মন্ত্রিত্বের প্রথম কর্মদিবসে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, কৃষি মন্ত্রনালয়ের বড় চ্যালেঞ্জ হল কৃষিকে লাভজনক করা৷ আমরা যে ভিশন নিয়েছি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেটা বাস্তবায়ন করব৷ কিন্তু মন্ত্রিত্ব পেয়ে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে কী ভূমিকা নিলেন তিনি? ৬ মাস পর এসে তিনি বলছেন,দেশের উন্নয়ন হয়েছে বলেই কৃষক ধানের দাম পাচ্ছে না।
সরকার বরাবর কৃষকের পাশে ছিলো ও থাকবে জানিয়ে মন্ত্রী দাবি করেন, কিছু কিছু গণমাধ্যম তার বক্তব্য বিকৃত করে তাঁকে হেয় করার চেষ্টা চালাচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের সরকারি গাড়ি প্রদান অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি৷ কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতির মতো ধানক্ষেতে আগুন দেয় আর কৃষিমন্ত্রী উপজেলা কৃষিকর্মকর্তাদের বিলাস বহুল গাড়ী উপহার দেয়! আবার তিনি বলেন এ সরকার কৃষক বান্ধব সরকার কৃষকের পাশে আছে!
কিন্তু কে কার পাশে আছে এ কথাটা কি যার পাশে তার বলাটাই কি সংগত নয়? দেশজুড়ে কৃষকদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে চরম ক্ষোভের৷ এই ক্ষোভের সত্য ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে নিয়ে আসছেন গণমাধ্যম কর্মীরা৷ আর মন্ত্রী নিজের দায় এড়াতে দায়ী করছেন গণমাধ্যম কর্মীদের৷ প্রথম কর্মদিবসে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ,ম রেজাউল করিম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনের কথা বলেছিলেন৷ স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেছিলেন, গ্রামে শহরের সব নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হবে৷ নতুন শিক্ষামন্ত্রী হয়ে ডা.দিপু মনি বলেছিলেন, শিক্ষার সফলতা আরো সুসংগঠিত করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে৷ অব্যাহত থাকবে শিক্ষার মান উন্নয়ন৷ কিন্তু এই ৬ মাসে কার কতটুকু অর্জন?
২০১৯ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা দুদক এক প্রতিবেদনে বলেছে,ভূমি,শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির অভিযোগ বেড়েছে৷ এতে দুর্নীতি বাড়ার বড় কারণ হিসাবে সরকারী ব্যবস্থাপনার গলদকেই দায়ী করেছে দুদক৷ প্রতিবেদনটিতে তারা বলেছে,মাঠ পর্যায় থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ বেশি আসছে৷ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দুর্নীতির হাজার হাজার অভিযোগ করেছে৷
সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের জীবনে যে দুর্নীতি বা অনিয়মের মুখোমুখি হচ্ছে তা প্রতিরোধের বিষয়কেই বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা উল্লেখ করেছে প্রতিবেদনটিতে৷ মন্ত্রিসভার পুরনো মন্ত্রিদের বাদ দিয়ে নতুন মন্ত্রী নিয়োগে কি লাভ হল? মন্ত্রিত্ব পেয়ে তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পুরন করলেন কে? মন্ত্রিরা কথায় যতটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা বলেন বাস্তবে কি নির্দেশনা মানেন কেউ? মানলে মন্ত্রনালয়ে এত দুর্নীতি কেন?
তারা বললেন,গ্রামে শহরের সব নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হবে৷ কিন্তু বাস্তবতা কি বলে? গ্রামের মানুষ পাচ্ছেনা তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য৷ পাচ্ছেনা চিকিৎসা সেবা৷ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক হতে লোন নিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে শহরের মানুষ কিন্তু গ্রামের কৃষক পাচ্ছেনা কৃষি ঋন৷ শহরের মানুষ ব্যাংক লোন নিয়ে অট্টালিকা বানায় আর গ্রামের মানুষ তার একটা টিনশেড বসতঘর নির্মানে পায়না কোন লোন? তাই গ্রামের মানুষ বাধ্য হয়েই এনজিও হতে চড়া সুদে লোন নিয়ে সারা বছর কিস্তির আতংকে সময় পার করছে৷ এ অবস্থার ব্যর্থতার দায় কি ব্যাংকিং সেক্টরের নয়? এক্ষেত্রে মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী গ্রামে শহরের নাগরিক সেবা কবে যাচ্ছে? আদৌ যাবে কি?
নতুন মন্ত্রিদের প্রতি মানুষের অনেক প্রত্যাশা ছিল৷ মন্ত্রিত্ব পেয়ে প্রথম কর্মদিবসে দেয়া প্রতিশ্রুতি কি তারা কেউ পালন করতে পেরেছেন? তারা কেবল কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাজ করছেন ও দেশ এগিয়ে যাচ্ছে অনবরত এমন কথা বলে চলেছেন৷ কিন্তু নিজ মন্ত্রনালয়কে দুর্নীতিমুক্ত করা, জনবান্ধব করা ও দায়িত্বশীল করার ব্যাপারে ভাবছেন কি কেউ?
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মানে কি? মানে কি এই নয় যে প্রত্যেক মন্ত্রীর নিজ মন্ত্রনালয়ের স্বচ্ছতা,দায়বদ্ধতা ও গণবান্ধব করে তুলতে ব্যস্ত হয়ে ওঠা?প্রথম কর্মদিবসে গণপূর্ত মন্ত্রী দুনীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনের কথা বলেছিলেন৷ তার এই ব্যবস্থা গ্রহন কেন নিজ মন্ত্রনালয়ে কার্যকর হলোনা?রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে যা ঘটলো তাতে কি দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নের সর্বোচ্চ উদাহরন দৃশ্যমান হলো না? বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে দুর্নীতি বৃদ্ধির জন্য সরকারী ব্যবস্থাপনার গলদকেই দায়ী করছে দুদক৷ এর দায় কি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের উপরেই বর্তায় না?
দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা থাকে তবে এই নির্দেশনার অর্থ এই নয় কি মন্ত্রীসভার সকল মন্ত্রিকে তার নিজ মন্ত্রনালয়কেই সবার আগে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে৷ সবাইকে ব্যস্ত হতে হবে নিজ নিজ মন্ত্রনালয় নিয়ে৷ ব্যর্থ হলে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হবে৷ এমনটি না করলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স কেবল বক্তৃতাতেই শোভা পাবে৷ কাজের কাজ কিছুই হবেনা৷
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আরও সর্বোচ্চ ধাপ এগিয়ে বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা। তার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ফলে বাংলাদেশে দিন দিন দুর্নীতি কমছে। কিন্তু বাস্তবে কি মন্ত্রী ও সচিবগণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে? মন্ত্রীগণ হতে পেরেছে দুর্নীতিবিরোধী ও গণবান্ধব?
সাম্প্রতিক সময়ে রুপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের কেনাকাটায় দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হৈচৈ চলছে। এরফলে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। এই প্রেক্ষিতে সরকারী কেনাকাটায় দুর্নীতি প্রতিরোধে আলাদা সেল করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবার আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছিল। শোনা যাচ্ছে এন্টিকরাপশন ইনটেলিজেন্স ইউনিট’ গঠিত হতে চলছে সরকারী কেনাকাটা ও টেন্ডার মনিটরিং করতে৷
প্রকল্পের দর নির্ধারণ থেকে শুরু করে টেন্ডার প্রক্রিয়ার যাবতীয় অস্বচ্ছতা ও অনিয়ম খুঁজে বের করবে এই ইউনিট৷ যেসব সরকারী কর্মকর্তা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন তাদের চিহ্নিত করবে তারা৷ এই ইউনিট টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কোনো অনিয়ম পেলে সাথে সাথে তা সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবে এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে প্রেরণ করবে। জানা গেছে, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট এবং অ্যান্টি মানি লন্ডারিং টাস্ক ফোর্সের আদলে এই ইউনিটটি পরিচালিত হবে৷
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী কি সত্যিই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ হতে চলেছে? তবে মন্ত্রীরা কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন? মন্ত্রিদের কেন মন্ত্রিপরিষদ দিয়ে নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছেনা? তবে কি তারা প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছেন? প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিদের নিয়ন্ত্রন করবেন আর মন্ত্রীরা তার সচিবদের নিয়ন্ত্রন করবেন ও সচিবরা তার অধিনস্থ অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রন করবেন এমন একটি চেইন কমান্ডই কি কাঙ্ক্ষিত ছিলনা? যুদ্ধ মানেই সংঘাত ও রক্তক্ষয় নয় কি?
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,পাক ভারত যুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি কি সেরকম নজীরকেই দৃশ্যমান করেনি? যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেই একশ্রেনীর শান্তিবাদী বলতে থাকে, আমরা যুদ্ধ চাইনা শান্তি চাই৷ যুদ্ধ একপক্ষীয় হয়না দুপক্ষীয় মুখোমুখি ভূমিকার মধ্য দিয়ে হয়৷ দুর্নীতিবাজরা যদি সেরকম মুখোমুখি সংঘাতের দিকে যায় সে ব্যর্থতা কার? সরকারের নয় কি? এন্টি করাপশন ইনটেলিজেন্স ইউনিট এই যুদ্ধটা কিভাবে করবে? দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতি দূর করবে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেওতো রয়েছে বিস্তর অভিযোগ৷
দুদকের তদন্তে দোষী হয়ে জাহালম বিনা অপরাধে জেল কাটল৷ এই এন্টিকরাপশন ইনটেলিজেন্স ইউনিট কাদের নিয়ে গঠিত হচ্ছে? মাদকবিরোধী অভিযানে অনেক নিরাপরাধ মানুষকেও জীবন দিতে দেখেছি৷ কমিশনার একরামের মেয়ের,আব্বু তুমি কান্না করছো কেন’কথাটি দেশময় মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে৷ আমরা এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাইনা৷
মন্ত্রীরা অতিকথন পরিহার করে যদি নিজ নিজ মন্ত্রনালয়কে দূর্নীতিমুক্ত করতে প্রয়াসী হন৷ কর্মকর্তা কর্মচারীদের জবাবদিহীতার আওতায় আনেন ও নিজেরা নিয়মিত মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে তাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের জবাবদিহিতায় থাকেন তবেই দুর্নীতি কমবে৷ মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়াচ্ছে কিনা এর জবাবদিহিতাও মন্ত্রীকে করতে হবে৷
এন্টিকরাপশান ইনটিলিজেন্সইউনিট বিভিন্নপ্রকল্প,রাস্তাঘাট,ব্রিজ,কালভার্ট, নদী ও খালের বরাদ্দগুলোর প্রকৃত অবস্থা কি জাতির সামনে তুলে ধরতে পারবে? পারবে কি লুন্টনকারীদের আইনে সোপর্দ করতে? সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম কামরুজ্জামান ও তার স্ত্রী নাছিমা জামানের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৬৮ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুইটি পৃথক মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সহকারী কর কমিশনার মো. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধেও তিন কোটি ৪৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪২৯ টাকা সরকারী রাজস্ব আত্মসাতের মামলা করেছে দুদক৷ এমন অভিযোগের নজীর ভূরিভূরি৷
বিভিন্ন ইস্যুতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে টাকা বেরোচ্ছে আর লুটপাট হচ্ছে৷ মানুষ কি জানতে পারবে কতটাকা লুন্টন হল? আমরা দুর্নীতি বিরোধী কথন অতিকথন শুনতে চাইনা৷ কার্যকর পদক্ষেপ চাই৷ সেজন্য সবার আগে প্রয়োজন প্রত্যেক মন্ত্রীর নিজনিজ মন্ত্রনালয়কে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারা৷ তারা তা পারবেন কি? যদি এমনটি হয় তবেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সফল হতে পারে৷ ৬ মাস আগে মন্ত্রীসভার চমকপ্রদ রদবদল হয়৷ পুরনোদের বাদ দিয়ে নতুনদের অন্তর্ভূক্ত করা হয় এতে৷ কিন্তু এই রদবদলে কি দুর্নীতি কমলো না বাড়ল? তুলনামূলক পর্যালোচনায় এবিষয়টাও স্পষ্ট হওয়া কাম্য৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)