চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মন্ত্রীসহ প্রভাবশালীদের বিদেশে চিকিৎসা ও কিছু কথা

রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আহত দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। ঘটনার পরপরই তাদের ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়েছিল। গণমাধ্যমে এই খবর দেখার পরে ফেসবুকে একজন প্রশ্ন তুলেছেন, ঢাকা মেডিকেলে কি উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই? এটি তো দেশের অন্যতম বড় এবং আধুনিক হাসপাতাল-যেটি জনগণের পয়সায় চলে।

উন্নত চিকিৎসা বললেই আমরা প্রাইভেট কোনো অভিজাত হাসপাতাল বা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডকে বুঝি। যেমন সম্প্রতি উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মস্তিষ্কের ক্যারোটিড আর্টারিতে ব্লক ধরা পড়ায় ছয় মাস পরপর চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বিদেশে যেতে হয় তাকে। তার মতো আরও অনেক বড় নেতা এমনকি খোদ রাষ্ট্রপতিও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। সম্প্রতি নিজের চিকিৎসার জন্য মালয়েশিয়ায় যান খোদ স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চিকিৎসার জন্য তার বিদেশ যাওয়ার খবর শোনা যায় না। বরং রাজধানীর বেগুনবাড়ি এলাকায় নাক-কান-গলার বিশেষায়িত হাসপাতাল উদ্বোধনের দিন তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, এখানেই তিনি তার কানের নিয়মিত পরীক্ষা করাতে চান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেডে হামলায় তার কান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এরপর থেকে নিয়মিত তার কান পরীক্ষা করতে হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাস্থ্য বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, গ্রেনেড হামলায় আহত এবং মৃত্যুর মুখে পড়েও বারবার আহত-নিহতদের কাছে ছুটে যেতে চাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। কর্মীদের নিয়ে উদ্বেগের কারণেই নিজের চিকিৎসার দিকে মনোযোগও কম ছিল তার। এ কারণে তার নিজের চিকিৎসায় কিছুটা দেরি হয়। তাছাড়া আহতদের রেখে তিনি তখন উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশ ছাড়তে চাননি।

রাজনৈতিক নেতারা সব সময়ই তাদের বক্তৃতায় দেশ এগিয়ে যাওয়ার নানা ফিরিস্তি তুলে ধরেন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা। ফলে যখন দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কথা হয়, বিশেষ করে বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী অন্যান্য খাতের মতো দেশের স্বাস্থ্য খাতের যখন বিবরণ দেন, তখনও সেখানে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরেন। কিন্তু দেখা যায় মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীসহ সব ক্ষেত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান।

প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, নেতা বা অন্য কারো উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা দেশে কি নেই? যদি না থাকে তাহলে দেশ স্বাধীন হবার ৪৫ বছরেও কেন এমন একটি হাসপাতাল গড়ে তোলা সম্ভব হল না যেখানে তারা চিকিৎসা নিতে পারেন?

সিটিজেন রাইটস মুভমেন্ট নামের একটি সংগঠন একবার বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার এই প্রবণতা বন্ধের দাবি জানিয়ে একটি মানববন্ধন করেছিল, সেখানে বক্তারা বলেছিলেন, জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না করে রাজনৈতিক নেতাদের বিদেশে চিকিৎসা করানোর কোনো অধিকার নেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী-এমপিরা বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা নেন, এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার।

বিশিষ্ট চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, চিকিৎসা বাবদ দেশ থেকে প্রতি বছর ৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশ চলে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, দেশব্যাপী তিন শতাধিক এ রকম এজেন্ট রয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতি মাসে ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার রোগী বিদেশে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ভারতেই যাচ্ছেন গড়ে প্রতি মাসে ১৫ হাজার রোগী।

রোগীদের এই বিদেশমুখীনতার পেছনে অনেক কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগনির্ণয় ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। যে কারণে মানুষ এখান ভরসা পায় না। সম্প্রতি আমার এক আত্মীয় ঝালকাঠি শহরের একটি ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানতে পারলেন তার কিডনিতে জটিলতা হয়েছে। কিন্তু ঢাকায় জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে পরীক্ষার পর জানা গেল, তার কিডনী সম্পূর্ণ সুস্থ। যদি প্রথম পরীক্ষার ফলাফলে নির্ভর করে তিনি ওষুধ খেতেন, পরিণতি কী হত? প্রতিদিন এরকম হাজারো ভুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার শিকার হতে হয় মানুষকে। ফলে যাদের অর্থকড়ি আছে, তারাই বিদেশ চলে যান। কিন্তু সবার পক্ষে তো আর বিদেশ দৌঁড়ানো সম্ভব হয় না। তাদের চিকিৎসা অনেক সময়ই ছেড়ে দিতে হয় ভাগ্যের হাতে।

আমাদের দেশে নিত্য নতুন আলিশান হাসপাতাল গড়ে উঠছে। লম্বা পদবীর ভুরি ভুরি ডাক্তারও সেখানে বসেন। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর চিকিৎসার নামে মানুষের শেষ সম্বলও বিক্রি করানো হয়। কিন্তু তারপরও সেই রোগী সুস্থ হলেন কি না, সেটি এক বিরাট প্রশ্ন। বস্তুত আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় একদিকে বিরাট শুভংকরের ফাঁকি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সেবার বদলে মুনাফার লোভ। চিকিৎসা আর কোনো সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন বিরাট বাণিজ্য। ফলে বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে নেয়া এবং বড় বড় ডিগ্রিওয়ালা ডাক্তারদের বেতন আর কমিশন দেয়াই যখন ধ্যান-জ্ঞান, তখন মাথা ব্যথা হলেও রোগীকে ১০ হাজার টাকার পরীক্ষা নিরীক্ষা তো ধরিয়ে দেয়াই স্বাভাবিক।

আমাদের দেশের ডাক্তারদের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় অভিযোগ আন্তরিকতার অভাব। একজন ডাক্তার একদিনে ৫০/৬০জন রোগী দেখলে কী করে তার মনসংযোগ ঠিক থাকে? খুব ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো সিনিয়র ডাক্তার এক দুই মিনিটের বেশি রোগীর সঙ্গে কথা বলেন না। রোগীর কথা শুনতে চান না। কিন্তু যারা বিদেশে চিকিৎসা করাতে যান, এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও যারা চিকিৎসার জন্য যান, তারা বলেন, সেখানের ডাক্তাররা খুবই মনযোগ দিয়ে রোগীর কথা শোনেন। হাসিমুখে কথা বলেন। এতেই রোগীরা ভরসা পান।

বাংলাদেশে থেকে প্রতি বছর ঠিক কত মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান হয়তো নেই। তবে ধারণা করা যায়, এদের মধ্যে অধিকাংশই যান ভারতে। এছাড়া সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায়ও প্রচুর লোক যান। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই অনেকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। কেননা বিষয়টি ‘ফ্যাশনে’ পরিণত হয়েছে।

কিন্তু এই ফ্যাশন তৈরির পেছনেও কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে, যেগুলো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমাদের সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। ক্ষমতাবান লোক ছাড়া সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার; সিট বা কেবিন পাওয়া তো দূরের কথা। পক্ষান্তরে প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকে পয়সা থাকলেই সিট, কেবিন ও চিকিৎসার গ্যারান্টি আছে। কিন্তু রোগীর সুস্থ হবার কোনো গ্যারান্টি নেই। বরং বাড়তি টানা নেয়ার জন্য মৃত্যুর পরেও মরদেহ আইসিইউতে রাখার ঘটনাও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। আবার প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তার ও সেবকদের অনেকেই আসেন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে। সেসব জায়গায় আসলেই কী পড়ানো হয়, পাস করে বেরিয়ে আসলেই কতজন ভালো ডাক্তার হন, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

সুতরাং কেবল দেশপ্রেমের খাতিরে আমরা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাব না বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেও দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে বেহাল দশা, সেখানে রীতিমতো বিপ্লব ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য আরও বেশি সরকারি হাসপাতাল যেমন গড়ে তুলতে হবে, তেমনি সেখানে উন্নত এবং মানবিক চিকিৎসক নিয়োগের নিশ্চয়তা দিতে হবে। না হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য খোদ স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রীকেও বিদেশ যেতে হবে, যা দেশের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়। কেননা, বিদেশ গিয়ে যখন তিনি নিজের পরিচয় দেবেন, তখন সেই দেশের ডাক্তার প্রথমেই ধরে নেবেন, বাংলাদেশে কোনো চিকিৎসা হয় না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)