মাদক সেবনে দেহের পাশাপাশি বিশৃঙ্খল ও বিধ্বস্ত হয়ে যায় মনের স্বাস্থ্য, পুড়ে যায় আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধ, সমাজে নেমে আসে নানা অপকর্ম। এক সপ্তাহে এরকম দুটি ঘটনার পর বিষয়টি আরো একবার আলোচনায়।
মনোবিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, মাদকের সহজলভ্যতা তরুণ সমাজকে বিপথগামী করছে, মাদক সরবরাহ বন্ধে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে।
রাজধানীতে নতুন নতুন প্রতারণায় জড়িত সক্রিয় চক্র ‘সালাম পার্টি’, ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড চুরি প্রতারণায় মাদকাসক্ত অবসরপ্রাপ্ত উপ সচিবের মেয়ে জোবায়দা সুলতানাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে তারা বলেছেন, পারিবারিক দায়বদ্ধতা, শক্তিশালী সমাজ কাঠামো বাস্তবায়ন, অনুপ্রেরণাসহ মাদক সরবরাহ বন্ধে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে। মাদক পাচারকারী ও মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকেও সচেতন হতে হবে আরো বেশি।
বুধবার (২৮ মার্চ) ‘সালাম পার্টি’ নামক একটি সক্রিয় চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পল্টন থানা পুলিশ। তাদের দেখলে মনে হবে কোন কর্পোরেট অফিসে বড় পদে চাকরি করে নতুবা কোন বড় ব্যবসায়ী। বাচনভঙ্গি ও চালচলনে রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। হঠাৎই আপনার সামনে হাজির হয়ে সম্মানের সঙ্গে দিবে সালাম। আপনিও হয়তো থমকে দাঁড়াবেন, কৌতূহলী হয়ে উঠবেন। আর এই কৌতূহলের সুযোগ নিয়েই হাতিয়ে নেয়া হবে আপনার টাকা-পয়সা, মোবাইল ইত্যাদি।
মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়েই অন্ধকার পথ বেছে নেয় ৩৭ বছর বয়সী নারী জোবায়দা সুলতানা। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত উপ-সচিব। সমাজের উচ্চবানদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুযোগ বুঝে কৌশলে ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড হাতিয়ে নেয়ায় তার কাজ।
সম্প্রতি রাজধানীর কেএফসির একটি শাখা থেকে, সাবেক বিচারপতির এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রীর ক্রেডিট কার্ড চুরি করেন জোবায়দা। ওই কার্ড দিয়ে একটি শপিং সেন্টার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার কেনাকাটা করেন। গত ১২ মার্চ গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কাছে স্বীকার করেন এই নারী।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রধান ডা. মোহিত কামাল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: নেশায় পুড়ে যায় তাদের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধ। আমাদেরকে মাদক জিনিসটা নিয়ে জরুরীভাবেই ভাবতে হবে। যদি না ভাবি তবে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম মাদকের ভয়াল ছোবলে শেষ হয়ে যাবে।
মোহিত কামালের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বন্ধু বান্ধব কিংবা পারিবারিক সমস্যা থেকে মাদকে জড়াচ্ছে, কেউবা বিনোদনের জন্য, কেউবা পরীক্ষামূলকভাবে আবার কেউ স্থায়ীভাবেই মাদক গ্রহন করছে।
তিনি বলেন, আমাদের সমাজে মাদক নেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও ভৌগলিক অবস্হানগত কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হয়ে আসছে জীবন ধ্বংসী মাদকদ্রব্য। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রাঘব বোয়ালদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে, অনেক সময় তাদের প্রভাবে পুলিশকে অসহায় থাকতে হয়।
মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে মৌখিক উপদেশ দিয়ে কোন লাভ হবে না জানিয়ে তিনি বলেন: পারিবারিক দায়বদ্ধতা ও শক্তিশালী সমাজ কাঠামো বাস্তবায়ন করতে হবে।
মাদকাসক্তি একটি স্বাস্থ্যগত অসুখ জানিয়ে ডা. মোহিত কামাল বলেন: এটা ক্রাইম না, কিন্তু মাদকাসক্তরা মাদকের টাকা জোগাড় করতে ক্রাইমে জড়ায়।তারা বিত্তশালী হউক কিংবা নিম্নবিত্ত হউক মাদক গ্রহনে সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের চিকিৎসা করাতে হবে, আর মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলে আইনানুগ ব্যবসা নিতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) সুমন কান্তি চৌধুরী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘সালাম পার্টি’ চক্রটি নির্দিষ্ট এলাকায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাজ করে। এক এলাকার সিন্ডিকেট অন্য এলাকায় কাজ করে না। এরা এলাকা ভিত্তিক ৪/৫ জনের দল হয়ে কাজ করে থাকে।
গ্রেপ্তার হওয়া চক্রটি রাজধানীর শান্তিনগর, পল্টন ও কাকরাইল এলাকায় কাজ করত।
তিনি বলেন, এ চক্রের সদস্যরা বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলে। উন্নতমানের শার্ট, প্যান্ট, জুতা এমনকি শীতকালে কোট ও টাই পড়ে ঘুরে বেড়ায় টার্গেটের সন্ধানে। বিশেষ কায়দায় তারা চাকু, চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্র নিজেদের প্যান্ট বা কোটের পকেটে লুকিয়ে রাখে। যা বাইরে থেকে দেখলে বুঝার কোন উপায় নেই।
পরিস্থিতির আরো অবনতি ঠেকাতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কী করছে? জানতে চাইলে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক (ঢাকা উত্তর) মোহাম্মদ খোরশিদ আলম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার বদ্ধপরিকর, সরকার এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে।
আমরা মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই বেশ কিছু সাফল্যজনক অপারেশন পরিচালিত করছি।
‘মাদক নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র সরকার নয়– এগিয়ে আসতে হবে নিজেদের, থাকতে হবে থানা এবং ওয়ার্ড কমিশনারের মধ্যে সমন্বয়।’
খোরশিদ আলম বলেন: মাদকের বিরুদ্ধে সর্বোপরি গণজাগরণ ও গণআন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।