল উদ্যোগের কারণে এনজিওগুলো এখন দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম পরিচালনা করার চিন্তাভাবনা করছে। যা ইতমধ্যে গন মাধ্যমে উঠে এসেছে। হোটেলের লবি পেরিয়ে কক্সবাজারে রাস্তায় এনজিওদের গাড়ির সরব চলাচল দেখে মনে হয় না, এ শহর সমুদ্র সৈকত আর প্রকৃতির রূপে অপরূপা।
অর্থনৈতিক অংকের হিসাবে রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতে এন জিও দের কর্মকাণ্ড প্রয়োজন তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠী হিসাবে কক্সবাজারের মানুষের জীবনযাত্রাকে নাভিশ্বাস করে তোলা মানবিকবোধকে পরাজিত করে। এখানকার মানুষ মনে করে মানবিক ভাবনায় রোহিঙ্গারা সাহায্য সহায়তা পেয়ে তাদের চেয়ে ভালো আছে। সাগর আর পর্যটন নির্ভর তাদের যে পেশা বা ব্যবসা তা দিয়ে চলা আর আগের মত সম্ভব নয়। এখানকার আদিবাসীদের কাছে সের দরে শীতের সবজি ফুলকপি, বাধাকপি কেনাকে অকল্পনীয় বলে মনে হয়। কারণ তারা আগে কোন দিন ১০/১২ টাকার বেশি দিয়ে সবজি কেনার কথা চিন্তাও করতে পারেনি। সহজ সরল এ মানুষগুলো প্রকৃতির লড়াই করে বাঁচতে জানে। অথচ আজ তারা মানবতার অনুভূতি প্রকাশ করে নিজেদের ফসলি ভূমি হারা। পাহাড় আর বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে হুমকির মুখে মানুষ ও পরিবেশ।
সুতরাং রাষ্ট্র ও সরকারকে মনে রাখতে হবে মানবতার মেয়াদ কাল থেকে কালান্তর হয়ে গেলে তার ফল হিতকর নয়। আর সে কারণে পর্যটন শিল্পের প্রানকেন্দ্র কক্সবাজারকে রোহিঙ্গা ও এনজিওর হাত থেকে পরিত্রাণ দিতে হবে। তা না হলে কক্সবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে পর্যটকরা। সে সাথে পর্যটন নির্ভর জীবন ও জীবিকা নির্বাহ মানুষের চলমান জীবন যাত্রায় নেমে আসবে বেকারত্বের অভিশাপ ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)