মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশেই আছেন বাংলাদেশী মহিলা প্রবাসী। যাদের মধ্যে বড় একটা অংশ রয়েছেন শ্রমিক হিসাবে বিশেষ করে ঘরের কাজে কর্মরত। তাছাড়া কিছু সংখ্যক রয়েছেন উচ্চমানের কর্মে কর্মরত এবং অনেকে আবার ব্যবসা-বাণিজ্যেও জড়িত আছেন। মহিলা প্রবাসীদের কিছু সংখ্যক সফলতার সাথে প্রবাসে জীবন- যাপন করছেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুন্দর সংসার সাজিয়েছেন। প্রবাসেই নিজ পেশার পাশাপাশি কমিউনিটির সাথে যুক্ত হয়ে সামাজিক কাজেও এগিয়ে রয়েছেন।
প্রবাসে নিজ দক্ষতার ফলে বাংলাদেশী কিছু মহিলা প্রবাসী এগিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে মহিলা প্রবাসীর বড় একটি অংশ, বিশেষ করে মহিলা শ্রমিকরা বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তাদের জন্য প্রবাসে বেঁচে থাকাটা অনেকটাই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকে প্রবাসের সাথে নিজেকে মানিয়ে তুলতে পারছেন না। যার ফলে দিন দিন কষ্টের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই কষ্টের পেছনে বিশেষভাবে দায়ী কতিপয় বাংলাদেশী (দালাল হিসেবে পরিচিত)। মহিলা প্রবাসীদের দুটি কারণে সমস্যা হয় বেশি, বুঝে-শুনে না আসা এবং কিছু খারাপ বাংলাদেশী পুরুষের খপ্পরে পড়া।
শ্রমিক মহিলাদের অধিকাংশই পরিবারবিহীন থাকেন প্রবাসে। তাই তাদের প্রবাসে একা জীবন-যাপন করা অনেকটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশের মানুষ একদিকে হুজুগী অন্যদিকে লোভী। কিছু একটা শুনলেই না জেনে না বুঝে এটার পেছনে ছুটে। মহিলা শ্রমিকদের বিদেশে আসার জন্য এই হুজুগী মনোভাব ও লোভ কাজ করে। প্রবাসে মহিলা শ্রমিক কতটা নিরাপদ তা না ভেবেই চলে আসেন প্রবাসে। আবার অনেক মহিলা প্রবাসী দেশ থেকেই পতিতার কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়েই আসে।
বাংলাদেশী অনেক দালাল আছে, যারা দেশের মহিলাদের প্রবাসে নিয়ে এসে বিপদে ফেলে। কিছু সংখ্যক মহিলাকে যৌনকর্মী বানিয়ে অবৈধ ব্যবসা করায়। দালালরা মিথ্যে কথার ফুলঝুরিতে মহিলাদের মুগ্ধ করে প্রবাসে নিয়ে আসে। কৌশলে ভদ্র-শালীন মহিলাকে অশ্লীল জগতে গলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এরকমও হয় হতভাগী নিজেই অন্ধকার জীবনে চলে যায় জীবন বাঁচাতে। আবার অনেকে দেশ থেকে প্রবাসে এসেই যখন মাথাগোঁজার জায়গা পান না । প্রবাসে অবস্থানের বৈধতা পাওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য সহযোগী হিসেবে কাউকে পান না। তখন অচেনা দেশে একজন মহিলার কি করার থাকে? যখন একজন মহিলা তার চারপাশ অন্ধকার দেখে তখন সে যেদিকে যাবে সেটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। ভাগ্যক্রমে কিছু প্রবাসী মহিলা শ্রমিক আছেন যারা প্রবাসে এসে কাজ পান থাকা-খাওয়ার জায়গা পান। কিন্তু প্রবাসে আসার পরই যখন অপরিচিত মানুষের ঘরে কাজ করার জন্য একজন ভাষাজ্ঞানহীন মহিলাকে দেওয়া হয় তখন সে মহিলা কী কাজ করবে? একদিকে ভাষা জানা নেই অন্যদিকে রয়েছে কাজের পার্থক্য এবং অপরিচিত নারী-পুরুষ । অনেক মহিলাকে ব্যাচেলর ছেলেদের ঘরে কাজ করার জন্যও অবৈধভাবে আনছে বাংলাদেশী দালালরা । ফলে মহিলাটির ওপর প্রথম থেকেই শুরু হয় যৌন ও মানসিক নির্যাতন । অনেক ক্ষেত্রে মহিলাটি আইনের আশ্রয়ও নিতে পারে না বা সে সুযোগ পায় না। নির্যাতান সহ্য করতে না পেরে অন্যত্র পালিয়ে যান। অন্যত্রে পালানো মানেই প্রবাসে থাকার বৈধতা হারানো। বৈধতা হারিয়েও যে নির্যাতন থামবে সেই গ্যারান্টি নেই। আর তখন যদি নির্যাতনের শিকার হোন তখন পুলিশে অভিযোগ দেওয়ার সুযোগ পেলেও হয়তো প্রবাসে থাকার বৈধতা নেই বলে আইনের আশ্রয় নেবে না, বা নিতে গেলেই প্রথমে নিজে ধরা পড়বে। এই অবস্থায় মহিলাটির করণীয় কি হবে একবার ভেবে দেখুন?
তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের পথে-ঘাটে অনেক বাংলাদেশী মহিলা দেখা যায় কিন্তু তাদের সাথে কথা বলা যায় না। প্রয়োজন হয় না বা বলার পরিবেশ নেই। আবার যদি কথা বলতে চান তাহলে পরিচিত কেউ দেখলে অন্য চোখে দেখবে আপনাকে। যার একমাত্র কারণ কিছু অসভ্য মহিলা ও যৌনকর্মীদের দালাল কিছু পুরুষ প্রবাসীর কর্মকাণ্ড।
২০১২ সালের একদিন ক্রিকেট খেলার জন্য আমিরাতের শারজাহ শহরের আল কাসবা পার্কের পাশে বিশাল মাঠে ক্রিকেট খেলার জন্য গিয়েছিলাম। মধ্যপ্রাচ্যের তাপমাত্রা অনেক বেশি তাই সময়টা ছিল ফজরের নামাজের পর। খেলার একপর্যায়ে মাঠের পাশে বিশ্রাম নিচ্ছি, তখন দুজন বাংলাদেশী মহিলা আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। উনাদের দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম উনারা ঘরের কাজ করেন। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম, মহিলারা মসজিদের পানির কুলার থেকে বোতলে করে পানি নিতে এসেছে। পানি নিয়ে যাওয়ার সময় আমি উনাদের লক্ষ্য করে সালাম দিয়ে জানতে চাইলাম, মসজিদ থেকে পানি নেয়ার কারণ কী? উনাদের মধ্যে একজন বলেন, আমরা এখান থেকেই পানি নেই প্রতিদিন তিন থেকে চার বার। বুঝে নিলাম, উনাদের মালিক হাড়কিপ্টা, না-হয় কেন পানি মসজিদ থেকে নিয়ে পান করবেন?
মহিলা দুজনের কাছ থেকে অনুমতি চাইলাম কিছু কথা বলার। আমি উনাদের মধ্যে আগ্রহ দেখলাম কথা বলার। প্রথমেই উনাদের স্বামী-সন্তান পরিবারের খোঁজ নিলাম, তারপর প্রবাসের অবস্থা সর্ম্পকে কথা বলা শুরু করলাম। দুজনের মধ্যে যিনি কিছুটা বয়স্কা ছিলেন তিনি আমার সাথে কথা বললেন, পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে ইন্টারভিউ আকারে লিখলাম_
আপনারা দুজনেই একই ঘরে কাজ করেন?
জি, আমরা দুজনেই একই ঘরে কাজ করি।
কত দিন থেকে কাজ করছেন?
প্রায় দুই বছর।
আপনাদের দুজনের মধ্যে সর্ম্পক কী?
আমাদের দুজনের মধ্যে চাচাত বোনের সর্ম্পক।
কাজ করতে কি আপনাদের কোনো অসুবিধা হয়?
(চোখের পানি মুছতে মুছতে) ভাই বিদেশ এসেছি কাজ করার জন্য, কিন্তু জানতাম না যে, নির্যাতনের শিকার হব!
কীভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন?
আমাদেরকে যে বাংলাদেশী এনেছিল সে আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। আমাদেরকে নিয়ে আসার একদিন পর থেকে সে আমাদের দেহব্যবসায় লাগাতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা সেটা বুঝতে পেরে কৌশলে পালিয়ে আসি। পালিয়ে এসে আমরা পড়ে যাই বড় বিপদে; থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার জন্য টাকা নেই, পরিচিত কেউ নেই। অবশেষে বাধ্য হয়ে আমরা এক দালালের খপ্পরে পড়ে যাই, এর দুই মাস পরে এক বাংলাদেশির মাধ্যমে এই কাজ পাই। আজ প্রায় দুই বছর থেকে এক আরাবিয়ান মালিকের ঘরের কাজ করে আসছি। মালিক হাড়কিপ্টা হলেও চরিত্র ভালো আছে, তার স্ত্রী সন্তানরাও ভালো, এখানে আমাদের সমস্যা হচ্ছে না।
আপনারা দেশে যাবেন কী করে?
দেশে কবে যাব বুঝতেছি না ভিসাতো নেই, আমাদের পাসপোর্ট কোথায় আছে সেটাও জানিনা।
আপনাদের বেতন কি ঠিকভাবে পাচ্ছেন?
যা দিচ্ছে তাতে কোনো রকম খেয়ে দেয়ে বেঁচে আছি। আর সামান্য টাকা দেশে পাঠাতে পারি। তবে এখন আমরা বেতন নিয়ে বেশি চিন্তা করি না, শধু সুযোগ খোঁজতেছি, দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা হলেই দেশে চলে যাব।
তাহলে কি দেশে যাওয়ার জন্য কিছু করতেছেন?
না সেরকম কিছু করিনি। ভাবতাছি মালিককে শীগ্রই দেশে যাওয়ার জন্য বলব। আর না-হলে প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করে জেল খেটে দেশে যাব।
প্রবাসে মহিলাদের অনেক সমস্যার মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশী দুষ্কৃতিকারী পুরুষরা। আমি শুরু থেকেই শারজাহ শহরে আছি। যে এলাকায় থাকি সেই এলাকার অনেক বাংলাদেশীর সাথে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। একদিন আমার এক বন্ধু কথার প্রসঙ্গে বললো এখানে নাকি কিছু বাংলাদেশী মহিলা শ্রমিক আছেন যাদের ভিসা নেই অর্থাৎ অবৈধ ভাবে বাস করেন। এবং তারা পার্ট টাইম হিসেবে ঘরের কাজ করেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দু একজন বাংলাদেশী পুরুষ আছে যারা পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অবৈধ ভাবে বসবাসরত মহিলা শ্রমিকদের কাছ থেকে চাদা আদায় করে। পরবর্তীতে বিষয়টার সত্যতা যাচাই করে নিয়েছিলাম। আমিরাতে বসবাসের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় শয়তানেরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নীরিহ মহিলাদের কাছ থেকে চাদা আদায় করে।
প্রবাসে মহিলারা কাজের জন্য আসেন এমনকি সরকারি মাধ্যমেও আসছেন। কিন্তু কয়জন মহিলা শ্রমিক ঠিকমত সঠিক পথে কাজ করতে পারেন? প্রবাসের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মধ্যপ্রাচ্যে মহিলা শ্রমিক যে বা যারা নিয়ে আসে তাদের অনেকেই ক্রিমিনাল। তাই, আমার একটাই অনুরোধ দেশের মহিলা সমাজের কাছে, দয়া করে আপনারা না জেনে বিপদে পড়বেন না, নিজ পরিবার ছাড়া কোনো লোভে পড়ে বিদেশ আসবেন না।
যেসকল নারীরা প্রবাসে আসার চিন্তা করছেন তাদের উচিৎ হবে দেশে শ্রম দিয়ে জীবিকানির্বাহ করা।পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে নারীদের জন্য মানসম্পন্ন কর্ম সংস্থান করা প্রয়োজন। আর তা করতে হলে প্রথমে উদ্যেক্তা সৃষ্টি করতে হবে। সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগ্রহী নারীদের কর্মোপযোগী করতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে প্রসারিত করে দেশের গরিব অসহায় নারীদেরকে যারা কর্মে আগ্রহী তাদেরকে কাজে লাগাতে হবে। দক্ষতাসম্পন্ন নারীদের জন্য আলাদা কর্মসংস্থান করতে হবে। প্রবাসে নারীদের না পাঠিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে নিজ ঘরে বসে কুটিরশিল্পের কাজে উৎসাহ দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)