মাদকের ১৪১ জন গডফাদারের নামের তালিকা দুদকে জমা দিয়েছে মাদক দ্রব্য অধিদপ্তর। যে তালিকায় রয়েছে সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, হাজী, মওলানা ও আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলের নেতা। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে এমনটাই জানা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, মাদকবিরোধী অভিযান দেশব্যাপী এত ঘটা করে শুরু না করে কি এই ১৪১ জন গডফাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেত না?
এখন তো সরকার দলেও এ অভিযানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। তারা দাবি করছে, মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত নয় এমন ব্যক্তিদেরকেও জড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। বিএনপি বলছে, মাদকবিরোধী অভিযানের নামে মানুষ হত্যা চলছে। এ পর্যন্ত প্রায় একশ’ মানুষ বন্দুক যুদ্ধে মারা গেল। কিন্তু তালিকাভুক্ত ১৪১ জনের মধ্য থেকে কয়জন মারা গেল? বর্তমান সংসদে বিরোধী দল দাবিদার জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদ বলছেন, মাদক ব্যবসায়ীতো সংসদেই রয়েছে।
সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির মাদক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অনেক পত্রিকায় নিউজ হচ্ছে। তার পিএস মংমং সেন ইয়াবাসহ ঢাকায় গ্রেফতারও হয়েছেন। এলাকায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠছে। তারা নিজেদের দায় এড়াতে একে অপরকে দায়ী করেও যাচ্ছেন। এতে কি সংসদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে না?
কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেল আব্দুর রহমান বদির বেয়াই আখতার কামাল। পত্রিকায় খবর বেরোচ্ছে, বদির সব ভাই ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত। তার বাবাও চোরাচালানে জড়িত ছিল। সীমান্তের ওপাড় হতে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী এদেশে এনে সাপ্লাই করতো বলে মানুষ তাকে কোম্পানি বলে ডাকতো। বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল সে। পরে ক্ষমতার পালাবদলে আওয়ামী লীগে যুক্ত হয়। এই ব্যবসা করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের কাছাকাছি থাকতে হয় তাই এ দলবদল। আব্দুর রহমান বদিও পিতার পথ অনুসরণ করে।
নেত্রকোনায় দু’জন মাদক ব্যবসায়ী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেল। তারা দুজনই অজ্ঞাত। পরিচয় খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, তাদের বাড়িও টেকনাফে। পুলিশ যদি তাদের নাই চেনে তাহলে কী সূত্রে অভিযানে গেল তারা।মদন পুরের মনাং গ্রামে কার যোগ সূত্রে তারা এতদূর হতে মাদক নিয়ে এসেছিল? এসে বন্দুকযুদ্ধও করল! তবে কি মাদক ব্যবসায়ীরা আগ্নেয়াস্ত্রসহ গাঁও-গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে? যদি তাই হয়, কারা পাঠিয়েছিল এদের? পুলিশ কি তা উদ্ধার করতে পেরেছে? এই দু’জন লোককে না মেরে বাঁচিয়ে রেখে এই তথ্য বের করাই কি সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না?
নিহত এসব মানুষকে হত্যা না করে তাদের রিমান্ডে নিয়ে মূল গডফাদারদের খুঁজে বের করাই কি সঠিক কাজ ছিল না? তবে কি এসব হত্যাকাণ্ড মূল অপরাধীদের আড়াল করার কৌশল? এমন প্রশ্নের উদয় হচ্ছে অনেকের মাঝে। আব্দুর রহমান বদির বেয়াইকে পুলিশ হত্যা করেনি। নেপথ্যে কেউ বদিকে রক্ষার জন্য তাকে সরিয়ে দিল না তো?
পুলিশ বলছে প্রতিপক্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের গুলিতে বদির বেয়াই মারা গেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছে বদির বেয়াইও ছাড় পায়নি। প্রমাণ পেলে বদিও ছাড় পাবে না। আবার বদির সাথে ওবায়দুল কাদেরের অন্তরঙ্গ ছবিও পত্রিকায় ভেসে বেড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে জনগণ কার কথা বিশ্বাস করবে পুলিশের না ওবায়দুল কাদেরের? বিনাবিচারে হত্যা জায়েজ হলে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য আদালত স্থাপন করতে হল কেন? তাদেরকে ক্রসফায়ারের নামে কি সরিয়ে দেয়া যেতো না?
শিক্ষক, ছাত্র, ক্রীড়াবিদ ও রাজনৈতিক এসব স্তর হতে অনেকেই কাঁচা পয়সার লোভে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। আবার বিভিন্ন উপজেলায় লাইসেন্সধারী মাদকের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে দেশি মদের নামে সবধরনের মাদক রাখার সুযোগই রয়েছে। এ লাইসেন্সগুলো কেন দেয়া হল? সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আবার এইসব মাদকের লাইসেন্সধারী দোকানও রক্ষা করছে। বিষয়টা কি স্ববিরোধী হয়ে গেল না? মাদকের লাইসেন্স বাতিলের মধ্য দিয়েই কি মাদকবিরোধী অভিযানের সূচনা করা উচিত ছিল না?
অনেক সময় দেখা যায়, এই লাইসেন্সের নামেও ঘটেছে দুই নম্বরি। লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ভুয়া নামের তালিকা দেখিয়ে মদের চাহিদা পত্র দিচ্ছে। মেথর, মুচি ও উড়িয়াদের দেখিয়ে তারা বিপুল মাদক নিয়ে আসছে তথাকথিত ভদ্রলোকদের জন্য। যারা জীবনে মাদক গ্রহণ করে না এমন সাধারণ সহজ সরল মানুষদেরকে সামান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাদের নামে মাদক গ্রহণের লাইসেন্স করিয়ে নিচ্ছে। দেশজুড়ে এমন মাদক সেবনের লাইসেন্সধারী লোক কতজন রয়েছে?
গত শনিবার রাতে টেকনাফের কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা একরামুল হক বন্দুক যুদ্ধে মারা গেল। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কি টেকনাফ মাদক মুক্ত হবে? আসামী যখন কোর্টে প্রেরণ করা হয় তাকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীই নিরাপত্তা দেয়। ন্যায় বিচারের স্বার্থেই তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। একরামুলকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে মাদক সংশ্লিষ্টতার অনেক তথ্য পাওয়া যেতো না? নেত্রকোনায় যে দু’জন মারা গেল তাদের বাড়িও ছিল টেকনাফ। তাদেরকে কে পাঠিয়েছিল ও কার কাছে পাঠিয়েছিল তা এখন পুলিশ কিভাবে জানবে? নেত্রকোনায় কারও সাথে যোগাযোগের নেটওয়ার্ক না থাকলে কি তারা এভাবে আসতো? এই দু’জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিম্মায় থাকলে কি সহজেই তা জানা যেতো না?
অনেক ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে, প্রতিপক্ষের হামলায় মাদক ব্যবসায়ী নিহত। যদি তা-ই হয় এ মৃত্যু কি মাদক ব্যবসা বন্ধের জন্য হল নাকি নিজেদের মাদকব্যবসাকে একচ্ছত্র করার জন্য হল? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কি উচিত নয় এ হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টদের খুঁজে বের করা? আব্দুর রহমান বদির মাদক সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা কি নিহত বদির বেয়াই আখতার কামালের মাধ্যমে যাচাই করা যেতো না? কাউন্সিলর একরামুল হক আখতার কামালের পক্ষের না বিপক্ষের? আখতার কামাল যদি প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয়ে থাকেন এটা সত্য হয় তাহলে এর পরপর একরামুল হত্যা কি সেই হত্যা সংশ্লিষ্ট হতে পারে না? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়েও কেউ প্রতিপক্ষ দমন করতে চাইবে না তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? এভাবে বিনা বিচারে হত্যা করলে বিচার বিভাগের কি প্রয়োজন?
পুলিশের বিরুদ্ধেও মাদক সংশ্লিষ্টতার কথা শোনা যায়। যারা জড়িত তারা নিশ্চয়ই কোন না কোন মাদক সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। মাদকবিরোধী অভিযানের নামে কি তারা নিজ সিন্ডিকেট বিরোধীদের দমনে তৎপর হতে পারে না?
মাদক একটি দেশের চরম শত্রু। মাদক যুব সমাজকে ধ্বংস করছে। ধ্বংস করছে মানুষের মানবিক নীতি নৈতিকতা। ধ্বংস করছে পারিবারিক শান্তি। উচ্চবিত্ত পরিবার হতে নিম্নবিত্ত পরিবার পর্যন্ত মাদকের উপস্থিতি। গ্রামে গঞ্জে ঢুকে গেছে ইয়াবা।
আমরা মাদকমুক্ত সমাজ চাই। মাদকমুক্ত দেশ চাই। এই অভিযানটি ব্যর্থ হয়ে গেলে মাদক ব্যবসায়ীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। কথিত বন্দুকযুদ্ধে খুন নয়। যেসব লোক খুন হচ্ছে তেমন লোকদের রিমান্ডে নিন। তার কাছ থেকে মাদকের আস্তানা গুলো জেনে নিন। সেসব এলাকায় পুলিশী নজরদারি জোরদার করুন।
যেসব পুলিশ মাদক ব্যবসায় জড়িত তাদের চিহ্নিত করে অভিযান হতে দূরে রাখুন। তাদের কাছে অভিযানের তথ্যও গোপন রাখুন। নাহয় তারা অভিযানের আগেই তথ্য পাচার করে অভিযানকে ব্যর্থ করে দেবে। কয়েক জায়গায় এমনটা হয়েছে বলেও গণমাধ্যমে এসেছে। তাই দেশকে সত্যিকারের মাদকমুক্ত করতে হলে খুব সতর্ক ও পরিকল্পিতভাবেই এগিয়ে যেতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)