চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক চক্রে বাংলাদেশি গ্রুপ

মাদকদ্রব্য পাচারের শক্তিশালী এক আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটে বাংলাদেশের একটি চক্র জড়িত বলে প্রমাণ পেয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন – র‌্যাব। যে চক্রের নেতৃত্বে আছে আরিফ ও রেহেনা নামে দুই বাংলাদেশি।

র‌্যাব বলছে, আফগানিস্তান থেকে মাদক সরবরাহ করে কয়েকটি দেশ ঘুরে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে তা শ্রীলঙ্কায় পাচার করে আসছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কায় ৩০৪ কেজি হিরোইন এবং ৫ কেজি কোকেনসহ ৩ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ওই ঘটনার পর গঠিত টাস্কফোর্স তা নিয়ে তদন্ত শুরু করে।

শ্রীলঙ্কার ঘটনায় র‌্যাবের ফাঁদ
পাশাপাশি ছায়াতদন্ত শুরু করে র‌্যাবও। তদন্ত করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ চক্রের ৫ জন সক্রিয় সদস্যকে আটক করে তারা।

আটকরা হলেন- ফাতেমা ইয়াসমিন তানিয়া (২৬), আফসানা মিমি (২৩), সালমা সুলতানা (২৬), শেখ মোহাম্মদ বাধন ওরফে পারভেজ (২৮) ও রুহুল আমিন ওরফে সায়মন (২৯)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ৯৭০ পিস ইয়াবা, বেশকিছু বৈদেশিক মুদ্রা ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়।

মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।

যেসব দেশে এই চক্রের তৎপরতা
আটক ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি বলেন, মাদক পাচারে কয়েকটি রুটের তথ্য আমরা পেয়েছি। এগুলো সাধারণত আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান হয়ে শ্রীলঙ্কা এবং আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান ও মালয়েশিয়া হয়ে শ্রীলঙ্কায় যেতো।

‘‘এছাড়াও মালয়েশিয়া থেকে চীন হয়ে শ্রীলঙ্কা রুটের কথাও জানা গেছে। এ আন্তর্জাতিক চক্রে একটি বাংলাদেশি গ্রুপ সক্রিয়। যার নেতৃত্বে আরিফ ও রেহানা নামে দুই ব্যক্তির কথা জানা গেছে। রেহানা মাদকসহ চীনে গ্রেপ্তার হয়ে সেখানকার কারাগারে আছে। আরিফ কোনো এক দেশে আত্মগোপন করে রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।’’

মুফতি মাহমুদ খান আরো বলেন, মাদকগুলো আফগানিস্তান -পাকিস্তান হয়ে অন্যান্য দেশ ঘুরে শ্রীলঙ্কা গেলেও রুট হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশিদের এই গ্রুপটি দেশের অভ্যন্তরে ইয়াবা পাচার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। তাদের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমের বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

যেভাবে চক্রে জড়ায় তানিয়া
তিনি আরো বলেন, আটক ৫ জনের মধ্যে ৪ জনই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে মাদক চালানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে তানিয়া নিজ এলাকা শরীয়তপুরে ৯ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তিনি অনলাইন বিজনেসের সঙ্গে জড়িত।

‘‘২০১৬ সালে রাজধানীর তাজমহল রোডে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কোচিং করার সময় ফারহানা ও রুহুল আমিনের মাধ্যমে রেহানার সঙ্গে পরিচয় হয়। বিদেশে অল্পদিনের ভ্রমণেই লাখ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব – এমন প্রলোভনে আন্তর্জাতিক মাদক পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তানিয়া। সে ওই বছর রেহানার সঙ্গে মালয়েশিয়া গিয়ে ১০ দিন। এবং সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা গিয়ে ৩-৪ দিন অবস্থান করে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। এরপর ২০১৭ সালে আরিফের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে ২ বার ভারত, ৩ বার চীনে এবং ৮-১০ বার মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেছে।’’

র‌্যাবের দাবি, চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার সময় খালি হাতে যায় এবং অন্যদেশে গিয়ে লাগেজসহ মাদক বহন করে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে। এছাড়াও অন্যরুটে আসা মাদকও তারা সংগ্রহ করে তা বন্টনের কাজ করতো।

এক্ষেত্রে তারা মাদকের শুধু বাহক হিসেবেই নয়, চক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতেন বলেও জানান মুফতি মাহমুদ খান।

মিমি ও সায়মন
আটক মিমি বিভিন্ন জায়গায় ডিজে নাচ ও গান করতেন জানিয়ে তিনি বলেন, একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করতে গিয়ে সায়মনের সঙ্গে তার পরিচয়। এরপর সায়মনের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক মাদক পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে মিমি।

‘‘শ্রীলঙ্কার যে বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ বাংলাদেশি নাগরিক সূর্যমনিকে আটক করা হয়, সে বাড়িটি মিমির নামেই ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। সেই বাসাটি সাধারণত সিন্ডিকেটের সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মাদক বিস্কুট ও কেকের প্যাকেটে করে সাপ্লাই করা হতো।’’

মিমি ২০১৭ সালে আরিফের সঙ্গে প্রথম মালয়েশিয়া যান এবং সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা যান। ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো শ্রীলঙ্কা গেলে আরিফ তাকে সূর্যমনির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

সালমাকেও টানা হয় এই চক্রে
র‌্যাব বলছে, আটক সালমা সুলতানা ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ শুরু করেন। এ সময় তানিয়ার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে রেহানার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বেশ কয়েকবার ভারত, চীন ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেছেন।

‘‘আটক সায়মন একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে কাজ করেন। সে সুবাদে মেয়েদেরকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে চক্রে জড়িয়ে ফেলতেন তিনি। আটক পারভেজের কর্মসূত্রে আরিফের সঙ্গে পরিচয় হয়। ২০১৮ সালে দুইবার শ্রীলঙ্কায় গিয়ে তিনি প্রায় ১ মাস অবস্থান করেন। সে সময় মাদকদ্রব্য সংগ্রহ, প্যাকেজিং ও সরবরাহে জড়িত ছিলেন তিনি।’’

এ চক্রের সঙ্গে জড়িত দেশি – বিদেশি আরো বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তদন্তের অগ্রগতি সাপেক্ষে পরবর্তীতে বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে বলেও জানান মুফতি মাহমুদ খান।

শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে মাদকের সবচেয়ে বড় চালান
গত ৩১ ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে মাদকের সবচেয়ে বড় চালানসহ বগুড়ার মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন ও জয়পুরহাটের দেওয়ান রফিউল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর উপকণ্ঠ মাউন্ট লাভিয়ানা এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার দুইজনের কাছ থেকে ২৭২ কেজি হেরোইন ও ৫ কেজি কোকেন জব্দ করা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫২ কোটি টাকা। এর আগে ১৪ ডিসেম্বর একই এলাকা থেকে ৩২ কেজি হেরোইনসহ সূর্যমনি নামের এক বাংলাদেশি নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।