ভোক্তা দেশ হিসেবে আমাদের অবস্থান খুব ভালো। সাম্প্রতিক নানা গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশ মাঝারী মানের যে কোনো পণ্যের জন্য খুব ভালো ভোক্তা দেশ, মানে এটা একটা খুব ভালো বাজার ভোগ্যপণ্যের জন্য। আমদের দেশের ব্যতিক্রম শুধু গার্মেন্টস, ওষুধ ইত্যাদির মতো কিছু ক্ষেত্র। জাপানের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশ বিপুল জনসংখ্যা সম্পদের দেশ। অধ্যাপক আবুল বারকাত এই গবেষণাপত্রটির তথ্য কয়েকবছর আগের রুপসী বাংলা হোটেলে দেশী বিদেশী বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞদের সামনে উপস্থাপন করেন। আমাদের দেশে আর কী কী আছে তার তালিকা অনেক লম্বা। আছে সুপেয় পানি, বালি ইত্যাদি অনেক কিছু। কিন্তু আমাদের তা ব্যবহার করার মতো কারিগরি দক্ষতা, যোগ্যতা বা আর্থিক সংগতি নেই। আমাদের মানসিকতা ব্যবসা বা বাণিজ্যে, উৎপাদনে নয়। কোনো কিছু উৎপাদনের জন্য আগ্রহীর সংখ্যা খুব কম বা নেই বললেই চলে। কারণ উৎপাদন করে বিশ্ব বাজারে পণ্য নিয়ে টিকে থাকতে হলে গবেষণা করা লাগে। লাগে নতুন নতুন ইনোভেশন বা আবিষ্কার। এই জন্য সরকারী নীতি আর বেসরকারী উদ্যোক্তা লাগে, যেখানে আমরা খুব দুর্বল।পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে, জাপান এবার অদৃশ্য ট্রেন বানাচ্ছে। খবরে যা বলা হয়ে তা হলো, জাপানের ট্রেন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সেইবু রেলওয়ে এবার এমন এক ট্রেন বানাতে চায়, যা বাইরের দর্শকদের চোখে হবে ভার্চুয়ালি অদৃশ্য। নতুন প্রজন্মের অত্যাধুনিক জাপানের স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান সানার সহপ্রতিষ্ঠাতা স্থপতি কাজুও সেজিমা নতুন এই ট্রেনটির নকশা করেছেন। তিনি সম্প্রতি স্থাপত্যশিল্পের নোবেল খ্যাত ‘প্রিৎজকার প্রাইজ’ পেয়েছেন। ট্রেনটি যে সত্যিই পুরোপুরি অদৃশ্য হবে, তা কিন্তু নয়। ট্রেনটি হবে সর্বোচ্চ মাত্রার প্রতিফলনশীল। আসলে ট্রেনটি এর অত্যন্ত প্রতিফলনশীল কাচের দেয়ালগুলো দিয়ে আশপাশের সবকিছু থেকে আগত আলোকরশ্মি প্রতিফলিত করে আবার দর্শকের চোখেই ফিরিয়ে দেবে। ফলে ট্রেনটিকে আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্য বলে মনে হবে। ২০১৮ সালে লাইনে সংযুক্ত হয়ে জাপানজুড়ে ১৭৮ কিলোমিটারেরও বেশি পথ অতিক্রম করবে ট্রেনটি। বর্তমানে লাইনে আছে এমন ট্রেনের বাইরের দিকে প্রায় স্বচ্ছ এবং কাচ লাগানো পাত সংযুক্ত করে একে একটি রুপালি বুলেট ট্রেনের রূপ দেওয়া হবে।
আমাদের দেশেও এমন ছোটখাটো অনেক আবিষ্কার বা ইনোভেশন হয়ে থাকে প্রতিবছর। তাদের কথা কেউ মনে রাখে বলে মনে হয় না। যদি তারা শিক্ষাবিদ হন, তবে পত্রপত্রিকায় আসে, না হলে হারিয়ে যান কালের চক্রে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। ১. বিদ্যুৎ দিয়ে পানি গরম করার সময় অসাবধানতার কারণে পানি বিদ্যুতায়ন হয়ে প্রতিবছরই ঘটে নানা দুর্ঘটনা। বিদ্যুৎ খরচও হয় ব্যাপক। দুর্ঘটনা, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও স্বল্প মূল্যে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে মাত্র এক মাসের চিন্তায় দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও বিদ্যুৎ নিরোধক পানি গরম করার যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন নওগাঁর তরুণ উদ্ভাবক এসএম ইব্রাহীম হোসেন রাজু। তার মায়ের নাম অনুসারে যন্ত্রটির নাম দিয়েছেন ‘নূরজাহান বালতি’। ২. নদী বা সমুদ্রের পানিতে ভেসে থাকা তেল অপসারণের জন্য নতুন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী মো. ফারুক বিন হোসেন ইয়ামিন। তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে এই পরীক্ষা সফল হয়েছে। ৩. শ্রীপুরের মাওনা দক্ষিণপাড়া গ্রামে রফিকুল ইসলাম নামে এক যুবক নৌযান সনাক্তকরণে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। গভীর নদীতে কোনো নৌযান ডুবে গেলে আবিষ্কৃত ওই যন্ত্রের সাহায্যে নৌযানটি খুব সহজে খুঁজে বের করা যাবে বলে তার দাবি। সিলভার, তার আর ববিন দিয়ে এই যন্ত্রটি তৈরি করতে সর্বোচ্চ ২ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ হবে বলে জানান রফিকুল ইসলাম। নৌযানের উপরি ভাগে সিলভারের তৈরি একটি বল রাখতে হবে এবং নিচে তার রাখার জন্য বিশেষ ধরণের একটি বক্স থাকবে। নৌযানটি দুর্ঘটনায় পতিত হলে সিলভারের তৈরি ওই বলটি পানিতে ভেসে উঠবে। নদীর তলেদেশের যেখানেই নৌযান থাকবে বলটিও সেখানেই ভাসমান অবস্থায় থাকবে। তবে সমুদ্রে ডুবে যাওয়া নৌযান খুঁজে বের করার জন্য এই যন্ত্রটি যথেষ্ট নয় বলে জানান রফিকুল ইসলাম।
এমন আর খবর দেওয়া যায়। প্রতি বছর বিজ্ঞান মেলায়ও এমন নতুন নতুন কিছু ইনোভেশন বা আবিষ্কার হয়ে থাকে যার পরবর্তী গবেষণা দরকার। মূলতঃ সরকারী নীতি না থাকা আর্থিক বা অন্যান্য সহায়তার অভাবে এই সব উদ্যোগ হারিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের পাশের দেশ জাপানে এমন ধরনের ইনোভেশন বা আবিষ্কারকদের সরকারীভাবে আর্থিক ও কারিগরী বা প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। সরকার প্রতি বছর কিছু টাকা অনুদান হিসেবে রাখেন, যা থেকেই এই ইনোভেশন বা আবিষ্কারকদের সহায়তা দেওয়া হয়। যার একটা সফল হলেই ৫ বছরের অনুদানের টাকার শতগুন উঠে আসে এক বছরেই। ইনোভেশন বা আবিষ্কারকদের উৎসাহ দিতে আরেকটি কাজ অনেক দেশেই করে থাকেন, যা এই রকম। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাস করা ভালো ছাত্র ও গবেষণায় আগ্রহীদের একটা তালিকা তৈরি করা হয়। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের চাকনি দেন, ৩০০ গুণ বেশী বেতনে ৫ বা ১০ বছরের মেয়াদে। আবিস্কারের স্বত্ব পান ঐ কোম্পানি, নাম থাকে আবিস্কারকের সাথে রয়াল্টি পান। আর ঐ কোম্পানি ট্যাক্স মউকুফ পান যা তিনি বিনিয়োগ করেছেন নতুন গবেষণায়। হ্যাঁ সেখানে প্রতিটি কোম্পানি কত টাকা এই গবেষণায় খরচ করতে পারবেন তার একটা বাৎসরিক সিলিং থাকে। গবেষণার ফলাফল সরকারের সাথে শেয়ার করতে হয়, ট্যাক্স মওকুফ পাওয়ার বিনিময় হিসেবে। মেধাবী ছাত্রটিও কাজ করবেন নতুন আবিস্কারের নেশায় সাথে তার আর্থিক নিরাপত্তাও থাকবে সে কথা ভেবে। যে সব দেশ উন্নতি করছে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে তাদের দেশে এমন গবেষণা হচ্ছে খুব বেশী। এমন কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই যার গবেষণা ইউনিট নেই।জানিনা আমরা আর কতদিন ভালো ভোক্তা দেশ হিসেবে থাকবো। আমরা আদতেও কোনো পণ্যের উৎপাদক হয়ে বিশ্ব বাজারে মাথা উঁচু করে দাড়াতে চেষ্টা করবো কি না, আগামী দিনেই তা বলে দেবে। মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে আমাদের উৎপাদক দেশ হওয়া ছাড়া আর কী উপায় আছে তা বুঝতে খুব কষ্ট হয় আমার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)