চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মাগুরার ‘মা জননী’দের প্রতি একরাশ ভালবাসা

মাগুরার ‘মা জননী’দের (নারী ফুটবলার) প্রতি একরাশ ভালবাসা এবং নিরন্তর অভিনন্দন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু ৯ম বাংলাদেশ গেমসের নারী ফুটবলে স্বর্ণ জিতে এক ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে আমাদের এই মা জননীরা। নিশ্চিত করেই বলতে পারি এমনটি হয়তো কারো কল্পনাতেই ছিল না যে সমসাময়িককালে ক্রীড়ায় জাতীয় পর্যায়ের কোনো লড়াই-এ আমাদের  মেয়েরা এমন এক অনন্য কৃতিত্ব দিয়ে মাগুরাবাসীকে ধন্য করবেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই আমাদের ‘মা জননী’রা রীতিমতো সবাইকে চমকে দিয়েছেন।

আসলেইতো বিস্ময়কর এক বিষয়। জাতীয় পর্যায়ের একক বা দলগত কোনো লড়াই-এ মাগুরা জেলার সাফল্যের খবরতো এর আগে কেউ শুনেনি। যা বা যতটুকু শুনেছে বা জানে তা সবই ব্যক্তিগত, জেলার কিছু নয়। স্বভাবতই এমন প্রাণময় এক খবর এল যেন যুগ যুগ পরে। জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনে মাগুরার অনেকেই ক্রিকেট, ফুটবল, ক্যারাম, দাবা, কাবাডি, শ্যুটিং-এ বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে তারকা খ্যাতি পেলেও মাগুরা জেলার প্রতিনিধিত্ব করে কোনো অর্জন বয়ে এনেছেন এমন নজির নেই বললেই চলে। সেই নিরিখে নড়াইলের টিটি দল, কুষ্টিয়ার সাঁতারু দল, নেত্রকোণার নারী ফুটবল দল-এদের কথা কেনা জানে। তবে ষাট সত্তর-আশির দশকে বৃহত্তর যশোর জেলা ফুটবল দলের হয়ে খেলে মাগুরার অনেকেই নিজ এলাকার সম্মান বয়ে এনেছেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সাবেক তারকা ফুটবলার বাদশা, খবির, লোভন, মকবুল, কাজী ফিরোজ, মোস্তফা, আনোয়ার, ছোট মোহনের নাম উল্লেখযোগ্য।

গত একদশক ধরে মাগুরার মাটির সন্তান সাকিব আল হাসান ক্রিকেটের মহাতারকা। কিন্তু কখনও কোথাও মাগুরার প্রতিনিধিত্ব করেছেন বলে জানা নেই। একই ভাবে দাবার ইমন, শুটিং-এর রত্না, ক্যারামের মাহফুজও জাতীয় পর্যায়ে নিজ নিজ ইভেন্টে অনবদ্য সাফল্য দেখালেও মাগুরাকে প্রতিনিধিত্ব করে কোনো কৃতিত্ব বয়ে এনেছেন বলে শুনিনি। কিন্তু ব্যতিক্রম এবার মাগুরা জেলা নারী ফুটবল দল। তাদের হাত ধরেই বঙ্গবন্ধু ৯ম বাংলাদেশ গেমসে উজ্জ্বলতর হয়ে ফুটে উঠেছে মাগুরা জেলার নামটি। এই সাফল্যে মাগুরার শ্রীপুরের গোয়ালদহসহ আর কয়েকটি গ্রামের খেটে খাওয়া পরিবারের কিশোরী-নবিরণ, লিমা, অর্পিতা, মারিয়া, আঁখিসহ অন্যান্য মা জননীরাই বড় অবদান রেখেছেন। মাঠে নেমে তারা নিজ জেলার জন্য জীবন দিয়ে লড়াই করেছেন। এর আগে কখনই এরা এতবড় জাতীয় পর্যায়ের লড়াই-এ না খেললেও সম্প্রতি এদের উত্থান ঈর্ষণীয়। একেবারেই স্বল্প সময়ের এদের অপ্রতিরোধ্য পথচলা এক নতুন জাগরণ তৈরি হয়েছে।

নবম বাংলাদেশ গেমসের আসর বসে গত ১ এপ্রিল। এই আসরের কোনো লড়াই-এ যে মাগুরার কোনো দল অংশগ্রহণ করছে সেটাও খোদ মাগুরাবাসীর অনেকেরই জানা ছিল না। কিন্তু ৪ এপ্রিল টেলিভিশন স্ক্রলে যখন ভেসে উঠে বঙ্গবন্ধু ৯ম বাংলাদেশ গেমসে নারী ফুটবলে স্বর্ণ জিতেছে মাগুরার জেলা নারী দল তখন কম-বেশি সবাই চমকে না উঠে পারেননি। ৪ এপ্রিল শনিবার বঙ্গবন্ধু নবম বাংলাদেশ গেমসের ফাইনালে মাগুরার বীরকন্যারা ট্রাইব্রেকারে ৩-২ গোলের ব্যবধানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে পরাজিত করে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্বর্ণ লাভের গৌরব অর্জন করে। এদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মাগুরা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মুখোমুখি হয়। প্রথমার্ধের ১৬ মিনিটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা দল গোল করে এগিয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয়ার্ধে মাগুরার মেয়েরা দুর্দান্ত খেলে গোল শোধ করে। মাগুরার হয়ে অর্পিতা গোল শোধ করেন। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে দু পক্ষই গোল করতে ব্যর্থ হলে খেলা ট্রাইব্রেকারে গড়ায়। পেনাল্টি শুটআউটে মাগুরার মেয়েরা ৩-২ গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে ব্রাক্ষণবাড়িয়াকে। বাংলাদেশ গেমসে এবার মোট ৮টি নারী ফুটবল দল অংশগ্রহণ করে। গ্রুপ পর্যায়ের খেলায় বাংলাদেশ গ্রæপ ‘বি’তে ফরিদপুরকে ৯-০ গোলে, ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ৩-১ গোলে এবং পঞ্চগড় জেলাকে ৫-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর সেমিফাইনালে মাগুরা নারী ফুটবল দল আনসার ও ভিডিপি দলকে ৫-০ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালে উঠে আসে। ফাইনালে অসাধারণ ক্রীড়ানৈপূর্ণ প্রদর্শন করে মাগুরার মেয়েরা স্বর্ণপদক জেতার অনন্য কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হয়। এখানে উল্লেখ্য গত বছর ৭ ডিসেম্বর রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৪ জাতীয় মেয়েদের ফুটবলে মাগুরার মেয়েরা ৩-১ গোলের ব্যবধানে রংপুর জেলাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়।

মাগুরা নারী ফুটবল দলের বেশিরভাগ ফুটবলারের বাড়ি শ্রীপুরের গোয়ালদহ গ্রামে। গোয়ালদহ স্কুল ঘিরেই তৈরি হয়েছে নারী ফুটবলাররা। এই স্কুলের শিক্ষক শহিদুল ইসলামসহ কতিপয় শিক্ষকের অনুপ্রেরণাতেই এখানে কিশোরীদের ফুটবল চর্চা শুরু হয়। ধীরে ধীরে এই চর্চাই এত বড় সাফল্যকে মুঠোবন্দী করেছে। জেলা নারী ফুটবল দলের কোচ হিসেবে বর্তমানে দায়িত্বে রয়েছেন বিকেএসপির সাবেক ফুটবলার শেখ মো. ইউনুস আলী। নারী ফুটবল দলের সাথে সংশ্লিষ্ট মাগুরা জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (ডিএফএ) সভাপতি অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান লাজুক বলেছেন, বাংলাদেশ গেমসে এর আগে মাগুরার কোনো অর্জন নেই। কিন্তু মাগুরার মেয়েরা প্রথমবারেই বাংলাদেশ গেমসে অংশগ্রহণ করে স্বর্ণপদক জয়ের মধ্যে দিয়ে পুরো জেলাবাসীকে গৌরাবান্বিত করেছেন। মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. সাইফুজ্জামান শিখর পুরো দলকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন সবসময়।

বাংলাদেশ গেমসে আমাদের মা জননীরা (মাগুরা জেলা নারী ফুটবল দল) যে সাফল্য দেখিয়েছি সেই সাফল্যকে শুধু অভিনন্দন দিয়ে সিক্ত করলেই হবে না। এই সাফল্য ধরে রাখতে অবশ্যই আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। প্রতিটি নারী খেলোযাড়ের পরিবারের আর্থিক বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। আমি মনে করি আমাদের এই ফুটবলারদের জন্য এখনই প্রয়োজন ভাল পৃষ্ঠপোষকতা। এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্তকর্তাবৃন্দ সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে ভাল পৃষ্ঠপোষক পাওয়া অসম্ভব কিছুই নয়। সঠিক সহায়তা দিতে পালে মাগুরাতে আজ নারী ফুটবলে যে জাগরণ তা আমাদের জন সামন্যে আরও বড় ধরনের সাফল্য বয়ে আনবে বলে আমার বিশ্বাস।

এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)