মাতৃভাষার মর্যাদা ইসলামে স্বীকৃত। মহানবী (সা.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। বায়হাক্বি শরিফের একটি হাদিসে তার মাতৃভাষা তথা আরবিপ্রীতির বিরল নজির পাওয়া যায়। তিনি বলেন- ‘তোমরা তিন কারণে আরবদের ভালবাসবে। প্রথমত আমি আরবিয়, দ্বিতীয়ত পবিত্র কুরআনের ভাষা আরবি এবং তৃতীয়ত জান্নাতবাসীদেরও ভাষা হবে আরবি। রাসুল (সা.)-এর উল্লিখিত বাণীর পরিপ্রেক্ষিতে মাতৃভাষার প্রতি তার অকৃত্রিম ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
একইভাবে এর মাধ্যমে অপরাপর সকল ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীর স্ব-স্ব ভাষার গুরুত্বও বৃদ্ধি পেয়েছে। মাতৃভাষার গুরুত্ব আমাদের কাছে আরো বেড়ে যায় যখন দেখি মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন- ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে তার জাতির মাতৃভাষাতেই প্রেরণ করেছি; যাতে তিনি আল্লাহপাকের বাণী সহজেই তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারেন’ (১৪ : ৪)। মহান আল্লাহ ও তার প্রিয় রাসুলের বাণীর মাধ্যমে মাতৃভাষার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া যায়।
পৃথিবীর সকল জনপদে তাদের নিজ নিজ ভাষা রয়েছে; যা তাদের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা এবং প্রাত্যহিক মনের অব্যক্ত বিষয়াবলি প্রকাশের তথা জীবন-যাপনের প্রিয় ভাষা। মমতাময়ী মায়ের কাছ থেকে প্রথম সে ভাষা শিখে বিধায় তার নামকরণ করা হয়েছে মাতৃভাষা হিসেবে। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ছয় সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জনপদের লোকেরা তাদের সেই প্রিয় মাতৃভাষায় কথা বলে থাকেন। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর বাণী- ‘আমার নিদর্শনসমূহের মাঝে রয়েছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি এবং ভাষা ও বর্ণের মধ্যে পার্থক্য; জ্ঞানীদের জন্য এতে সুনিশ্চিত অনেক নিদর্শন রয়েছে (৩০:২২)।’ পৃথিবীর অপরাপর সকল জিনিসের মতো মাতৃভাষার স্রষ্টাও স্বয়ং মহামহিম আল্লাহ। তিনি বলেন- ‘তিনিই মানব সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে মনের ভাব-বর্ণনা (ভাষা) প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন (৫৫:৩-৪)।’
মানবসমাজে অমানিশার ঘোর তমশাচ্ছন্নতার অবসানে আর অজ্ঞতা-মূর্খতার অন্ধকার দূরীকরণে মহান আল্লাহ সময়ের ব্যবধানে তার নির্বাচিত প্রিয়পাত্রদের প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা ও মর্যাদা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। মানুষ ও মানবতার সকল অপ্রাপ্তি পরিপূরণে ও পার্থিব-অপার্থিব সার্বিক সফলতা অর্জনের মানসে নাযিলকৃত সকল আসমানি গ্রন্থ স্ব-স্ব পয়গম্বরের মাতৃভাষাতেই প্রচারিত হয়েছে। আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষি করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তারা তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে (১৪:৪)।
হজরত আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহপাক প্রত্যেক নবীকে তার স্ব-জাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন (আহমদ)।’ আল্লাহর বাণীবাহক হজরত মুসা (আ.)-এর মাতৃভাষা ছিল ইবরানি, তাই এ ভাষাতেই মহান আল্লাহ তাওরাত কিতাব নাযিল করেছেন। একইভাবে হজরত দাউদ (আ.)-এর মাতৃভাষা ইউনানিতে জাবুর কিতাব, হজরত ঈসা (আ.)-এর মাতৃভাষা সুরিয়ানিতে ইঞ্জিল কিতাব আর সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবিতে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহপাক বলেন- ‘এই কোরআন বিশ্ব-জাহানের পালনকর্তার নিকট থেকে অবতীর্ণ। বিশ্বস্ত ফেরেশতা জিব্রাইল একে নিয়ে অবতরণ করেছে। আপনার অন্তরে, যাতে আপনি ভীতিপ্রদর্শনকারী হতে পারেন। আর এ মহাগ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়। নিশ্চই এর উল্লেখ আছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে (২৬:১৯২-১৯৬)।’ মহানবি (সা.) মাতৃভাষাতেই পবিত্র কোরআনের বাণী প্রচার করেছেন। ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম। আল-কোরআনে রয়েছে- ‘হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও (৪৯:১৩)।’
পৃথিবীর নানান জাতির বসবাস এবং তাদের মনোভাব প্রকাশের জন্য আপন আপন মাতৃভাষাও রয়েছে। সেই মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে তুরষ্ক, বুলগেরিয়া, মধ্য এশিয়ার অঞ্চলসমূহ আর ভারতের উত্তর প্রদেশসহ বিশ্বের কিছু জাতিগোষ্ঠীর। কিন্তু বাঙালি জাতি কেবল আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলার মানুষকে জীবনও দিতে হয়েছে। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন মোতাবেক ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে রচিত হয়েছে অমর এক শোকগাথা; যেখানে শাহাদতের সুধা পান করতে হয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেককেই। বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকারকে তারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মহান ভাষা আন্দোলনে বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মায়ের ভাষাকে মুক্ত করেছেন। যা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে আরো গভীরে নিয়ে গেছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের উচিত বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চা করা। বাংলাকে সকল বিকৃতি থেকে রক্ষা করা।
মহান ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক ধারণা থেকে আমরা বলতে পারি, ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষার এই আন্দোলনের প্রধানত উদ্দেশ্য ছিলো মাতৃভাষা বাংলার অবাধ ব্যবহার ও তার সার্বিক উৎকর্ষ বিধান এবং সর্বস্তরে চর্চার অধিকার আদায় করা। অপর উদ্দেশ্যটি ছিলো মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে সরকারি-বেসরকারি সকল অফিস-আদালতসহ রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানে এর যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং জাতীয় স্বাতন্ত্র্য-স্বকীয়তা বজায় রাখা ও সারাবিশ্বে এ ভাষার পরিচিতি আরো উন্নত পরিসরে ছড়িয়ে দেয়া। আর সেজন্যই আমাদের ভাষা আন্দোলনের মূল শ্লোগানই ছিলো- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
ভাষা আন্দোলনের আরেকটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো জাতি হিসেবে বাঙালির সকল গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষার সুস্পষ্ট অঙ্গিকার। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মুখের ভাষার পরিবর্তে সংখ্যালঘিষ্ঠ কোনো জাতির ভাষা এখানে চাপিয়ে দেয়া কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না; বরং তা সভ্যতা ও মূল্যবোধের চরম পরিপন্থী। এরকম একটি অগণতান্ত্রিক, অন্যায় ও মানবাধিকার পরিপন্থী বিষয়ের তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে গিয়েই মহান ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিলো; যা পরবর্তীতে বাঙালি জাতির জন্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূরীকরণে পর্যায়ক্রমে এক ঐতিহাসিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রূপ পরিগ্রহ করেছিলো। আর এক্ষেত্রে অমর একুশের অকোতভয় বীর শহীদদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মহানবী (সা.) ছিলেন আরবের সবচেয়ে সুন্দর ও শুদ্ধভাষী। তিনি কোনদিন একটি অশুদ্ধ বা বিকৃত শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করেননি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি শহীদদের অবদান এবং মহানবী (সা.)-এর মাতৃভাষা প্রীতির অজস্র নজির সামনে রেখে এ বিষয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
ইতিহাসের আলোকে আমরা দেখতে পাই, আরবের অধিবাসীদের নীতিবিধান, জীবনবোধ ও সামগ্রিক আচার-পদ্ধতি সহজে বোঝাবার জন্যই আরবি ভাষাতে কোরআন নাজিল হয়েছিল। আর তা আল্লাহপাকের এক বাণীতেও পরিষ্কার অনুধাবন করা যায়- ‘আমি একে আরবি ভাষায় কোরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পারো (১২:২)।’
মহান আল্লাহর এ নির্দেশনার আলোকে আমাদেরও উচিত সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলার যথার্থ প্রচলন এবং বাংলা ভাষার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আনয়ন। বাংলা ভাষার কবি, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক, প্রতিবেদকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত তাদের রচনায় আমাদের শিশু-কিশোরসহ অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত তথা বাংলা ভাষাভাষী সকল মানুষের সহজে বোধগম্য হয় এমন শব্দাবলির ব্যবহার করা। ভিন্ন ভাষায় রচিত গ্রন্থাদি সহজবোধ্য ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে উপস্থাপন বাঞ্চনীয়। ধর্মীয়, নৈতিক ও শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধীয় সকল রচনা মাতৃভাষায় ভাষান্তর হওয়া প্রয়োজন; যাতে ধর্মকে বুঝতে সহজ হয়, নৈতিক জ্ঞানে মানুষেরা গুণান্বিত হয় এবং বিদেশী রচনাবলির স্বাদ বাংলায় আস্বাদন করতে সক্ষম হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)