‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ আহবমান বাংলার এই সমৃদ্ধ রূপটি আবারও ফিরিয়ে আনতে এবছরের মৎস্য সপ্তাহের স্লোগান ,“মাছ চাষে গড়বো দেশ, বদলে দেব বাংলাদেশ”।
এ স্লোগানকে বাস্তবে পরিণত করে আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশ মৎস সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। এবারের মৎস্য সপ্তাহে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষপদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
মৎস্য সপ্তাহের এবারের প্রতিপাদ্যকে বাস্তব করতে আদৌ কতটুকু আশা জাগানো উদ্যোগ আছে তা নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মৎস্য বিজ্ঞানী ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ।
তিনি জানান, দেশের মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, প্রযুক্তির ব্যবহার, মৎস্য রপ্তানিপণ্যে বৈচিত্র এবং দেশীয় মাছ ও মাছের প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণে নেয়া গবেষণা উদ্যোগের নানা কথা। সাম্প্রতিক সময়ে তেলাপিয়া মাছ নিয়ে অপপ্রচার, পুকুরে ইলিশ চাষের বর্তমান অবস্থাও উঠে আসে এই আলাপনে।
ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, নদী,হাওর-বাওর এবং পুকুর-জলাশয়ের দেশে বর্তমানে মাছের উৎপাদন ৩৯ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ সালে দেশ মৎস্য সম্পদে পুরোপুরি সমৃদ্ধ হবে।
তবে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সাধ্যের মধ্যে প্রাণীজ আমিষের প্রধান উৎস মৎস্য সম্পদের সহজলভ্যতার জন্য আধুনিক চাষাবাদ-প্রযুক্তির বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।
ড. ইয়াহিয়া বলেন,‘আমরা বর্তমানে মৎস্য প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষের ৩৭ টি প্রযুক্তি নির্ভর প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। এগুলোর মধ্যে আছে পুকুরে রুই জাতীয় মাছের মিশ্রচাষ, তেলাপিয়া চাষ, হাঁস-মুরগির সঙ্গে সমন্বিত মাছ চাষ, খাঁচায় মাছ চাষ, ধানক্ষেতে মাছ চাষের মতো বেশ কয়েকটি পদ্ধতি।’
ফিরছে বিপন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ
শুধু বিদেশী কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন নয় দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলোকে সাধারণ মানুষের পাতে আবার ফিরিয়ে আনতে সরকারের আন্তরিকতাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এই মৎস্য বিজ্ঞানী বলেন,‘প্রধানমন্ত্রী দেশীয় মৎস্য প্রজাতি সংরক্ষণ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। বাজারে এখন পাবদা, গুলশা, টেংরা মাছের দেখা মিলছে। দেশে ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ আছে এর মধ্যে ৬৪টি প্রজাতি এখন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায়। আশার কথা হচ্ছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এই ৬৪ প্রজাতির মধ্যে ১৭ প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষ কৌশল উদ্ভাবন করেছে। প্রধানমন্ত্রী এই কাজের স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের পুরস্কৃত করেছেন।’
বিদেশ যাবে কাঁকড়া-কুঁচিয়া
নদীমাতৃক বাংলাদেশকে বিদেশ থেকে মাছ আমদানিকারক দেশের বদলে বরং রপ্তানিকারক দেশ হিসেবেই ভালো মানায় বলে মনে করেন তিনি। জানান, মৎস্য রপ্তানির পণ্য তালিকায় বৈচিত্র আনতে প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ রপ্তানি করা হয়েছে।
১৯৮৮ সালে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগ দিয়ে এবছরের ফেব্রুয়ারিতে মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেয়া এই কর্মকর্তা বলেন,‘দেশের বাজারে অপ্রচলিত মৎস্য প্রজাতির চাহিদা কম থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা আছে। এজন্য কাঁকড়া ও কুঁচিয়ার ওপর একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রকল্প সম্প্রসারণের কাজ করছে মৎস্য অধিদপ্তর এবং গবেষণার কাজ করছি আমরা। ইতোমধ্যে আমরা নিয়ন্ত্রিত উপায়ে কুঁচিয়ার পোনা উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছি। পাশাপাশি কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনেও প্রাথমিক সফলতা পেয়েছি।’
সীমিত জায়গায় সমন্বিত পদ্ধতির আধুনিক চাষাবাদে গুরুত্ব দেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে উৎপাদিত মৎস্য সম্পদের বড় অংশই হচ্ছে চাষ করা মাছ। এখন চাষটা হতে হবে প্রযুক্তি নির্ভর। স্বল্প জায়গায় অধিক উৎপাদনে জোর দেবো আমরা। এখন তো ধানের জমিতে শুধু মাছ চাষ সম্ভব নয়, তাই ধান-মাছ এবং এরকম সমন্বিত পদ্ধতির চাষাবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে।’
হালদা ও হাওর নিয়ে নতুন চিন্তা
শুধু পুকুর-দীঘি নয় দেশের উন্মুক্ত জলাশয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতেও গবেষণা কার্যক্রম চলছে বলে জানান মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক।
তিনি বলেন,‘অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হাওর। এবারের দুর্যোগের পর এই হাওর অঞ্চলে মাছ চাষ নিয়ে আমরা নতুনভাবে চিন্তা করছি। আগে মৎস্য অধিদপ্তর পোনা ছাড়তো। তবে কিভাবে এখানে কার্যকরভাবে বেশি মাছ উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে গবেষণা হয়নি। তাই হাওরে মাছ চাষ নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা শুরু হবে। ৮ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর হাওর জলাশয়ে ৪ মাস পানি থাকে। সেখানে যদি খাঁচায় মাছ চাষ করা যায় তাহলে ভালো উৎপাদন আসবে। পাশাপাশি হাওরের ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে একই সঙ্গে ধান ও মাছের সমন্বিত চাষাবাদ সম্ভব।’
দেশের কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদাকে সংরক্ষণে গবেষণা উদ্যোগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন,‘হালদা সংরক্ষণে আমরা এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বেশ কিছু সুপারিশ করেছি। আন্তঃসংস্থা সমন্বয়ের মাধ্যমে হালদাকে সুরক্ষিত করে মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হিসেবে গড়তে দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশগুলো বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিবেচনাধীন আছে।’
মৎস্য নিয়ে সাম্প্রতিক মশকরার জবাব
পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া দেশের মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের মাছের চাহিদা পূরণ করলেও তেলাপিয়া নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে চলছে নানা অপপ্রচার, আশঙ্কা ভরা খবর।
তবে তেলাপিয়া থেকে ক্যান্সার হতে পারে কিংবা তেলাপিয়ার ভাইরাস জীবনঘাতি হতে পারে এসব প্রচারণাকে সরাসরি ‘অপপ্রচার’ বলেছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান।
ড. ইয়াহিয়া জানান, বাংলাদেশ তেলাপিয়া উৎপাদনে এখন বিশ্বের শীর্ষ তালিকায়। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বাজারে সম্ভাবনার এই মৎস্য প্রজাতির বাজার নষ্ট করতে অপপ্রচার হতে পারে। যে ভাইরাসের কথা বলা হচ্ছে তা রান্নার পর মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। সব রকম পরীক্ষায় এটি প্রমাণিত।
কয়েক বছর ধরে দেশের পত্রপত্রিকা-অনলাইনে পুকুরে ইলিশ চাষ হচ্ছে এমন সংবাদ আসলেও আসেনি সফলতার সংবাদ।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘যেকোনো প্রজানির জন্য দরকার সিড ও ফিড,অর্থাৎ পোনা এবং খাদ্য। চাঁদপুরে,পটুয়াখালীতে জাটকা সংগ্রহ করে পুকুরে ছেড়ে দেখেছি এগুলো ৩’শ গ্রাম ওজনের পর আর বড় হয়না। আপাততঃ জাতিকে জানানোর মতো কোনো সাফল্যজনক অবস্থায় এই প্রকল্প এখনো আসেনি।’
ছবি: সাকিব উল ইসলাম