চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী: কতবার ব্যর্থ হলে তারে অযোগ্য বলা যায়!

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, এসএসসি পরীক্ষা ২০১৮কে সামনে রেখে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ‘প্রশ্নফাঁস’ রোধে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘ডেসপারেট’ ও ‘এ্যাগ্রোসিভ’ বলে। আপনার উপস্থিতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব জানালেন, যদি প্রশ্ন ফাঁস হয় ও তার প্রমাণ পাওয়া যায় তবে সে পরীক্ষা বাতিল হবে। শুনে হাসি চেপেছিলাম। যত মাজেজা ওই প্রমাণ পাওয়া শব্দ দুটিতে। আপনি নিশ্চয়ই পুরনো এই প্রবাদটির সঙ্গে পরিচিত যে, নয় মণ ঘিও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না। হাসি চেপেছিলাম সচিব মহোদয়কে প্রবাদটি একটু ঘুরিয়ে শোনানোর ইচ্ছে মনে আসায়। বিষয়টি এভাবে বলা যায়, ‘নয় মণ ঘি ঠিকই পুড়বে কিন্তু রাধা নাচবে না!’ অর্থাৎ প্রশ্নপত্র ঠিক ফাঁস হবে কিন্তু আপনারা কিছুতেই প্রমাণ খুঁজে পাবেন না। আসলে স্বীকার করবেন না, যে জেগে ঘুমায় তাকে কে জাগাবে, বলতে পারেন?

যা হোক আপনি, আপনার সচিব যত ইচ্ছে হুঙ্কার দিয়ে যান এ নিয়ে কিছু বলার নেই (বলে কোন লাভ নেই বিধায়)। প্রশ্ন ফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল হবে এটি খুব স্বাভাবিক এবং জানা একটি বিষয়। প্রশ্ন ফাঁস রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের সাথে পরীক্ষা বাতিলের কী সর্ম্পক? প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত অসাধু ব্যক্তিদের কী যায় আসে পরীক্ষা বাতিল হলে? বিষয়টি কি এমন যে প্রশ্ন ফাঁস রোধে আপনাদের ব্যর্থতার শাস্তি পেতে হবে পরীক্ষার্থীদের! এই হুঙ্কারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কি অবহিত আছেন আপনারা? এই যে ২০ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী ও তাদের পরিবার যে কোন মুহূর্তে পরীক্ষা বাতিলের আতঙ্ক বিনিদ্র রজনী পার করছে, যে অনিশ্চয়তা নিয়ে দিন পারি দিচ্ছে তার কিছুটা কি আপনি, আপনারা অনুভব করেন?

কোমলমতি এই ২০ লাখ পরীক্ষার্থী দুরু দুরু বুকে হলে প্রবেশ করছে কারণ তারা জানে না পরীক্ষাটি বাতিল হবে কিনা। এই অনিশ্চয়তা যদি তাদের ফলাফলকে প্রভাবিত করে সে দায় কে বহন করবে? আপনি এবং আপনার মন্ত্রণালয় তাদের জন্য একটি নিশ্চিত পরিবেশ দিতে পারেননি এ কথা অস্বীকারের কোন পথ আছে?

মাননীয় মন্ত্রী, এই পরীক্ষার্থীরা তো কোনভাবেই প্রশ্ন প্রণয়ন ছাপা, বিতরণের সঙ্গে জড়িত নয়। তবু তাদের কেন মূল্য দিতে হচ্ছে? আমরা আগেও দেখেছি প্রতিবার প্রশ্ন ফাঁসের পর অস্বীকার করা এবং এর-তার ঘাড়ে দোষ চাপানোর খেলা। ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁস হয় তাই ফেসবুক বন্ধ রাখার কথা বলেছেন! জিজ্ঞেস করতে পারি ফাঁস না হলে প্রশ্ন ফেসবুকে যায় কি করে? ভাগ্যিস বলেননি যে, যেহেতু কিছু শিক্ষক প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত তাই শিক্ষকতা পেশাটাকে নিষিদ্ধ করা হোক।

আপনি প্রশ্ন ফাঁসের প্রমান খুঁজে পান না আবার বলেন ফাঁসের জন্য দায়ী ফেসবুক, কতিপয় শিক্ষক, কোচিং সেন্টার ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্ন যদি ফাঁস নাই হয় তাহলে সে অপরাধে কেউ দায়ী হয় কি করে! নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে আর কত অভিনব যুক্তির আশ্রয় নেবেন?

প্রেস ব্রিফিং থেকে আসা আরেকটি ঘোষণার ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া নিয়ে আপনাদের কোন ধারণা আছে বলে মনে হয় না। বিষয়টি হলো প্রশ্ন ফাঁস রোধে পরীক্ষার সাত দিন আগে থেকে পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। কলেজ বন্ধ বিধায় তাদের জন্য বিকল্প ছিল কোচিং সেন্টার। তারা এবং তাদের পরিবার বিষয়টি কীভাবে নিয়েছে ভেবে দেখেছেন?সব বাদ দিলেও হঠাৎ করেই একটি প্রচলিত ব্যবস্থায় এ ধরনের আঘাত ভোটের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে সে ধারণা কি আছে আপনার?

প্রথম থেকে অষ্টম, বিসিএস বা অন্যান্য বিষয়ে যারা কোচিং করছিল তাদের কী হবে সে ভাবনা কি ছিল মনে? বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই কোচিং সেন্টার কি অবৈধ? আরেকটু এগিয়ে বলি আপনার দীর্ঘদিনের মন্ত্রিত্বে আপনি কি সর্বস্তরে মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন যে ছাত্রছাত্রীদের কোচিং সেন্টারে যেতে হবে না? প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থায়, পুঁজিবাদী সমাজে কোচিং সেন্টার একটি বাস্তবতা এটি অস্বীকারের পথ যেমন নেই তেমনি এটি বন্ধ রেখে সমস্যার সমাধানও সম্ভব নয়, তা প্রথম দু’দিনের পরীক্ষা শেষে প্রমাণিত।

সকাল ন’টা ষোলো মিনিটে ‘হিমুর ছায়া’ আইডিতে ওই দিনের বাংলা দ্বিতীয়পত্রের ‘খ’ সেট বহুনির্বাচনীর প্রশ্ন-উত্তরসহ ইমেজ আকারে ফাঁস বলে দেয় প্রশ্নফাঁস রোধ করা যায়নি। এবং বিষয়টি করা হয়েছে ঘোষণা দিয়ে। আপনাদের তর্জন-গর্জন কাজে আসেনি। আপনার ক্ষমতা আছে পরীক্ষা বাতিল করার, কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার কেবল ক্ষমতা নেই প্রশ্নফাঁস রোধের! পারেন না প্রশ্নফাঁসের উৎস চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে!

মাননীয় মন্ত্রী পরীক্ষা শুরুর আগে আপনি বলেছিলেন, ‘আমরা খুবই ডেসপারেট, খুবই এ্যাগ্রেসিভ এ (প্রশ্নফাঁস) বিষয়ে। যদি কোথাও কেউ কোনভাবে প্রশ্নফাঁসের চেষ্টা করে, তিনি কোনোভাবেই রেহাই পাবেন না। কী হবে আমিও সেটা ধারণা করতে পারি না। চরম একটা ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ কী হবে সে ধারণা আপনার যখন নেই তখন ধরে নেয়া যায় দুষ্টু লোকেরও ভয়ের কিছু নেই।

মাননীয় মন্ত্রী, এই সেদিন আপনি বললেন আপনার সময়ও প্রশ্নফাঁস হয়েছে। সে সময়ে পরীক্ষা গ্রহণের সঙ্গে জড়িত কেউ জীবিত থাকলে নিশ্চিতভাবেই বলত সব মিথ্যা, কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি! যেমন আপনি অতীতে বলেছেন- আজও বলছেন প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এক্ষেত্রে আমি আপনার সততায় আস্থা রাখি। নিশ্চয়ই আপনার সময় প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল এ কথা আপনি জেনেই বলেছেন!

আমি বরং আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দুটি গল্প বলি।

একটি দৈনিকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করি বিধায় এ বিষয়ে সাধারণের সঙ্গে আমার কিছু যোগাযোগ আছে। গল্পগুলো গত ২০১৭-এর এসএসসি পরীক্ষাকে ঘিরে। পরীক্ষা চলাকালীন এক স্কুলে গিয়েছি। কথা হচ্ছিল প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে। এক শিক্ষক সরাসরি অভিযোগ করলেন, ‘ভাই প্রশ্নফাঁসের জ্বালায় সারা রাত ঘুমাতে পারি না। অভিভাবক, পরীক্ষার্থী সারা রাত ফোনে জানতে চায়, স্যার এ প্রশ্নটা আউট হয়েছে, আপনি কি বলেন?’ আমি জোরের সঙ্গেই বললাম ‘এসব গুজবে কান দিয়েন না।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘ভাই, সব গুজব নয় কিছু প্রশ্ন কিন্তু মিলছে পুরোপুরি। আজ রাতে যদি পাই আপনাকে পাঠাব।’ যথারীতি রাত ২টায় ফোন। ‘ভাই, আমার কাছে যে প্রশ্নটা এসেছে পাঠাব? সকালে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে দেখবেন।’ আমি বাধ্য হয়েই তাকে বললাম, ‘স্যার এসব প্রশ্ন চালাচালি ঠিক নয়। অহেতুক আইনের জালে আটকাবেন।’ বেচারা ভয়ে কথা বাড়াননি।

আরেক পিতার গল্প বলি। বেচারা পরীক্ষার পর জানতে পেরেছেন এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েকে পরীক্ষার আগে ঈদে যে দুটো জামা কেনার টাকা দিয়েছিলেন, মেয়েটি একটি জামা কিনে বাকি টাকা জমিয়ে রেখেছে ফেসবুকে প্রশ্ন কিনবে বলে। এবং সে তাই করেছে। প্রশ্নফাঁস কতটা নিশ্চিত হলে এমনটি ঘটতে পারে ভেবে দেখবেন। আর আমাকে ক্ষমা করবেন, পরিস্থিতি বদলেছে- এ কথা বলতে পারছি না বলে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)