মাদার তেরেসা সেই মহীয়সী নারী যিনি আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে আজও অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন। বিভিন্ন বয়সী ছেলে-মেয়েরা, যারা বিভিন্ন দিক থেকে সমাজে অবহেলিত, মাদার তেরেসা তাদের-ই বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। আজ তাঁর ১০৫তম জন্মদিন। এই মহতী নারীর জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইলো আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মাদার তেরেসা রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত বিশ্বখ্যাত সমাজসেবিকা। তাঁর জন্ম আলবেনিয়ায় ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট। প্রাথমিক লেখাপড়া জন্ম শহর স্কেপিয়ে-তে। তাঁর পুরো নাম আগ্নেস্ বোইয়াক্সিউ। ডাক নাম গোস্কসা। গোস্কসা মূলত একটি তুর্কি শব্দ, যার অর্থ ‘কুসুমকলি’। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। বাবা ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ।
মাত্র ৯ বছর বয়সে মাদার তেরেসাকে পিতৃহারা হতে হয়। শুধু মাত্র বাসস্থানটুকু ছাড়া সর্বস্ব হারিয়ে মহা বিপদের সম্মুখীন হতে হয় পরিবারটিকে। আকস্মিক এই বিপর্যয়ের ফলে তেরেসা’র মা ভীষণ ভাবে মুষড়ে পড়েন। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে তেরেসা’র বড় বোন অ্যাগ এর ওপর। শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম। জীবনের এই সংগ্রাম থেকে দারিদ্র ও প্রতিকূলতাকে সাহস ও উদ্দীপনার সাথে গ্রহণ করার তৎপরতা আবিস্কার করেন মাদার তেরেসা।
তেরেসার লেখা-লেখির হাত খুব ভালো ছিলো। তাই অনেকেই ধারণা করেছিলেন, লেখালেখি করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করবেন। কিন্তু তাঁর আগ্রহ ছিল মানব সেবায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ঠিক করলেন সন্যাসব্রত গ্রহণ করার।
তৎকালীন সময়ে ভারতে বাংলায় ধর্মীয় কাজ করতেন যুগোশ্লাভীয় ধর্মযাজকেরা। তাদের সিদ্ধান্ত ছিলো, লরেটা সিষ্টারদের মধ্যে যারা আইরিশ সম্প্রদায়ভুক্ত তাঁরা যাবেন ভারতবর্ষের মতো এলাকায় কাজ করতে। অ্যাগনেস (মাদার তেরেসা) তাই তাদের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করতে চাইলেন। কিন্তু এই কাজ পেতে হলে, তাকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হবে, প্যারিসে।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বিনয়ী, নম্র এবং পরোপকারে নিজ জীবনকে উৎসর্গ করা, তাঁকে কি কোনো পরীক্ষায় পেছনে ফেলা যায়? আর যায় না বলেই হয়তো প্যারিসের সাক্ষাৎকারে সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তেরেসা ও তাঁর সঙ্গীনিকে পাঠানো হয় আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। তাদের সন্ন্যাস জীবনের প্রশিক্ষণ এবং ইংরেজী শিক্ষার জন্য।
প্রশিক্ষণ পর্বের প্রায় ৬ সপ্তাহ শেষে ১৯২৮ সালের পহেলা ডিসেম্বর দুই সন্ন্যাসিনী সুদূর ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে সমুদ্র পথে পাড়ি দিলেন। জাহাজেই পরিচয় হলো তিনজন অল্প বয়সী ফ্রানসিস্কান সিষ্টারের সাথে। একত্রে উদযাপিত হলো পবিত্র বড়দিন। ১৯২৯ সালের ৬ জানুয়ারি তাঁরা কলকাতা পৌছালেন। এরও প্রায় চার মাস পর ১৯২৯ সালের ২৩ মে অ্যাগনেসের নাম হলো ‘তেরেসা’।
এই ‘তেরেসা’ নামটির অন্তরালে একটি ছোট্র ইতিহাস আছে;-তেরেসা ছিল মূলত লিসিউ কনভেন্টের জনৈক ফরাসি কারমেলাইট সন্ন্যাসিনীর নাম। ইনি খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন এবং এই শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, নিজেকে হাসি-খুশি ও প্রসন্ন রাখলে নিতান্ত সাধারণ বা একঘেয়ে কাজের মাধ্যমেও সৃষ্টিকর্তার সেবা করা যায়। তিনি এর সংক্ষিপ্ত নাম দিয়েছিলেন সংক্ষিপ্ত পথ বা “দি লিটিল ওয়ে”। ১৯৩১ সালের ২৪ মে সর্ব প্রথম দারিদ্র, বাধ্যতা ও সংযমের সাময়িক সংকল্প গ্রহণ করেণ তেরেসা। সিষ্টার তেরেসার নতুন প্রশিক্ষণ শুরু হলে তাঁকে হিমালয়ের কোলের ছোট্র শহর দার্জিলিং এ পাঠানো হলো।
লরেটো কনভেন্ট স্কুলে শুরু হল তাঁর শিক্ষিকা জীবন। পাশাপাশি তিনি স্থানীয় একটি হাসপাতালেও কাজ করতেন। এখানেই সর্বপ্রথম দুঃখ ও দারিদ্রতার সাথে তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়, যা ছিল তাঁর কল্পনারও বাইরে! দার্জিলিং এর কাজের মেয়াদ শেষ হলে তেরেসা কে আবার ফিরে আসতে হলো কলকাতায়। পাহাড়ি দেশের বিশুদ্ধ মধুর বাতাস, আর ফুলে-ছাওয়া প্রান্তর ছেড়ে কলকাতা মহানগরীর পূর্বপ্রান্তের বস্তি এলাকায় এন্টালীতে লরেটো সিষ্টারদের ডেরায় বসবাস করার জন্য চলে এলেন তিনি। সিষ্টাররা যে কেবলমাত্র এন্টালী লরেটোর মতো বিরাট আবাসিক ধনী সন্তানদের পড়াতেন তাই নয়, ঐ একই গন্ডির মধ্যে ছিলো সেন্ট মেরীজ স্কুল।
১৯৩৭ সালের ১৪ মে সিষ্টার তেরেসা তাঁর জীবনের অন্তিম সংকল্প গ্রহণ করলেন। সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নিয়ে সেন্ট মেরীজ স্কুলের অধ্যক্ষা হলেন তিনি। তখনকার দিনে সন্ন্যাসিনীরা মঠের চেীহদ্দির মধ্যেই কঠোরভাবে আবদ্ধ থাকতেন। হাসপাতাল যাওয়া বা অন্য কোন জরুরী প্রয়োজন ছাড়া তারা মঠের বাইরে বের হতেন না। মঠের চৌহদ্দির বাইরে “সেন্ট তেরেসা” স্কুলে তিনিই প্রথম ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে আরম্ভ করেন।
১৯৪৬ সাল মানব ইতিহাসের কলঙ্কময় কাল। এই সময়ই পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সেই সময়ের একটি রাতে, যুদ্ধ চলাকাষীন সময়ে একদিন সিষ্টার তেরেসা তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য খাবার খুঁজতে রাস্তায় বের হলেন। রাস্তায় তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মানুষের লাশ আর লাশ। এসব লাশ দেখে খুব স্বাভাবিক ভাবেই আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন তিনি। ভয়ে তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের আর্তনাদে তিনি অবিচল হয়ে উঠলেন।
মিশনের সংবিধান গৃহীত হলো ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর। মিশনারীজ অব চ্যারিটিকে স্বীকৃতি দিল ক্যাথলিক চার্চ এবং স্বয়ং পোপ। সিষ্টার তেরেসা, যিনি একসময় ছিলেন লরেটোর শিক্ষিকা, তারপর প্রধান শিক্ষিকা। পরবর্তী কালে তিনিই হলেন মিশনারীজ অব চ্যারিটির প্রতিষ্ঠাত্রী মাদার তেরেসা। সম্ভবত তিনি নিজেও অনুমান করতে পারেননি, তাঁর আশ্রমের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি কতদূর বাস্তবায়িত হতে পারে! প্রথমে যখন তিনি সেন্ট জোসেফের প্রাঙ্গণ থেকে পথে নেমেছিলেন, তখন এই বিশ্বাস তাঁর মনে ছিলো যে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যই তিনি নিজেকে নিযুক্ত করছেন। কিন্তু একা, মাত্র পাঁচ রুপি হাতে নিয়ে তিনি যখন রাস্তায় নেমেছিলেন, তিনি কি জানতেন যে সমাচার তিনি বহন করে আনছেন তা কতদূর বিস্তৃত, সমৃদ্ধ…?
মাদার তেরেসা প্রথম পুরস্কার পান ১৯৬২ সালে। ভারত সরকার ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করেন। পরবর্তী সময়ে দুঃস্থ মানবতার সেবায় আত্মউৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ মাদার তেরেসা ১৯৭৯ সালে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ১৯৭১ সালে পোপ জন শান্তি পুরস্কার, ১৯৭২ সালে জওহরলাল নেহরু এবং ভারতরত্ম পুরস্কার পান। তিনি ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মোট ৮৪টি পুরস্কার ও সাম্মানিক উপাধিতে ভূষিত হন।
আর্তমানবতার প্রতীক মাদার তেরেসা সারাটা জীবন কাজের মাঝে ডুবে ছিলেন। কিভাবে যে কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে বার্ধক্যে পা রেখেছেন-বুঝতেই পারেননি। শুধু মানুষের জন্য কাজ-ই করে গেছেন, বিশ্রাম নেননি এতোটুকু! অতিরিক্ত পরিশ্রম আর বয়সের চাপে এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
১৯৮৩ সালে তাঁর প্রথম অসুস্থতা ধরা পড়ে। পরে তাঁর হৃদরোগ ধরা পড়লে বুকে পেসমেকার লাগানো হয়। তাতেও আরোগ্য লাভ হচ্ছিল না। এর একটা বড় কারণ ছিল প্রচন্ড অসুস্থতা নিয়েও তিনি কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়াতেন। কাজ যেনো তাকে সর্বদা তাড়া করে বেড়াতো! তাঁর হৃদযন্ত্রে বাইপাস সার্জারিও করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর ছুটে চলা থেমে থাকেনি। এভাবেই পেরিয়ে যেতে থাকে সময়। ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসে তাঁর অন্তিম মুহূর্ত।
অবশেষে ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কলকাতার মাদার হাউসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহতী নারী। তাঁর শেষ কথাটি ছিলো, “আমি আর শ্বাস নিতে পারছি না!” মাদার তেরেসা আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু মানবতার প্রতীক হিসেবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন সারা বিশ্ববাসীর কাছে…।